আয়ু শেষ হলে জাহাজের ভাগ্যে কী ঘটে জানেন?
জাহাজ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় যানগুলোর একটি। শত শত নাবিক, হাজার হাজার টন মাল বহন করে বছর বছর সমুদ্র চষে বেড়ায় তারা। কিন্তু মানুষের মতো এদেরও একদিন বয়স বাড়ে, শক্তি কমে যায়, আর শেষ পর্যন্ত শেষ হয়ে আসে তাদের ব্যবহারযোগ্য জীবন।
সাধারণত একটি সমুদ্রগামী জাহাজ ২৫-৩০ বছর পর্যন্ত অর্থনৈতিকভাবে কার্যকর থাকে। সময়ের সঙ্গে জাহাজের স্টিলের কাঠামো ক্ষয় হতে থাকে, মেশিনের কর্মক্ষমতা কমে যায় এবং রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ও দ্রুত বেড়ে যায়। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও পরিবেশবিষয়ক নিয়মাবলি ক্রমাগত হালনাগাদ হওয়ায় পুরোনো জাহাজ এগুলোর মান বজায় রাখতে পারে না। ফলে নির্দিষ্ট এক সময়ের পর জাহাজ মালিকদের কাছে আর এটি লাভজনক থাকে না এবং তখনই শুরু হয় জাহাজটির ‘শেষ অধ্যায়’।
জাহাজের অপারেশন বন্ধ করেই সেটিকে সরাসরি স্ক্র্যাপে পাঠানো হয় না। আগে শুরু হয় কয়েকটি আনুষ্ঠানিক ধাপ-আন্তর্জাতিক সেফটি ও সার্ভে রিপোর্ট, পরিবেশ ও বর্জ্য তালিকা প্রস্তুত, বিক্রির জন্য মূল্য নির্ধারণ। এগুলো শেষ হলে জাহাজ বিক্রি হয় শিপ-ব্রেকিং ইয়ার্ডে।
সাধারণত একটি সমুদ্রগামী জাহাজ ২৫-৩০ বছর পর্যন্ত অর্থনৈতিকভাবে কার্যকর থাকে
বাংলাদেশে পুরোনো জাহাজগুলোর বড় একটি অংশের শেষ গন্তব্য হয় চট্টগ্রামের শিপব্রেকিং ইয়ার্ডগুলো। মালিকেরা পুরোনো জাহাজ বিক্রি করে পাঠান এখানকার ইয়ার্ডগুলোতে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় জাহাজ ভাঙা শিল্পগুলোর একটি এখন বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে। এখানে সমুদ্র থেকে এনে জাহাজগুলো তীরে ওঠানো হয়। প্রথমে জাহাজকে কেটে ভেতরের জ্বালানি ও ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক অপসারণ করা হয়। এরপর ধাপে ধাপে কেটে ফেলা হয় পুরো জাহাজের কাঠামো। পুরোনো জাহাজের প্রতিটি যন্ত্রাংশ পুনব্যবহার করা হয়
ধীরে ধীরে অংশবিশেষ কেটে খুলে ফেলা হয়। এই শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখছে রড, প্লেটসহ বিভিন্ন ধরনের স্ক্র্যাপ স্টিলের বিশাল অংশ এখান থেকেই আসে। এসব ধাতু আবার নতুন জাহাজ, ভবন বা অবকাঠামো নির্মাণে, ইঞ্জিন ও যন্ত্রাংশ রিফার্বিশড মেশিনারি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশের লোহা-ইস্পাত খাতে এই স্টিল বড় একটি জোগান নিশ্চিত করে।
একই সঙ্গে জাহাজের ভেতরের যন্ত্রাংশ, আসবাব, বৈদ্যুতিক সামগ্রীও পুনর্ব্যবহার করা হয়। একটি বড় জাহাজের প্রায় ৯০-৯৫ শতাংশ অংশ পুনর্ব্যবহারযোগ্য। তাই বলা যায়, জাহাজ মারা যায় না, রূপ বদলে ফের কাজে ফিরে আসে। তবে নিরাপত্তা ও শ্রমমান নিশ্চিত করা এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, যা নিয়ে এরই মধ্যে নানা নীতি ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড প্রণয়ন করা হয়েছে।
পুরোনো জাহাজের প্রতিটি যন্ত্রাংশ পুনর্ব্যবহার করা হয়
এতে আছে পরিবেশ ও নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ। জাহাজে থাকে-অ্যাসবেস্টস, রাসায়নিক তেল, হেভি মেটাল। যথাযথ নিরাপত্তা ছাড়া এগুলো শ্রমিক ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই বর্তমানে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রীন সিপ-রিসাইক্লিং নীতিমালা অনুসরণের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে, বাংলাদেশেও যার প্রয়োগ ক্রমশ বাড়ছে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশেও পুরোনো জাহাজ ভাঙার প্রবণতা রয়েছে। ভারত, পাকিস্তান, তুরস্ক এসব দেশও জাহাজ পুনর্ব্যবহার শিল্পের বড় কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। উন্নত দেশগুলোতে কঠোর পরিবেশ ও শ্রম আইন থাকার কারণে অনেক সময় জাহাজ মালিকেরা উন্নয়নশীল দেশে জাহাজ পাঠাতে আগ্রহী হন।
আবার ইউরোপ ও জাপানের মতো কিছু দেশে পুরোনো জাহাজ সংরক্ষণ করে মিউজিয়াম বা পর্যটনকেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। কিছু জাহাজ ডুবিয়ে “কৃত্রিম প্রবাল প্রাচীর” তৈরি করা হয়, যা সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সহায়ক।
জাহাজের আয়ু শেষ হওয়া মানেই তার যাত্রার ইতি নয় বরং নতুন রূপে ফিরে আসার আরেকটি সুযোগ। এই শিল্প শুধু অর্থনীতিতে অবদান রাখছে না, শিল্পোন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তবে এর সঙ্গে পরিবেশ ও শ্রম নিরাপত্তাকে সমান গুরুত্ব দেওয়া এটাই এখন সবচেয়ে জরুরি।
আরও পড়ুন
সন্ধ্যা নামলেই পুরোনো ইলেকট্রনিক্স পণ্যের হাট বসে যেখানে
এয়ার অ্যাম্বুলেন্স কী, খরচ কেমন?
কেএসকে