বগুড়ায় এক হাটে সাড়ে ৫৮ লাখ টাকার রাজস্ব হারালো সরকার

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক বগুড়া
প্রকাশিত: ০৭:১৩ পিএম, ০১ মে ২০২৪
ফাইল ছবি

বগুড়ার শাজাহানপুরে একটি হাটের ইজারায় সাড়ে ৫৮ লাখ টাকার রাজস্ব হারিয়েছে সরকার। পূর্ব নির্ধারিত ইজারা মূল্যের চেয়ে চারগুণ কম মূল্যে নতুন করে পুনঃ দরপত্রে হাটটি ইজারা নেন জেলা আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতা। বিষয়টি নিয়ে এলাকায় ক্ষোভের পাশাপাশি প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ৮১ লাখ টাকায় ১৪৩১ বঙ্গাব্দের জন্য শাজাহানপুরের নয়মাইল হাটটি ইজারা নেন জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি সাজেদুর রহমান সাহিন। তবে পহেলা বৈশাখের (১৪ এপ্রিল) মধ্যে টাকা পরিশোধ করতে না পারায় তার ইজারা বাতিল করে আবারও দরপত্র আহবান করে উপজেলা প্রশাসন। গত ২২ এপ্রিল দ্বিতীয় দফা হাটের ডাকে আগের চেয়ে চারগুণ কম মূল্যে (২২ লাখ টাকা) হাটটির ইজারা পেয়ে যান জেলা আওয়ামী লীগ নেতা আসাদুর রহমান দুলু।

বর্তমান জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দুলু ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা সাহিন দুজনই শাজাহানপুর উপজেলার বাসিন্দা। একসঙ্গে তারা স্বেচ্ছাসেবক লীগের রাজনীতি করেছেন। রাজনীতিতে স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি সাহিনকে সবাই আওয়ামী লীগ নেতা দুলুর ‘শিষ্য’ হিসেবে জানেন। তবে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক নানা আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। সবশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দুজনই বগুড়া-৭ আসনে নৌকা মার্কার প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। এ নিয়ে তাদের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে।

তবে আগামী ২৯ মে শাজাহানপুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে লড়ছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা ও খরনা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাহিন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপজেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলেন, উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতা দুলুর সমর্থন পেতে প্রথম দফায় নয়মাইল হাটের ইজারা পেয়েও সরে আসেন সাহিন। এজন্য উপজেলা প্রশাসন তার হাট ইজারার জামানতের ৮১ লাখ টাকার ৩০ শতাংশ ২৪ লাখ ৩০ হাজার টাকাও বাজেয়াপ্ত করে। শুধু ভোটের মাঠে গুরুকে খুশি রাখতেই তিনি এতবড় লোকসান মেনে নিয়েছেন।

শাজাহানপুর উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, চলতি ১৪৩১ বঙ্গাব্দে শাজাহানপুর উপজেলার ২৭টি হাটবাজারের ইজারা টেন্ডার হয়। এরমধ্যে গত ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে প্রথম দফায় ৮১ লাখ টাকায় নয়মাইল হাটের ইজারা পান স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা সাহিন। এজন্য তিনি উপজেলা প্রশাসনের কাছে ইজারা মূল্যের ২৫ শতাংশ ও ৫ শতাংশ ভ্যাট হিসেবে ২৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা জামানত হিসেবে জমা দেন। বাকি টাকা নিয়ম অনুযায়ী পহেলা বৈশাখের মধ্যে পরিশোধের কথা ছিল। তবে টাকা জমা দিতে না পারায় নয়মাইল হাটটির পুনরায় দরপত্র আহ্বান করা হয়। এ দফায় শাজাহানপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে চারটি ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে তিনটিসহ মোট সাতটি দরপত্র বিক্রি হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাতটি বিক্রি হলেও শেষদিনে (২১ এপ্রিল) দরপত্র জমা পরে মাত্র দুটি। একটি জোয়ারদার কনস্ট্রাকশনের স্বত্বাধিকারী ও আওয়ামী লীগ নেতা দুলুর, আরেকটি তার স্ত্রী শামীমা জেসমিনের। সেখানে সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে সরকার নির্ধারিত মূল্যে ২২ লাখ ৪৪ হাজার ৫০০ টাকায় হাটটি ইজারা পান আওয়ামী লীগ নেতা দুলু। এতে দ্বিতীয় দফার এ ডাকে সরকার ৫৮ লাখ ৫৫ হাজার ৫০০ টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপজেলার একজন হাট ইজারাদার বলেন, ‘স্ত্রীকে ডামি দরদাতা হিসেবে ব্যবহার করে হাটের ইজারা পেয়েছেন দুলু। বাকি পাঁচজনকে ম্যানেজ করায় কেউ আর দরপত্র জমা দেননি। এছাড়া দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল গত ১৮ এপ্রিল। আর জমা দেওয়ার শেষদিন ছিল ২১ এপ্রিল। মাঝে শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক বন্ধ থাকায় ব্যবসায়ীরা কিছু জানতেই পারেননি।’

তিনি বলেন, ‘উপজেলা কর্যালয়ের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে এমনটি হয়েছে। এছাড়া স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা সাহিনের জামানতের ২৪ লাখ ৩০ হাজার টাকাও দুলুই পরিশোধ করেছেন। মাঝে থেকে সরকারের অর্ধকোটিরও বেশি টাকার লোকসান হলো।’

বগুড়া শহরের কলোনি এলাকার বাসিন্দা সুমনও দ্বিতীয় দফায় নয়মাইল হাটের দরপত্র কিনেছিলেন। তিনি বলেন, ‘দুলু ভাই প্রবীণ রাজনীতিবিদ। উনি হাটের এক শতাংশ শেয়ার দেওয়ায় দরপত্র আর জমা দেইনি।’

ম্যানেজের বিষয়টি স্বীকার করে আওয়ামী লীগ নেতা আসাদুর রহমান দুলু বলেন, ‘কতজন দরপত্র কিনেছে বা জমা দিয়েছে তা জানি না। তবে সুমন নিজ থেকে চওয়ায় তাকে হাটের এক শতাংশ শেয়ার দিতে চেয়েছি। বাকিদের সঙ্গে কোনো কথা হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘দরপত্রে অনেক সময় ভুল থাকায় বাতিল হয়ে যায়। এজন্য টেন্ডার যেন মিস না হয় সেজন্য স্ত্রীর নামেও দরপত্র জমা দিয়েছিলাম। তবে প্রথমবারের ইজারা বাতিল ও সাহিনের সঙ্গে সমঝোতার অভিযোগ মিথ্যা। দীর্ঘসময় তার সঙ্গে কোনো কথাই হয়নি।’

এ বিষয়ে জানতে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা সাজেদুর রহমান সাহিনের সঙ্গে ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা ও মেসেজ পাঠিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহসিয়া তাবাসসুম জানান, আগের ইজারাদার টাকা জমা দিতে না পারায় দ্বিতীয়বার টেন্ডার আহ্বান করা হয়। তবে আমি দায়িত্ব বুঝে পাওয়ার আগে এসব হয়েছে। আমি আসার পর শুধু সরকারি মূল্যের সমপরিমাণ দরে ডাক হওয়ায় হাটটি ইজারা দিয়েছি।

এসআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।