এখন প্রয়োজন আলিবাবা-অ্যামাজনের মতো ভার্চুয়াল প্লাটফর্ম
ফয়সাল সামাদ। পোশাক শিল্পের একজন সফল উদ্যোক্তা। তৈরি পোশাক উৎপাদন ও রফতানিকারক উদ্যোক্তাদের সংগঠন- বিজিএমইএ’র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট। দেশের অন্যতম শীর্ষ নিট কম্পোজিট শিল্প সাভারটেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তিনি। পড়াশোনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রে। এছাড়া বিইউএফটি'র ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত বিশ্ব অর্থনীতি। কমেছে বাণিজ্য। থমকে আছে রফতানি। যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে দেশের তৈরি পোশাকশিল্পে। বাতিল হয়েছে রফতানি আদেশ। বৈশ্বিক চাহিদা কমায় আসছে না নতুন অর্ডার। কাজ না থাকায় বন্ধ হচ্ছে কারখানা। বেকার হচ্ছেন শ্রমিক। মহামারির এমন সংকটাপন্ন পরিস্থিতিতে নতুন কৌশলে ঘুরে দাঁড়াতে চাচ্ছে দেশের তৈরি পোশাক খাত। নেয়া হচ্ছে নতুন নতুন পরিকল্পনা। চলমান সংকট, উত্তোরণের উপায় এবং বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাকের সম্ভাবনা নিয়ে জাগো নিউজ’র সঙ্গে কথা হয় বিজিএমইএ’র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ফয়সাল সামাদের। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শফিকুল ইসলাম।
জাগো নিউজ : মহামারি করোনাভাইরাসের বর্তমান পরিস্থিতিতে তৈরি পোশাকশিল্পের অবস্থা ও ভবিষ্যৎ কী?
ফয়সাল সামাদ : বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাবে তৈরি পোশাক খাতে ব্যাপক আঘাত হেনেছে। নানামুখী সংকটে পড়েছে এ খাত। শুধু তিন দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলারের রফতানি অর্ডার বাতিল হয়েছে, বিষয়টা এমন নয়। আমরা দেখছি, বিশ্বব্যাপী খুচরা দোকানগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পোশাকের চাহিদাও কমেছে। এ মুহূর্তে চাহিদার তুলনায় খুব কমসংখ্যক কাজ নিয়ে কারখানা চালাতে হচ্ছে।
জাগো নিউজ : এমন পরিস্থিতিতে করণীয় কী?
ফয়সাল সামাদ : সংকটের মধ্যেও সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য আমাদের বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। প্রথমত, ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জামের (পিপিই) ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে কারখানাগুলোতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা দরকার।
দ্বিতীয়ত, ভোক্তার ক্রয়ের ধরন পরিবর্তন হচ্ছে। গতানুগতিক/ঐতিহ্যবাহী মডেল ছেড়ে নতুন মডেলের অনুসরণ করা। বিদ্যমান বিটুবি (ব্যবসায়ী টু ব্যবসায়ী) মডেল থেকে ব্যবসায়ী টু ভোক্তা (বিটুসি) মডেলে যাওয়ার চেষ্টা করা। এ পন্থায় পণ্যের অর্ডারের পরিমাণ কম হবে; তবে দাম আরও বেশি পাওয়া যাবে। এতে নতুন একটি ব্যবসায়িক মডেল তৈরি হবে।
তৃতীয়ত, এই মুহূর্তে পণ্যের বৈচিত্র্যকরণের ওপর মনোযোগ দেয়া। তুলাভিত্তিক পোশাক থেকে বেরিয়ে বৈশ্বিক চাহিদা অনুযায়ী ম্যান মেড ফাইবার (এমএমএফ) বা কৃত্রিম আঁশের তৈরি পণ্য উৎপাদনে আরও গুরুত্ব দিতে হবে। পরিবেশবান্ধব পোশাক সম্পর্কে ক্রেতারা খুব ভালোভাবেই অবগত। সুতার চেয়ে এমএমএফ ফাইবার অধিক পরিবেশবান্ধব। তাই বিশ্ববাজারে কটন সুতার পণ্যের বাজার কমছে অন্যদিক ম্যান মেড ফাইবারের তৈরি পণ্যের চাহিদা বাড়ছে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রাইস ওয়াটারহাউস কুপারসের (পিডব্লিউসি) পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৭ সালে বিশ্ববাজারে তুলার তৈরি কটন পণ্যের চাহিদা ৩৫ শতাংশ ছিল। ওই সময়ে শতভাগ কটন পণ্যের সমন্বিত বার্ষিক প্রবৃদ্ধি (সিএজিআর) দশমিক ৫ শতাংশ কমে। একই সময়ে ম্যান মেড ফাইবারের চাহিদা ছিল ৪৫ শতাংশ; পাশাপাশি সিএজিআর বাড়ে ৫ শতাংশ। ওই সময় এমএমএফভিত্তিক পোশাকের বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য ছিল ১৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যেখানে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ মাত্র ৫ শতাংশ আর ভিয়েতনামের ছিল ১০ শতাংশ। যেহেতু এখন বিশ্ববাজারে ভোক্তাদের পরিবেশবান্ধব ম্যান মেড ফাইবারের চাহিদা বেশি, এ সুযোগ আমরা সহজেই কাজে লাগাতে পারি।
চতুর্থত, বাজার ও পণ্যবৈচিত্র্যের সম্ভাবনার অনুসন্ধান আরও বেশি প্রয়োজন।
জাগো নিউজ : করোনায় আর্থিক ক্ষতি মোকাবিলায় সরকার বিভিন্ন প্যাকেজ ঘোষণা করেছে; এগুলো পোশাক খাতকে কতটুকু সহায়তা করবে ?
ফয়সাল সামাদ : পোশাকসহ রফতানি বাণিজ্যের উন্নয়নে সরকার যেসব প্যাকেজ ঘোষণা করেছে আমরা এটাকে স্বাগত জানায়। তবে এর পাশাপাশি পোশাক কারখানাগুলোর ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য আর্থিক খাতের নীতিগত সহযোগিতা জরুরি। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। ক্ষতিগ্রস্তদের সাধারণ দৃষ্টিতে না দেখে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া উচিত। এজন্য অন্তত এক বছর কেস টু কেস ভিত্তিতে নীতিগত সহায়তা দেয়া দারকার। যাতে নতুন করে প্রতিষ্ঠানগুলো আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে।
জাগো নিউজ : বর্তমান বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে পোশাক খাতের উন্নয়নে সরকারের কাছে আপনাদের প্রত্যাশা কী?
ফয়সাল সামাদ : সরকারের সহযোগিতা অবশ্যই প্রয়োজন। ইতোমধ্যে সরকার বেশকিছু নীতিসহায়তা দিয়েছে। বিশ্ববাজারে তুলাহীন পোশাকের সম্ভাবনা এবং বাণিজ্য সুবিধাগুলো বিবেচনা করে কৃত্রিম ফাইবার উৎপাদনে করছাড় দিয়েছে সরকার, যা খাতটির পণ্যবৈচিত্র্যকরণে সহযোগিতা করবে।
আমরা সরকারকে একটি প্রস্তাব দিয়েছি, আলিবাবা বা অ্যামাজনের মতো অনলাইন প্লাটফর্ম বা ভার্চুয়াল মার্কেট তৈরি করা যায় কি-না। এজন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালার প্রয়োজন। যদি আমরা এটি তৈরি করতে সক্ষম হই, তাহলে এটি আমাদের কারখানা ও পশ্চিমা গ্রাহকদের মধ্যে সরাসরি সংযোগসেতু তৈরি করবে। ব্যবসা-সম্ভাবনার নতুন দুয়ার উন্মোচিত হবে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিলসহ বড় বড় বাজারে প্রচুর শুল্ক বাঁধা রয়েছে। সরকারি পর্যায়ে তাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে বিষয়গুলোর সমাধান দরকার। এটি করতে পারলে ব্যবসার নতুন বাজার তৈরি হবে।
জাগো নিউজ : নতুন বাজার তৈরি ও পণ্যের বহুমুখীকরণে বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন কি-না?
ফয়সাল সামাদ : বর্তমান বিজিএমইএ বোর্ড গত বছর দায়িত্ব নিয়েছে। পণ্য ও বাজার বৈচিত্র্যকরণের বিষয়টি এই বোর্ডের গুরুত্বের শীর্ষ তালিকায় রয়েছে। এজন্য বিজিএমইএ নিয়মিতভাবে সব পর্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে যাচ্ছে। আমরা সক্রিয়ভাবে বাজার গবেষণা করছি, বিশ্বব্যাপী বাজার চাহিদা এবং কেনার ধরনগুলো বিশ্লেষণ করেছি। নতুন নতুন পণ্যের উদ্ভব ও ব্যাপ্তির বিষয়গুলোও পর্যবেক্ষণ করছি।
বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকে সরকার, বিদেশি ডেভেলপমেন্ট পার্টনার ও বিজিএমই মেম্বারদের নিয়ে মাসিক সেশন করা হচ্ছে। সেশন রিপোর্টগুলো সব সদস্য ও নীতিনির্ধারকদের কাছে উপস্থাপন করা হচ্ছে। পাশাপাশি এ খাতের বর্তমান পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাব্যতা নিয়ে সাপ্তাহিক তথ্যচিত্র ও মাসিক প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করে সবার কাছে সরবরাহ করা হচ্ছে।
এসআই/এমএআর/এমএস