মায়েরা পৃথিবীর সেরা ‘অর্থনীতিবিদ’

আমরা যখন অর্থনীতি পড়ি, তখন জিডিপি, বাজেট, খরচ বা বিনিয়োগ শব্দগুলো মুখস্থ করি। কিন্তু একটি শব্দ সেখানে অনুপস্থিত থাকে, তাহলো ‘মা’। অথচ পরিবারের ভিত গড়ার এই মানুষটির শ্রম, ত্যাগ আর অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া কোনো সমাজ টেকসই হতে পারে না।
মায়েরা কেবল সন্তান জন্ম দেন না, তারা গড়ে তোলেন একটি জাতিকে। আর এই গঠনের পেছনে আছে অগণন হিসাব, সমন্বয় আর এমন এক প্রজ্ঞা, যা দেখে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অর্থনীতিবিদরাও চমকে যান। আর এই অর্থনীতির অদৃশ্য অংশীদার মা।
অর্থনীতিবিদদের আলোচনায় ‘অদৃশ্য শ্রম’ শব্দটি এখন জায়গা করে নিয়েছে। অদৃশ্য শ্রম বলতে বোঝায় সেই কাজ, যার জন্য কেউ বেতন পান না, অথচ কাজগুলো ছাড়া সমাজ চলতে পারে না। রান্না, সন্তান পালন, বয়স্কদের দেখভাল, ঘর পরিচ্ছন্ন রাখা-এসব সবই এই অদৃশ্য শ্রমের অন্তর্ভুক্ত।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মতে, নারীরা বিশ্বের মোট ‘আন পেইড ওয়ার্ক’-এর প্রায় ৭৬ শতাংশ সম্পাদন করেন-আর এই কাজের বড় অংশটিই করেন মায়েরা।
স্যালারি ডট কমের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, যদি গৃহিণী মায়েদের গৃহকর্ম ও পরিবারের ব্যবস্থাপনা সময়কে পেশাগত শ্রম ধরে মজুরি হিসাব করা হয়, তাহলে বছরে তারা প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার ডলার মূল্যের কাজ করেন। ভাবা যায়? এই পরিমাণ অর্থনৈতিক মূল্য তারা সৃষ্টি করেন প্রতিদিন আমাদের চোখের সামনে, অথচ স্বীকৃতি পান না।
মা জানেন কাকে কখন কী প্রয়োজন। সংসারে যখন টানাটানি, তখন মা-ই ঠিক করেন কোনটায় কাটছাঁট করতে হবে, কার জন্য কী অগ্রাধিকার। বাজারে দাম বাড়লেও মা চাল, ডাল, তেল দিয়ে এমন এক তীক্ষ্ণ পরিকল্পনায় সংসার চালান, যেন তাতে কেউ অভুক্ত না থাকে। নিজের প্রয়োজন, স্বপ্ন, চাওয়া-সবই যেন তিনি সযত্নে তুলে রাখেন আমাদের মুখে হাসি ফোটাতে।
শুধু তাই না আমাদের মায়ের কাছে কোনো কিছু ফেলনা না। বাবা বাজার থেকে লাউ কিনে আনলে সেই লাউ দিয়ে তরকারি রান্না হয় আর লাউয়ের খোসা দিয়ে তৈরি হয় চমৎকার ভর্তা, তরমুজ কিনে আনলে তরমুজ খাওয়ার পরে এর বেচে যাওয়া খোসা দিয়ে মা রান্না করেন ভাজি, যা খেয়ে আমরা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলি। শুধু এগুলোই না ফেলনা বা ভাঙা বালতিতে মা ফলান বাহারি সবজি। যা দিয়ে সংসারের প্রয়োজন মেটে। এই যে জিনিসের চমৎকার বহুমুখী ও বহুমাত্রিক ব্যবহার এইটা মা ছাড়া আর কেইবা পারবে? এটাই মা-যিনি হিসাব করেন হৃদয় দিয়ে, সিদ্ধান্ত নেন ভালোবাসা দিয়ে।
আরেকটি উদাহরণ দেই তা হলো, রাজধানীর মিরপুরে বাস করা মমতাজ বেগম তিন সন্তানের মা। স্বামী দিনমজুর। সংসারে মাসে ১৫-১৬ হাজার টাকা আসে কোনোরকমে। সেই টাকায় চলতে হয় বাড়িভাড়া, খাবার, স্কুল ফি, ওষুধ, ঈদের কাপড়-সবকিছু।
বাড়ির কর্তার কাছে যখন জানতে চাইলাম, চাচা, এই টাকা দিয়ে সংসার চলে কেমনে? তখন তিনি হাসিমুখে উত্তর দিলেন, ‘আমি জানিনে বাবা, আমি জীবনেও পারতাম না এই টাকা দিয়ে সংসার চালাইতে। তোমার চাচি এই টাকা দিয়েই ক্যামনে ক্যামনে জানি সংসার চালায়। শুধু তাই না, মাসে এক হাজার টাকা সঞ্চয়ও করে’।
মমতাজ বেগম জানায়, ‘অভাবের সংসারে তেমন ভালো কিছু খেতে পারিনা, কিন্তু ওদের মুখে একটুকরো মাছ বা ডিম তুলে দিতে পারলেই মনে হয় আমি ধনী মা’।
মমতাজের মতো আরও লাখ লাখ মা আছেন-যারা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি পড়েননি, তারা জানেন না অর্থনীতির হালচাল অথচ জীবন থেকে শিখেছেন কীভাবে প্রতিদিন বাঁচিয়ে রাখা যায় স্বপ্ন, ভালোবাসা আর পরিবার।
আজ বিশ্ব মা দিবস। প্রতি বছরের মে মাসের দ্বিতীয় রোববারে পালিত হয় এ দিবস। এদিন সোশ্যাল মিডিয়া আমরা ভরিয়ে ফেলি মাকে নিয়ে বিভিন্ন লেখায়, শুভেচ্ছায়। কখনোতো মাকে জিজ্ঞাসা করা হয় না, মা তোমার কিছু লাগবে কি না, তোমার জন্য কি ভালো? কিংবা জিজ্ঞাস করলেও আমাদের মা হয়তো বলে ফেলেন-‘আমার কিছু লাগবে না।’ কিন্তু আমাদের উচিত আমাদের মায়ের জন্য একটা সেভিংস ফান্ড রাখা। যা দিয়ে হয়তো মায়ের মেডিকেল চেকআপসহ অন্যান্য সমস্যা সহজেই সমাধান করা যায়। এটাই হতে পারে মায়েদের জন্য সবচেয়ে বড় ‘মা দিবসের উপহার’।
কেএসকে/এএসএম