গাধা বলেই ভুল বুঝো না

একজন মানুষ যখন আরেকজনকে অপমান বা উপহাস করতে চায়, তখন সে বলে, ‘তুই আস্ত একটা গাধা!’ অথচ সেই গাধাই প্রায় ৪ হাজার বছর ধরে মানুষের বোঝা বইছে, মাটি টানছে, পাহাড় পেরোচ্ছে-কোনো প্রতিবাদ নেই, অভিযোগ নেই। শুধু ধৈর্য, সহনশীলতা আর দায়িত্ববোধের এক অন্যান্য উদাহরণ হয়ে রয়েছে। যে প্রাণী মানুষকে এমন নিঃস্বার্থভাবে সেবা দেয়, তার নামটাই আমরা করে ফেলেছি গালাগাল! ভাবা যায়?
প্রতিবছর ৮ মে পালিত হয় বিশ্ব গাধা দিবস। শুনলে হাসি পেতে পারে, কেউ কেউ ভেবে বসতে পারেন এ আবার কোনো দিবস হলো? কিন্তু একটু গভীরভাবে ভাবলে বুঝতে পারবেন, এই দিবসের প্রয়োজন কতখানি। কারণ পৃথিবীর বহু দেশে এখনো লাখ লাখ গাধা মানুষের জীবনের চাকা ঘোরাতে সাহায্য করছে।
মধ্য আফ্রিকার কোনো গ্রামে, কিংবা দক্ষিণ এশিয়ার কোনো পাহাড়ি পথঘাটে একমাত্র যাতায়াতের মাধ্যম হতে পারে একটি গাধা। তার পিঠে চড়ে স্কুলে যায় শিশু, বাজারে আসে চাল-ডাল, হাসপাতালের ওষুধ পৌঁছে যায় দূর কোন গ্রামে। মনে হয় যেন আধুনিককালের সেই ডেলিভারি বয় গাধা।
ইতিহাস বলে এই গাধারাই কিন্তু মিশরের পিরামিড তৈরির জন্য পাথর টেনেছে, রোমান সৈন্যদের যুদ্ধের রসদ বয়ে এনেছে। অথচ এই নিরীহ, কর্মঠ প্রাণীটি আজ বিলুপ্তির পথে।
গাধা সম্পর্কে আমাদের ভুল ধারণা গভীর। আমরা তাকে ভাবি নির্বোধ, অথচ গাধা একবার কোনো পথ চিনলে তা বছরের পর বছর মনে রাখতে পারে। গবেষণা বলে, গাধা একবার কোনো পথ দেখলে তা ২৫ বছর পর্যন্ত মনে রাখতে পারে। শুধু তাই না একটি গাধা মরু পরিবেশে ৬০ মাইল দূরে থেকে অন্য গাধার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারে। বিপদের সময় কেউ যখন মাথা গরম করে এগিয়ে যায়, গাধা তখন দাঁড়িয়ে যায়। কেউ ভাবে, বোকা বলে এগোয় না-আসলে ও জানে, এই পথে গেলে মরবে। গাধা নেকড়ে, বাঘ বা অন্য বন্য জন্তুদের উপস্তিতি বুঝতে পারে। তাদের হাত থেকে বাকি পশুদের রক্ষা করতে বিশেষ সংকেত দেয়। এছাড়া গাধা গবাদি পশু, ভেড়া ও ছাগলকে পাহারা দেয়।
সুতরাং গাধা বোকা নয়, বরং বাস্তজ্ঞানী। তার ধৈর্য, কম খেয়ে বেশি কাজ করার ক্ষমতা, আরেকটি গাধার সঙ্গে আজীবন সঙ্গী হয়ে থাকার মতো আনুগত্য-এসব গুণ মানুষের মধ্যেই বিরল।
বিশ্বজুড়ে আজ এই গাধাদের সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে চীনে গাধার চামড়া দিয়ে ‘ইজিয়াও’ নামের এক ধরনের ওষুধ তৈরি হয়, যাকে বলা হয় ‘ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা পদ্ধতি’। আর এই কারণে গাধা এখনো পাচারের শিকার হচ্ছে আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলো থেকে। কোটি কোটি গাধা আজ হুমকির মুখে। বিজ্ঞানী আর্ক রাজিক এই অবস্থা দেখে ২০১৮ সালে শুরু করেন বিশ্ব গাধা দিবস। উদ্দেশ্য এই নিরীহ প্রাণীর প্রতি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা।
বিশ্বের নানা দেশে এই দিবস উদযাপিত হয় রীতিমতো উৎসব করে। মেক্সিকোর ওটুম্বা শহরে হয় গাধা উৎসব, গাধা সাজিয়ে র্যালি, কনসার্ট, এমনকি গাধা দৌড় প্রতিযোগিতা! যুক্তরাজ্যে ‘দ্য ডাংকি স্যাঞ্চুয়ারি’ নামে একটি গাধা আশ্রয়কেন্দ্রে দিনভর চলে দর্শনার্থী ও শিশুরা নিয়ে বিশেষ আয়োজন। কেউ গাধার গল্প পড়ে, কেউ গাধাকে আঁকে, কেউ বা খেতে দেয় খাঁটি ঘাস! যুক্তরাষ্ট্রেও বিভিন্ন স্কুলে এ উপলক্ষে সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড চালানো হয়। কোথাও আবার গাধার সঙ্গে সময় কাটানো থেরাপি হিসেবেও বিবেচিত হয়। বিশেষ করে চাহিদাসম্পন্ন শিশুরা এতে আনন্দ পায়।
বাংলাদেশে এই দিবস তেমন পরিচিত না হলেও ইটভাটা, পাহাড়ি এলাকা কিংবা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এখনো কিছু গাধা মানুষের জীবিকার ব্যবস্থা করে দেয়। তবে বাংলাদেশে গাধার সঠিক সংখ্যা কত সে সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই। কাগজে কলমে শুধু চিড়িয়াখানাতেই কিছু গাধা রয়েছে।
গাধাদের না আছে কোনো চিকিৎসা, না বিশ্রাম, না সঠিক খাদ্য। অথচ একটুখানি যত্ন, ভালোবাসা, কিংবা মাত্র কিছু সচেতনতাই এই প্রাণীগুলোর জীবনকে অনেক বেশি সহনীয় করতে পারে। স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে শুধু ছবি আঁকানোর জন্য নয়, এই প্রাণীর ভূমিকা নিয়েও শিশুদের শিক্ষা দেওয়া উচিত। আমাদের মনে রাখা দরকার গাধা মানেই বোকা নয়, বরং পরিশ্রমী, ধৈর্যশীল, এবং আশ্চর্যরকম স্মার্ট এক প্রাণী।
একবার ভাবুন তো, গাধারা যদি আমাদের মতো মুখ ফুটে কথা বলতে পারত! হয়তো বলত, ‘আমি গাধা হয়েছি বলে তোমার বোঝা বই, তুমিই কি কখনো আমার কিছু বোঝো?’ আমাদের সমাজে এমন বহু গাধা রয়ে গেছে যারা কথা না বলে কেবল মাথা নিচু করে কাজ করে যায় জীবনে কখনো প্রশংসা পায় না, ভালোবাসাও না। এই বিশ্ব গাধা দিবসে অন্তত তাদের দিকে একবার তাকানো যাক। গালি নয়, কৃতজ্ঞতা হোক ‘গাধা’ শব্দের আসল মানে।
কেএসকে/এএসএম