বই আলোচনা
অপেক্ষা: যে প্রতীক্ষা জীবন বাঁচিয়ে রাখে
হুমায়ূন আহমেদ বিংশ শতাব্দীর অন্যতম জনপ্রিয় নন্দিত কথাসাহিত্যিক। তাঁকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী অন্যতম শ্রেষ্ঠ জনপ্রিয় লেখক হিসেবে গণ্য করা হয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি উপন্যাসের মধ্যে ‘অপেক্ষা’ একটি। উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট একটি মধ্যবিত্ত পরিবারকে ঘিরে। উপন্যাসটিতে একইসাথে মধ্যবিত্তের টানাপোড়েন এবং প্রিয় মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার নিদর্শন ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। উপন্যাসটির মূল উপজীব্য ‘অপেক্ষা’। উপন্যাসের শুরুতে দেখা যায়, সুরাইয়া ও হাসানুজ্জামানের পাঁচ বছরের সন্তান ইমনকে নিয়ে সংসার ভালোই চলছিল। একটা সময় পর থেকে হাসানুজ্জামান আর বাড়িতে ফেরেনি। তার জন্য দীর্ঘ অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে সুরাইয়া। কিন্তু সপ্তাহ, মাস ও বছর পেরিয়ে গেলেও হাসানুজ্জামান আর ফিরে আসেনি।
সুরাইয়া একসময় তার ভাই জামিলুর রহমানের বাড়িতে চলে যায়। সুরাইয়ার দুই সন্তান ইমন ও সুপ্রভা বড় হয়ে স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করে। স্বামীকে হারিয়ে সুরাইয়ার মানসিক অবস্থা ভালো ছিল না। সে সব সময় খিটখিটে মেজাজে থাকতো। সামান্য কিছুতেই মনে জেদ চেপে বসতো। জেদের বশে তার মেয়ে সুপ্রভাকে কটু কথা শোনাতো। একসময় সুপ্রভা ক্ষোভ ও অভিমানে আত্মাহত্যা করে। মৃত্যুর পর জামিলুর রহমানসহ প্রত্যেকে তাকে স্বপ্ন দেখতো। জামিলুর রহমানের পছন্দের ছিল সুপ্রভা। তবে অপছন্দের ছিল তার ছেলেরা। তাদের বেপরোয়া চলাফেরার কারণে বাড়ি থেকে বের করে দেন। ছেলে শোভনের নামে থানায় মামলা হয়। একসময় তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। জেলখানায় তাকে দেখতে যেত ইমন। শোভনের ভবঘুরে জীবনের বাতাস লাগে ইমনের গায়ে। সেও শোভনের মতো হতে চায়। তবে শেষদিকে মামতো বোনের সাথে ইমনের বিয়ে হয়। পীর সাহেব বলেছিলেন, বিয়ের দিনই আসবে সুরাইয়ার স্বামী হাসানুজ্জামান। তবে কি আজ হাসানুজ্জামান ফিরে আসবে?
সুরাইয়া উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। প্রায়ই টেলিফোনে স্বামী হাসানুজ্জামানের সাথে কথা বলতে চাইতো। তবে সেটা সব সময় সম্ভব হতো না। একদিন সুরাইয়ার বমি বমি লাগছিল। তার শরীরজুড়ে আরও একজন মানুষ বসবাস করছে। সুসংবাদটি স্বামীর কানে দেওয়া হয়নি। সুরাইয়া ঠিক করলো, অফিস থেকে ফিরলে আজ রাতেই বলবে। তবে হাসানুজ্জামান আজ ফিরছে না কেন? সন্ধ্যা পেরিয়ে গভীর রাত হলেও তার কোনো খবর নেই। তার জন্য অপেক্ষার পাল্লা ভারী হতে থাকে। অফিস, হাসপাতাল, অলিগলি—সব জায়গায় তন্নতন্ন করে খোঁজা হয়েছে। তবুও কোনো হদিস মিলছে না। স্বামীর খোঁজ না পেয়ে সুরাইয়া কেমন জানি হয়ে গেছে। ঠিকমতো খাবার খায় না, কথা বলে না। সারাক্ষণ স্বামীর ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকে। এরই মধ্যে পৃথিবীতে সুপ্রভার আগমন ঘটে। নানা কারণে শহরের বাড়িতে আর থাকা হয়নি। সুরাইয়ার গন্তব্য তার ভাই জামিলুর রহমানের বাড়িতে। সুরাইয়া প্রায়ই ঘুমের মাঝে তার স্বামীর দেখা পেতো। সুপ্রভার অল্প বয়স থাকাবস্থায় কয়েক রাত পর পর দেখতো। এই বাড়িতে এসে মাঝেমধ্যে ভাবি ফাতেমার কটু কথা শুনতে হয়েছে। এসব কথা শুনে রাগে সে একবার বাসা থেকে বের হয়ে যায়। পরে অবশ্য ফাতেমা ক্ষমা চেয়েছে। তবে সুরাইয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই বাসা ত্যাগ করবে।
ইমন উপন্যাসের কেন্দ্রীয় নায়ক চরিত্র। শৈশবে ইমন একটু গম্ভীর প্রকৃতির ছিল। চাচা ফিরোজের সাথে সময় কাটাতো। তার কাছে সে গল্প শুনতো। তবে ফিরোজ তাকে মাঝখান থেকে গল্প শোনাতো। ইমন অনিচ্ছাসত্ত্বেও মায়ের সাথে মামা জামিলুর রহমানের বাড়িতে চলে আসে। ইমন খুবই মেধাবী ছাত্র। নিয়মিত পড়াশোনার সাথে টিউশনি করাতো। মামতো বোন মিতুর পাঠানো চিঠি দেখেই সে বুঝে যায়। টিউশনি পড়ানো নবনী ফোন দিলে মিতু রাগ করে। ইমন ব্যাপারটা বুঝেও না বোঝার ভান ধরে। মিতুকে ছেলেপক্ষ পছন্দ করলেও সে বিয়ে মিতু ভেঙে দেয়। ছেলেকে বলে দেয় ইমনের সাথেই হবে বিয়ে। শোভন জেল জীবন থেকে মুক্ত হওয়ার পর ইমন সঙ্গ দেয়। তার সঙ্গ পেয়ে ইমনের জীবনযাপন অগোছালো হয়ে যায়। তবে তার জীবন গোছাতে মিতুর আর্বিভাব হয়। মিতুর সাথে বসে বিয়ের পিঁড়িতে।
সুপ্রভা ইমনের বোন। তার বয়স তেরো। সে বান্ধবীর জন্মদিন উপলক্ষে মায়ের নীল শাড়ি পরেছে। কিন্তু মা কিছুতেই সুপ্রভাকে যেতে দেবে না। কারণ সে অঙ্কে মাত্র এগারো পেয়েছে। তার এত রংঢং করা মানায় না। জেদে সুরাইয়া সুপ্রভাকে চুলের মুঠি ধরে দেওয়ালে মাথা ঠুকে দেয়। এতে তার কপালের চামড়া কেটে গেল। সুপ্রভাকে দেখে মামা জামিলুর রহমান আঁৎকে উঠলো। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সুপ্রভা প্রায়ই তার মামার অফিসে কোক খেতে যায়। এজন্য সে অফিসে একটি ফ্রিজ কিনেছে। সুপ্রভা ফাইনাল পরীক্ষায় তিন সাবজেক্টে ফেল করেছে। প্রধান শিক্ষিকা তাকে প্রমোশন দেবে না। মা জানলে কী হবে! তবে মামা জামিলুর রহমান সব সমস্যার সমাধান করে দিলো। সমাধান করলেও মাকে সত্যিটা জানাতে হয়েছে। মা তীব্র ও তীক্ষ্ণ গলায় বলে, ‘ছাদ থেকে লাফ দিয়ে পড়ে আমাকে উদ্ধার কর।’ সুপ্রভা সত্যি সত্যি ছাদ থেকে লাফ দিলো। অল্পবয়সী সুপ্রভার অকাল প্রয়াণ হলো।
আরও পড়ুন
সায়েন্টিফিক বিযিনেস: বাঙালির মনস্তত্ত্ব
গাভী বিত্তান্ত: প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয়ের মনস্তাত্ত্বিক দলিল
ইমনের মামাতো বোন মিতু। সে ইমনের দুই মাসের ছোট। সব মানুষের বিচিত্র স্বভাব আছে। মিতু একা থাকলে মুখ টিপে হাসে। আশেপাশে কেউ থাকলেই সে গম্ভীর ভাব করে। তখন মনে হয় কাজ ছাড়া সব কিছুই তার অপছন্দ। মিতু ইমনকে চিঠি লেখে। চিঠির শেষে নামের জায়গায় লেখে—ইতি, হ্যানচব্যাক অব নটরডাম।
ফিরোজ ইমনের চাচা। সে ইমনকে খুব পছন্দ করে। ইমনের ছেলেবেলায় তাকে গল্প শোনাতো। তার ভাই হাসানুজ্জামান হারিয়ে যাওয়ার পর অনেক জায়গায় খুঁজেছে। প্রথমদিকে সে বেকার অবস্থায় থাকে। ইমনের দাদি মরে যাওয়ার পর সে বিদেশ চলে যায়। সেখান থেকে ইমনকে চিঠি লেখে। ফিরোজের বিদেশ চলে যাওয়ার বিষয়টি সুরাইয়া পছন্দ করেনি। সুরাইয়া বলে, ‘বাড়ি ঘর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া হচ্ছে তোদের বংশগত রোগ। তোর বাপ যেমন উধাও হয়েছে, তোর চাচাও তাই করেছে।’ বিদেশে একবার ফিরোজকে পুলিশ ধরে। সাজা হয় তিন বছর। ফিরোজ জেল থেকে বের হয়ে ইমনকে পুরো বিষয় জানিয়ে চিঠি লিখেছে। সাথে দুই ডলারের নোটও পাঠিয়েছে।
জামিলুর রহমান ইমনের মামা। সে পল্টনে একটি অফিসে চাকরি করে। তার তিন সন্তান। শোভন, টোকেন ও মিতু। সে সব সময় টাকা পয়সা ও সম্পদ বাড়ানোর চিন্তায় থাকতো। সন্তানদের তেমন একটা খোঁজ-খবর নিতো না। একসময় দুই ছেলেকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। ওসি সাহেব এসেছে, তার ছেলের বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়েছে। এসব নিয়ে জামিল সাহেবের তেমন মাথাব্যথা নেই। তার মধ্যে বাকিটা জীবন শান্তিতে কাটানোর প্রয়াস দেখা যায়।
নবনী দশম শ্রেণির ছাত্রী। ইমন নবনীর টিউশন মাস্টার। সপ্তাহে তিনদিন অঙ্ক করায়। নবনী প্রায়ই ইমনের খোঁজে বাসার টেলিফোনে কল দিতো। কিন্তু সেই ফোন ধরতো মিতু। তাদের মধ্যে অনেক কথা হতো। মিতু নবনীর বলা প্রয়োজনীয় কথার কিছুই ইমনকে জানাতো না। নবনী ইমনের সামনে সেজেগুজে বসে থাকতো। ইমনের জন্মদিনে গিফট দিতে চায়। নবনীর মনের কোণে ইমনকে পছন্দের আভাস পাওয়া যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইমন টিউশনিটা ছেড়ে দেয়।
এ ছাড়া অন্যান্য চরিত্র হলো—আকলিমা বেগম, শোভন ও টোকেন, ফাতেমা, পীর সাহেব, মুন্নী। অপেক্ষা উপন্যাসের কয়েকটি উক্তি—
>> অপেক্ষা ব্যাপারটা খুব জরুরি। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অপেক্ষা নামের ব্যাপারটি খুব প্রয়োজন। অপেক্ষা হচ্ছে মানুষের বেঁচে থাকার টনিক। যে মানুষ অপেক্ষা করতে জানে না, সে মানুষ খুব দ্রুত বার্নআউট হয়ে যায়।
>> খুব খারাপ সময়ের পরপরই খুব ভাল সময় আসে। এটা জগতের নিয়ম। পৃথিবীতে কেউ চিরকাল খারাপ সময় পার করে না। খারাপ সময়টা কেটে যায়।
>> ভালোবাসা হচ্ছে এক ধরনের মায়া। এই মায়ার বাঁধনে মানুষ একবার আটকা পড়লে আর মুক্তি নেই। মুক্ত হতে চাইলে শুধু কষ্ট বাড়ে।
>> হাসলে মেয়েদের যতো সুন্দর লাগে হাসি চেপে রাখলে তারচে দশগুণ বেশি সুন্দর লাগে। একটা চাপা হাসি দেখেই তো ছেলেরা পাগল হয়। সব সৌন্দর্য প্রকাশ করে দিলে তার রহস্য থাকে না।
>> কষ্ট পেতে হয়, তবেই না বোঝা যায় জীবন কাকে বলে। যে জীবনে কষ্ট নেই, সে জীবন নিস্তরঙ্গ, পানসে। কষ্টের স্বাদ না জানলে সুখের আনন্দও তেমন বোঝা যায় না।
উপন্যাসের সমাপ্তি হুমায়ূন আহমেদের নিজস্ব স্টাইলে লেখা। যখন ইমন আর মিতু বাসর ঘরে; তখন গভীর রাতে দরজায় বেল বাজে। হাসানুজ্জামান কি সত্যিই ফিরলেন? নাকি সুরাইয়ার বহু বছরের অপেক্ষা শেষ পর্যন্ত কেবল একটি স্বপ্নভঙ্গের আভাস! লেখক এখানে পাঠকের ওপরই সিদ্ধান্তের ভার চাপিয়ে দিয়েছেন। এই ধোঁয়াশা উপন্যাসের আবেদনকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। পাঠক নিজের জীবনবোধ ও অভিজ্ঞতার আলোকে গল্পের সমাপ্তি নির্মাণ করেন, যা এই উপন্যাসের একটি বড় শক্তি।
এসইউ