১৫ টাকায় ম্যাগনেট মামার খিচুড়ি

তপ্ত দুপুর, মাথার ওপর সূর্য। ভ্যাপসা গরম, পেটে ক্ষুধা। এখন না খেলে শরীর চলবেই না। আশেপাশে খোঁজ করলাম, কোথায় খাওয়া যায়? খোঁজ করতেই দেখি বগুড়ার সাতমাথার ঐতিহ্যবাহী টেম্পল রোডে বিশাল পাতিল নিয়ে বসে আছেন একজন। তার মাথায় হ্যাট, চোখে চশমা। লম্বা ও পাতলা গড়ন। বয়স ৭০-৭৫ বছরের মধ্যেই হবে। তার সামনে দুটি বেঞ্চ। এখানে বসে হাতে প্লেট নিয়ে খেতে হয়। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, কোনো আভিজাত্যের বালাই নেই দোকানে। এখানে খেতে আসা সবাই প্রায় নিম্নবিত্ত।
বিশাল পাতিলের ভেতর ধোঁয়া ওঠা খিচুড়ি নাড়ছেন তিনি। পাশে ছোট একটি গামলায় বেগুন ভাজি, আলু ভর্তা, ডালের বড়া, চাটনি ও ডিম ভুনা। খাবার দেখেই লোভ হলো। এরই মধ্যে তিনি বলে উঠলেন, ‘বসেন মামা, খেয়ে যান একপ্লেট গরম খিচুড়ি। মাত্র ১৫ টাকা প্লেট, ম্যাগনেট মামার গরম খিচুড়ি।’ আমি তো অবাক! দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতির কালে মাত্র ১৫ টাকায় খিচুড়ি। এত কমে কীভাবে সম্ভব?
বেঞ্চে বসার সঙ্গে সঙ্গেই স্টিলের গ্লাসে করে হাত ধোয়ার পানি দিলেন। স্টিলের প্লেটে দিলেন খিচুড়ি। পরিমাণ ছিল মনমতো। এক প্লেটেই পেট ভরে যাবে। তিনি বললেন, ‘সাথে কী নিবেন? যা নিবেন দাম মাত্র ৫ টাকা আর ভুনা ডিম নিলে ১৫ টাকা।’ আমি ভুনা ডিমসহ সব আইটেমই নিলাম। খাওয়া শুরু করলাম। খেতে খেতে চলছে ম্যাগনেট মামার সঙ্গে আলাপ।
প্রথমেই জানতে চাইলাম, ‘মামা আপনার নাম ম্যাগনেট কেন?’ তিনি বললেন, ‘আসলে আমার নাম সোহরাব হোসেন। তবে এখানকার সবাই আমাকে ম্যাগনেট মামা নামেই চেনেন। আমি আগে বাসের কন্ডাক্টর ছিলাম। তখন বাসের ভাড়া আদায় করতাম। ওস্তাদ যখন যা বলতেন, তা একদম দ্রুতগতিতে করতাম। তখন থেকেই আমার নাম দিয়েছে ম্যাগনেট। এখন আসল নামে আমাকে কেউ চেনে না। সবাই ডাকে ম্যাগনেট মামা।’
জানতে চাইলাম, ‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতেও কীভাবে মাত্র ১৫ টাকায় খিচুড়ি বিক্রি করেন?’ ম্যাগনেট মামা বললেন, ‘দেখতেই তো পাচ্ছেন একদম রাস্তার ওপর আমার দোকান। কোনো ভাড়া দেওয়া লাগে না। কারেন্ট বিল নাই, কিচ্ছু নাই। বাড়িওয়ালী রান্না করে, আমি এনে বিক্রি করি। প্রথম যখন বিক্রি করি; তখন মাত্র ২ টাকা নিতাম। সেখান থেকে তিন টাকা, পাঁচ টাকা, সাত টাকা, দশ টাকা। এরপর ১৫ টাকা। দেখি কতদিন ১৫ টাকায় বিক্রি করতে পারি!’
ম্যাগনেট মামা প্রায় ৪০ বছর ধরে এখানে খিচুড়ি বিক্রি করেন। পারিপার্শ্বিক অবস্থা চিন্তা করলেও এ দাম যে খুব একটা বেশি, তা নয়। ম্যাগনেট মামা সকাল ৬টায় খিচুড়ির হাঁড়ি নিয়ে বসেন। দুপুর ২টা-৩টার মধ্যেই বিক্রি হয়ে যায় সব। দিনে প্রায় ২০ থেকে ২২ কেজি চালের খিচুড়ি রান্না করেন। এ অল্প সময়ে তিনি ৫-৬ হাজার টাকার খিচুড়ি বিক্রি করেন।
তার এ খিচুড়ির নিয়মিত ক্রেতা এখানকার রিকশাচালক, বাস ড্রাইভার, কন্ডাক্টর, কুলি, দিনমজুর, ভিক্ষুক এবং মেসের ছাত্ররা। এককথায় বলতে গেলে, একদম নিম্ন আয়ের মানুষই তার প্রধান ক্রেতা। ম্যাগনেট মামা জানান, এমনও লোক আছেন; যারা সকাল-দুপুর দুই বেলাই নাকি খিচুড়ি খান।
কথা বলতে বলতে আমার প্লেটের খিচুড়ি শেষ। মামাকে বললাম হাফ প্লেট খিচুড়ি দিতে। তিনি হাসিমুখে দিলেন। সেইসঙ্গে দিলেন চাটনি ও বেগুন ভাজা। বললাম, ‘মামা বেগুন ভাজা খুব মজা হয়েছে।’ বলতেই আরও দুটি বেগুন ভাজা দিয়ে বললেন, ‘খান মামা, এর জন্য আলাদা টাকা দিতে হবে না।’ এবার খেতে খেতে গল্প করলাম আমার পাশে খেতে বসা লোকদের সঙ্গে।
এখানে খেতে আসা এক বেদের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘আমরা মাঝে মাঝেই এখানে খাই, অল্প টাকায় খিচুড়ি। আমরা তো আর বড় বড় হোটেলে খেতে পারি না। এই কাকা এত অল্প টাকায় অনেক স্বাদের খিচুড়ি বিক্রি করেন। দিনশেষে মানুষের কাছে হাত পেতে যা টাকা পাই, তা থেকে পরিবারের জন্যও রাখতে হয়। তবে এটা বলতে পারি, বগুড়া শহরে এত অল্প টাকায় আর কোথাও খিচুড়ি পাওয়া যায় না।’
মেসে থাকা তৌহিদ হাসান পাপ্পু জানান, ‘যেদিন মেসে বুয়া আসে না; সেদিন আমি ম্যাগনেট মামার খিচুড়ি খাই। মাত্র ১৫ টাকার এক প্লেট খিচুড়ি খেলেই পেট ভরে যায়। আমার মতো অনেক মেস সদস্যই এখানে খেতে আসেন।’
ম্যাগনেট মামা বগুড়ার জামিল নগরে থাকেন। আসল বাড়ি পাবনার সুজানগর উপজেলায়। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি পাবনা থেকে বগুড়া আসেন। এখন পর্যন্ত বগুড়াতেই আছেন। যুদ্ধের আগে একটি জুট মিলে কাজ করতেন। তার বড় ভাই বগুড়ায় চলে এলে তিনিও আসেন। মাঝখানে কিছুদিন বাসের কন্ডাক্টরি করেন। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে এ খিচুড়ি বিক্রি করছেন। নিজে পড়াশোনা না করলেও পাঁচ সন্তানকে বড় করেছেন, শিক্ষিত করেছেন।
গল্প করতে করতে খাওয়া শেষ, হাত ধুয়ে নিলাম। এবার বিল দেওয়ার পালা। মামাকে বললাম, ‘মামা কত টাকা বিল?’ মামা হিসেব করে বললেন, ‘৫০ টাকা।’ আমার মনে হলো, এত অল্প টাকায় এত তৃপ্তি ভরে কোনোদিন খাইনি। একটি তৃপ্তির ঢেকুর তুলে চলে এলাম গন্তব্যে।
এসইউ/এএসএম