প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রফতানিতে নতুন সংকট
প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য একটি উদীয়মান শিল্প খাত। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি হচ্ছে এ খাতের পণ্য। কিন্তু স্থানীয় নানা সমস্যা এবং প্রতিযোগী দেশগুলোর চেয়ে সুযোগ-সুবিধা কম থাকায় নানা প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে খাতটি। এরই মধ্যে বিশ্বব্যাপী মহামারি হিসেবে করোনাভাইরাসের প্রদুর্ভাবে রফতানি এ খাতটি নতুন করে সংকটের মুখে পড়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশীয় বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবন্ধকতা। নতুন নানা নিয়ম-কানুনের খড়গে এ খাতের শিল্প উদ্যোক্তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে— অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বাভাবিক সময়ে যেখানে ৭৫০ কনটেইনার প্রক্রিয়াজাত খাদ্য রফতানি করা হতো; করোনার প্রভাবে তা এখন ১৫০ এর নিচে নেমে এসেছে। কারণ একদিকে আমদানিকারক দেশগুলো ক্রয়াদেশ বাতিল করছে অন্যদিকে এ সংকটকালীন সময়ে দেশে রফতানি প্রক্রিয়া সহজ না করে নানা শর্ত দিয়ে জটিলতা তৈরি করা হচ্ছে।
প্রতিযোগী দেশগুলো যেখানে তাদের রফতানি প্রক্রিয়া সহজ করছে সেখানে দেশে উৎপাদিত পণ্যের রফতানির জন্য ফাইটো স্যানিটারি সনদ (পিসি) পেতে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কৃষি মন্ত্রণালয়কে জানানো হলেও এখন পর্যন্ত সমস্যার কোনো সুরাহা হয়নি। উল্টো নানা শর্ত জুড়ে দিচ্ছে সংস্থাগুলো। এতে রফতানি অনিশ্চয়তায় পড়েছে দেশের সম্ভাবনাময় প্রক্রিয়াজাত এ খাদ্য শিল্প।
জানা গেছে, বর্তমানে ইউরোপ, আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশসহ বিশ্বের ১৪০টির বেশি দেশে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য (প্রসেসড ফুড) রফতানি হচ্ছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের প্রক্রিয়াজাত খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, ওমান, কুয়েত, কাতারসহ সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, ইতালি, মরিশাস, ভারত, মালদ্বীপ, ব্রুনাই, দক্ষিণ আফ্রিকা, লেবানন, ফ্রান্স, ইন্ডিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, পর্তুগাল, অ্যাঙ্গোলা, সোমালিল্যান্ডসহ ৩০টির মতো দেশে প্রায় ৮০টি আইটেমের খাদ্যপণ্য রফতানি করছে। এর মধ্যে মরিচ, মসলা, মুড়ি, লজেন্স, জুস, লাচ্ছা সেমাই, বিস্কুট, কেক, নুডলস, জেলি, মাস্টার্ড অয়েলসহ বিভিন্ন বেভারেজ ও কনফেকশনারি খাদ্যপণ্য রয়েছে।
দেশের প্রক্রিয়াজাত খাদ্য রফতানিকারকরা জানান, চলমান করোনাভাইরাসে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৩শ’ কোটি টাকার প্রক্রিয়াজাত খাদ্য রফতানির আদেশ স্থগিত ও বাতিল হয়েছে। এমন সময়ও যেসব দেশ রফতানি আদেশ বহাল রেখেছে স্থানীয় নানা জটিলতার কারণে তা সঠিক সময়ে শিপমেন্ট করা যাচ্ছে না। কারণ প্রক্রিয়াজাত খাদ্য রফতানি করতে কৃষি অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে ফাইটো স্যানিটারি সনদ নিতে হয়। ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে এ সনদ দেয়া হয়। কিন্তু সম্প্রতি চট্টগ্রাম কৃষি অধিদফতরের সঙ্গনিরোধ বিভাগ এ সনদ দিতে বেশ অবহেলা করছে। আবার রফতানি পণ্যের অনুকূলে বিএসটিআই কর্তৃক ইস্যু করা হেলথ সার্টিফিকেট দাবি করে নতুন করে বিভিন্ন শর্ত জুড়ে দেয়া হচ্ছে। বিষয়টি কৃষি মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানানো হলেও এখন পর্যন্ত সুরাহা হয়নি।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য রফতানির এখন বড় বাধা হচ্ছে ফাইটো স্যানিটারি সনদ। সময় মতো সনদ না দেয়ায় শিপমেন্ট করা সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষ করে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন চট্টগ্রাম প্ল্যান্ট কোয়ারেন্টাইন উইং নানা ইস্যু তৈরি করে ফাইটো সনদ দিতে বিলম্ব করছে। চট্টগ্রাম অফিসের এ গড়িমসির কারণে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বাধ্য হয়ে ঢাকা থেকে ফাইটো সনদ নিচ্ছেন। কিন্তু সম্প্রতি চট্টগ্রাম অফিস মৌখিকভাবে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের ঢাকা অফিস থেকে সার্টিফিকেট দিতে নিষেধ করে দিয়েছে। এ অবস্থায় ব্যবসায়ীরা সঙ্গনিরোধ বিভাগের সংশ্লিষ্ট পরিচালক ও মহাপরিচালককে মৌখিক অভিযোগ দিয়েছেন। কিন্তু কোনো সুরাহ হয়নি।
ফাইটো সনদের প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সরাসরি হস্তক্ষেপ দাবি করে কৃষি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে গত ২ এপ্রিল চিঠি দেয় প্রক্রিয়াজাত খাদ্য উৎপাদক ও রফতানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ এগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশন (বাপা)। কিন্তু এখন পর্যন্ত সৃষ্ট সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি।
এ বিষয়ে বাপার সহ-সভাপতি ও হিফস এগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজের প্রধান নির্বাহী ছৈয়দ মুহাম্মদ শোয়াইব হাছান জাগো নিউজকে বলেন, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য উৎপাদন ও রফতানি নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়েছে। এ দুর্যোগের সময়ও বিভিন্ন শর্ত জুড়ে দিচ্ছে বিভিন্ন সরকারি সংস্থা। তারা রফতানির ফাইটো স্যানিটারি সনদের জন্য বিএসটিআইয়ের স্বাস্থ্য সনদ চাচ্ছে।
তিনি বলেন, করোনার ভয়াবহ দুর্যোগকালীন যেখানে আমদানিকারকরা বিভিন্ন শর্ত শিথিল করছে সেখানে রফতানিকারক দেশ কেন এত শর্ত আরোপ করছে? তারা বিএসটিআই মানের সনদ চাচ্ছে। যদি আমদানিকারক দেশের সঙ্গে বিএসটিআইয়ের মানের শর্ত সাংঘর্ষিক হয় তাহলে সমাধান কী হবে? বিগত দিনগুলোতে কোনো বাধা ছাড়াই পণ্য রফতানি করেছি। যেসব দেশে পণ্য রফতানি করেছি তারা তো কোনো আপত্তি করেনি। এখন তাহলে আমাদের দেশের আপত্তির যৌক্তিকতা কতটুকু— প্রশ্ন রাখেন তিনি।
কিছু প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচারিতায় উদ্যোক্তারা সমস্যায় পড়ছেন বলেও অভিযোগ করেন তিনি। এমন অবস্থায় একদিকে দেশ রফতানি আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য উৎপাদক ও রফতানিকারকরা। তাই সমস্যাগুলোর দ্রুত সমাধানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে তাগিদ দেন এ উদ্যোক্তা।
ফাইটো সনদ জটিলতার বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের চট্টগ্রাম সঙ্গনিরোধ রোগতত্ত্ববিদ সৈয়দ মুনিরুল হক জাগো নিউজকে বলেন, যেসব পণ্যে বিষক্রিয়া আছে অর্থাৎ মানুষের জন্য স্বাস্থ্যকর নয় ওই সব পণ্য রফতানিতে ফাইটো সনদ দেয়া হচ্ছে না। কারণ এর সঙ্গে বহির্বিশ্বে আমাদের সুনামের বিষয়টি জড়িত। তবে সব পণ্য নয় কিছু পণ্যে এ সমস্যা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আমরা রফতানি পণ্যের অনুকূলে বিএসটিআইয়ের হেলথ সার্টিফিকেট চেয়েছি। যাদের পণ্য সঠিক, তাদের সনদ দেয়া হচ্ছে; কোনো সমস্যা তো হচ্ছে না।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বাংলাদেশ থেকে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের রফতানি গত দুই বছরে বেড়েছে প্রায় ৮১ শতাংশ। সবশেষে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ খাতের রতফতানি থেকে আয় হয়েছে ৭০ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার (প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা)। রফতানি বৃদ্ধির এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০২১ সালে আয় বেড়ে ১০০ কোটি ডলারে পৌঁছবে।
এসআই/এমএআর/এমএস