কর বৃদ্ধির পর কতটা বাড়বে এসি-ফ্রিজের দাম?
এক সময় কেবল বিত্তবানদের ঘরেই থাকতো রেফ্রিজারেটর। বিদেশি কোম্পানির উচ্চমূল্যের ফ্রিজ কেনার সামর্থ্য হতো না মধ্য ও নিম্নবিত্ত পরিবারের। সেই দিন বদলেছে। দেশীয় কোম্পানিগুলোর বদৌলতে দাম কমেছে ফ্রিজের। ফলে নিম্ন আয়ের মানুষের ঘরেও জায়গা করে নিয়েছে ফ্রিজ।
একই অবস্থা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বা এসির। ফ্রিজের মতো এসিতেও দেশীয় ব্র্যান্ডের দাপট বেড়েছে। ফলে কমেছে দাম। মোটরসাইকেলও এখন আমদানি করতে হয় না। বিভিন্ন দেশের ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল এখন বাংলাদেশেই তৈরি হয়। মূলত দেশে গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো আর কর সুবিধা পেয়েই এ তিনটি পণ্য আমদানি থেকে বেরিয়েছে। আবার দেশে তৈরি পণ্য অনেক দেশে রপ্তানিও হচ্ছে। তবে এবার এসব শিল্পে করপোরেট কর বা আয়কর দ্বিগুণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে এসব পণ্যের খুচরা যন্ত্রাংশেও আয়কর দ্বিগুণ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে গত মঙ্গলবার (৭ জানুয়ারি) জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। আয়কর দ্বিগুণ করায় এসব শিল্প নতুন করে চাপের মুখে পড়বে, পাশাপাশি পণ্যের দাম বাড়তে পারে বলে খাত-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
আরও পড়ুন:
- ইন্টারনেটসহ শতাধিক পণ্যে খরচ বাড়লো
- অনির্দিষ্টকালের জন্য রেস্তোরাঁ বন্ধের হুমকি মালিকদের
- ভ্যাট বাড়লেও জিনিসপত্রের দামের ওপর তেমন প্রভাব পড়বে না
- ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহারেও খরচ বাড়ছে
২০০৯ সাল থেকে ইলেকট্রনিকস শিল্পের করে ছাড় দিয়েছে সরকার। এসব শিল্পের করপোরেট কর, কাঁচামাল আমদানিতে অগ্রিম আয়কর এবং উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়ে কর ছাড় দেওয়ায় দেশে অন্তত এক ডজনের বেশি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসব শিল্প ২০২১ সাল থেকে যন্ত্রপাতি আমদানিতে ২ শতাংশ এআইটি এবং আয়ের ওপর ১০ শতাংশ কর দেওয়ার সুবিধা পেয়ে আসছিল। এসব সুবিধা ২০৩২ সাল পর্যন্ত বলবৎ থাকার কথা ছিল। তবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে ফ্রিজার, রেফ্রিজারেটর, এয়ারকন্ডিশনার, কম্প্রেসর ও মোটরসাইকেলের করপোরেট কর ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে দ্বিগুণ হতে পারে কাঁচামাল আমদানিতে অগ্রিম আয়করও।
এনবিআর মনে করছে, এই উদ্যোগের ফলে চার হাজার কোটি টাকা আয়কর আদায় বাড়বে। যদিও আয়কর দ্বিগুণ হওয়ায় দেশে তৈরি মোটরসাইকেল, ফ্রিজ, এয়ারকন্ডিশনারের দাম বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
জানতে চাইলে যমুনা ইলেকট্রনিকসের পরিচালক (বিপণন) সেলিম উল্যা সেলিম জাগো নিউজকে বলেন, কর সুবিধার কারণেই আমদানিনির্ভর পণ্যগুলো এখন দেশেই উৎপাদন হচ্ছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে চলে গেছে। বর্তমানে কর বৃদ্ধির যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা দেশের অর্থনীতির জন্য সুখকর কিছু হবে না। যে হারে ভ্যাট- ট্যাক্স বাড়ানো হয়েছে, এতে পণ্যের দাম আরও বেড়ে যাবে।
এদিকে শতাধিক পণ্য ও সেবার ভ্যাট বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে এনবিআর। হোটেল-রেস্তোরাঁয় খাওয়া, বিমানের টিকিটসহ সিগারেট, সিগারেট ছাড়াও ওষুধ, গুঁড়া দুধ, বিস্কুট, জুস, ফল, সাবান, মিষ্টি, মোবাইল ফোনে কথা বলা ও ইন্টারেনেট রয়েছে ভ্যাট ও শুল্ক করের তালিকায়।
এসব পণ্যে মোট ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা এতদিন ৫ থেকে সাড়ে ৭ শতাংশ ছিল। এছাড়া বিভিন্ন পণ্য ও সেবায় আবগারি শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
এ বিষয়ে এনবিআরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আল-আমিন শেখ বলেন, আয়কর অব্যাহতির সংস্কৃতি থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসার ধারাবাহিকতায় আয়কর অব্যাহতির বেশ কিছু বিধান বাতিল ও সংশোধন করা হয়েছে। আরও কিছু কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন। যেসব পণ্য ও সেবায় ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক ও আবগারি শুল্ক বৃদ্ধি করা হচ্ছে তার মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নেই। বিধায় সর্বসাধারণের ভোগ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পাবে না। মূল্যস্ফীতিতেও প্রভাব পড়বে না।
তবে করছাড় দেওয়া এসব পণ্যের দাম বাড়লে ফের আমদানিনির্ভরতা তৈরি হবে বলেও মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
- আরও পড়ুন:
আয়কর দেন না এমন ব্যবসায়ীদের খুঁজতে নির্দেশ - মেট্রোরেলে আরও এক বছর ভ্যাট মওকুফ
- ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত: ব্যবসায়ীরা ক্ষুব্ধ, আন্দোলনের হুমকি
- নকল পণ্য প্রতিরোধে আমদানির ওপর শুল্ক কমানোর দাবি
- কর কমানোর পরও বাজারে স্বস্তি না আসায় অর্থ উপদেষ্টার উদ্বেগ
ইলেকট্রনিক্স পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ইলেক্ট্রো মার্টের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল আফসার বলেন, বিনিয়োগে এখন ধীর গতি রয়েছে। এখন একধাপে কর দ্বিগুণ করায় শিল্প আরও বড় সমস্যায় পড়বে। করহার এক লাফে দ্বিগুণ না করে ধাপে ধাপে বাড়ালে তা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য ভালো হতো।
২০০০ সালের শুরুতে দেশে মোটরসাইকেল উৎপাদন শুরু হয়। খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, এ খাতে এখন পর্যন্ত প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করছেন প্রায় দুই লাখ কর্মী। বর্তমানে রাস্তায় চলছে এমন সব মোটরসাইকেলের প্রায় ৯০ শতাংশের বেশিই দেশে তৈরি অথবা দেশে সংযোজন করা।
জানতে চাইলে নিউ গ্রামীণ মটরসের চেয়ারম্যান মেজবাহ উদ্দিন মামুন জাগো নিউজকে বলেন, বড় শিল্পগ্রুপের মতো ছোট শিল্পপ্রতিষ্ঠানও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। উৎপাদন খরচ বাড়ায় পণ্যের দাম বাড়বে। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি বাড়ায় তা ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হবে।
৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়তে পারে ফ্রিজ ও এসির দাম
করপোরেট কর দ্বিগুণ হওয়ায় এসি ও ফ্রিজের উৎপাদন খরচ বাড়বে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা। এরসঙ্গে অন্যান্য কর বৃদ্ধি, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় এসি ও ফ্রিজের দাম চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা বাড়তে পারে বলে উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন।
ব্যবসায়ীরা উদাহরণ দিয়ে বলছেন, যদি কোনো ব্র্যান্ডের ২৫০ লিটার একটি ফ্রিজের দাম এখন ৪০ হাজার টাকা হয়, কর দ্বিগুণ করার ফলে তা বিক্রি হবে ৪৫ হাজার টাকায়। একইভাবে এসির দাম বাড়বে চার-পাঁচ হাজার টাকা।
নুরুল আফসার বলেন, কর বাড়ার ফলে ফ্রিজের উৎপাদন খরচ বাড়বে ৩০০ টাকা থেকে এক হাজার টাকা। এসির ক্ষেত্রে এই খরচ ৭০০ থেকে দুই হাজার টাকা বাড়বে।
- আরও পড়ুন
রাইস ব্রান অয়েল রপ্তানিতে কড়াকড়ির সুপারিশ - জাহাজের মূলধনী যন্ত্র আমদানিতে ভ্যাট অব্যাহতি
- ভোজ্যতেল আমদানিতে ফের ভ্যাট কমালো এনবিআর
- ধীরে ধীরে করছাড় তুলে দেওয়া হবে: এনবিআর চেয়ারম্যান
- হাতবদলেই ‘হাওয়া’ সবজিতে কৃষকের লাভ
তিনি আরও বলেন, বাড়তি করপোরেট করের পর ভ্যাট আছে, অন্যান্য কর আছে। মূল্যস্ফীতিতে আমাদের ব্যবসা পরিচালনা খরচ ২০-২৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। সেই হিসাবে এসব পণ্যের দাম তিন হাজার টাকার বেশি বাড়বে।
ভিক্টরি ইলেকট্রনিক্সের স্বত্বাধিকারী গৌরাঙ্গ দে জাগো নিউজকে বলেন, ফ্রিজ ও এসির উৎপাদন খরচ ১০-১৫ শতাংশ বেড়ে যাবে। ডলারের দাম বাড়তি, কাঁচামালের খরচও এখন বেশি। এসব পণ্যের দাম চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়তে পারে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, রাজস্ব আয় বাড়াতে এনবিআরের হাতে কর বাড়ানো ছাড়া নতুন কোনো অস্ত্র নেই। কর বাড়ায় গ্রাহকের সাময়িক অসুবিধা হবে। উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর জন্যও নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হবে।
জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ড. আব্দুর রাজ্জাক জাগো নিউজকে বলেন, সরকারের রাজস্ব আদায় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এর আগের সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে অনেক বেশি ঋণ নিয়েছে। বিদেশ থেকে অনেক ঋণ নিয়েছে। এ বছর মূল্যস্ফীতির সঙ্গে আমাদের লড়াই করতে হবে। সরকার চাইলেই ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিতে পারবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপাতে পারবে না। রাজস্ব আদায়ের কোনো বিকল্প নেই। মূল্যস্ফীতির মধ্যে এই করের হার কিছুটা অসুবিধা করবে। কিন্তু এর কোনো বিকল্প নেই।
এসএম/এমএইচআর/এমএমএআর/জেআইএম