রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

যিনি সময়কে অতিক্রম করে অনন্তে বিরাজমান

জান্নাত শ্রাবণী
জান্নাত শ্রাবণী জান্নাত শ্রাবণী
প্রকাশিত: ০২:৪৪ পিএম, ০৭ মে ২০২৫

৭ মে শুধু একটি তারিখ নয়, এক আশ্চর্য আলোয় ভেসে যাওয়া একান্ত অনুভবের দিন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। এই দিনটি যেন বাঙালির সংস্কৃতি ও চেতনার একটি পূর্ণিমা। তিনি কেবল কবি ছিলেন না, ছিলেন এক মহাস্রষ্টা, যিনি কলম, কণ্ঠ, রঙ আর দর্শনের ছোঁয়ায় এক নতুন জগৎ নির্মাণ করেছিলেন। সময়ের সীমা অতিক্রম করে তিনি আজও প্রতিটি পাঠকের হৃদয়ে, প্রতিটি মঞ্চে, প্রতিটি গানে জীবন্ত।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ‘গুরুদেব’ বলা হয়, তার রচনায় আমরা কাঁদি, হাসি, প্রেমে পড়ি, আবার আত্মজিজ্ঞাসায় নিমজ্জিত হই; তিনি কি শুধুই অতীত? নাকি তিনি আমাদের প্রতিদিনের জীবনের সঙ্গী, একজন সময়াতীত পথপ্রদর্শক?

বিজ্ঞাপন

১৮৬১ সালের ৭ মে (২৫ বৈশাখ, ১২৬৮ বঙ্গাব্দ) কলকাতার এক সংস্কৃতিবান জমিদার পরিবারে তার জন্ম। বয়স যখন আট বছর, তখনই কাব্যচর্চা শুরু। এরপর একে একে নাটক, গান, প্রবন্ধ, ছোটগল্প, উপন্যাস, চিত্রকলা সব শাখাতেই নিজের সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। অথচ তাকে বেঁধে রাখা যায় না কেবল ‘সাহিত্যিক’ পরিচয়ে। তিনি নিজেই এক সাহিত্যের মহাকাব্য।

তিনি শুধু লিখেছেন না, বেঁধে দিয়েছেন এক নতুন দর্শন মানবিকতা, আত্মোপলব্ধি, প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতা, আত্মমর্যাদা এবং প্রেম। এই দর্শন সময়ের ধারায় আরও বেশি প্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে, যখন মানুষ যান্ত্রিক জীবনে নিজের আত্মাকে হারাতে বসেছে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেছিলেন, ‘জীবনকে যে ভালোবাসে, মৃত্যুকেও সে ভালোবাসে।’ এই গভীর জীবনদর্শন আমাদের শেখায়, ভয় নয়, সাহসের সঙ্গে বাঁচতে। তার গান আমাদের বলে প্রকৃতি, প্রেম ও পরিচ্ছন্ন আত্মচর্চার মাঝে জীবন খুঁজে নিতে। রবীন্দ্রনাথ আমাদের চোখ খুলে দেন নিজের ভেতরের দিকে তাকাতে। তার ‘গীতাঞ্জলি’ শুধুই ঈশ্বরের প্রতি প্রার্থনা নয়, বরং এক অন্তর্জগতের সাধনা। গানের কথায়, কবিতার ছন্দে, নাটকের চরিত্রে তিনি যেন প্রতিটি পাঠককে বলেন, ‘চেনো নিজেকে, দেখো নিজের মনের আলো-আঁধারি।’

আজকের দুনিয়ায় যখন মানসিক স্বাস্থ্য এক গভীর সংকট, তখন রবীন্দ্রনাথ আমাদের শোনান, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে।’ এই ‘একলা চলার’ আহ্বান কেবল নিঃসঙ্গতার স্বীকৃতি নয়, বরং আত্মবিশ্বাসের গান।

রবীন্দ্রনাথ কেবল কাব্যের জগতে বাস করতেন না। তিনি শিক্ষাকে দেখেছেন আত্মবিকাশের পথে। শান্তিনিকেতন গড়ে তুলে তিনি শিক্ষাকে প্রকৃতি, শিল্প ও জ্ঞানচর্চার সঙ্গে একসূত্রে গাঁথেন। তার শিক্ষাদর্শ এখনো আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থাকে ভাবায়; শিক্ষা কি কেবল পরীক্ষা পাশ করার জন্য, নাকি মানুষ হওয়ার জন্য?

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

তিনি বারবার বলেছেন, ‘যে শিক্ষা জীবনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে না, তা জীবনকে গড়ে তুলতে পারে না।’ এই কথাগুলো আজকের বইভিত্তিক, নম্বরনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন আলো ফেলতে পারে।

রবীন্দ্রনাথের গান যেন মানুষের হৃদয়ের নিজের ভাষা খুঁজে পাওয়া। প্রেমে, বিচ্ছেদে, মৃত্যুতে, উৎসবে; বাংলা জীবনের প্রতিটি আবেগে রবীন্দ্রসঙ্গীত রয়েছে এক অফুরন্ত আশ্রয়ের মতো। গানের কথায় যেমন গভীরতা, তেমনি সুরে মেলে এক মমতাময় আরাধনা, ‘পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কিরে হায়...’-এই গান শুধু স্মৃতিচারণ নয়, এক শাশ্বত আবেগ, যা সময় বদলালেও বদলায় না।

অনেকে ভাবেন, রবীন্দ্রনাথ বুঝি শুধু প্রৌঢ়দের জন্য, অথবা স্রেফ পরীক্ষার পাঠ্য। কিন্তু আধুনিক প্রজন্ম যতোই মোবাইল বা সোশ্যাল মিডিয়ায় ডুবে থাকুক, নিজের কোনো গহীন আবেগের কাছে গিয়ে ঠিকই খুঁজে পায় রবীন্দ্রনাথকে। তরুণদের হতাশা, আত্মসমালোচনা, আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলা সবকিছুর মাঝেই রবীন্দ্রনাথের লেখায় থাকে নির্ভরতার হাত। তার লেখা পড়ে আজও অনেক তরুণ প্রথম প্রেমে ডুবে যায়, আবার প্রথমবার জীবনকে সত্যি ভালোবাসতে শেখে।

বিজ্ঞাপন

একজন লেখক বা কবি কেবল তার সময়ের জন্য প্রাসঙ্গিক হলে, তাকে ‘ঐতিহাসিক’ বলা যায়। কিন্তু যিনি প্রজন্মের পর প্রজন্মকে নাড়িয়ে দেন, ভাবতে শেখান, তার অবস্থান সময়ের বাইরেও। রবীন্দ্রনাথ সেই বিরল ব্যতিক্রম; যিনি আজও যেমন জীবন্ত, আগামী শতাব্দীতেও তেমনি হবেন।

তার মৃত্যুদিনে তিনি নিজেই লিখেছিলেন, ‘মৃত্যু এসে গেছে ডেকে, বলে চলি, চলি...’, তবু মৃত্যু তাকে ছুঁতে পারেনি। তার লেখা, গান, দর্শন সবই জীবনের মতোই প্রবহমান।

রবীন্দ্রনাথ মানেই এক চিরন্তন আশ্রয়
এই ব্যস্ত, ক্লান্ত, প্রতিযোগিতাময় পৃথিবীতে রবীন্দ্রনাথ যেন এক চুপচাপ আশ্রয়ের ঘর। কখনো তার গানে কান্না পায়, কখনো আবার মনে হয় জীবনটা এতটা খারাপও নয়। তিনি আমাদের বিশ্বাস করান, মানুষ এখনো ভালোবাসতে পারে, অনুভব করতে পারে, স্বপ্ন দেখতে পারে।

বিজ্ঞাপন

জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন

তাই ৭ মে শুধুই একটি জন্মদিন নয়; এটি সেই দিন, যেদিন আমরা বারবার নিজের ভেতরের আলোটিকে খুঁজে পাই। রবীন্দ্রনাথ থাকেন আমাদের প্রতিটি হৃদয়ে, সুরে, চিন্তায়, যিনি সত্যিই সময়কে অতিক্রম করে অনন্তে বিরাজমান।

জেএস/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।