যে বয়সে জীবনের ঘানি টানছে রাজুরা

ফিচার ডেস্ক
ফিচার ডেস্ক ফিচার ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৪:১১ পিএম, ০৭ জুলাই ২০২৩
ছবি: মো. জিয়াউল হক জাহেদ

মো. আবু সালেহ মুসা

গল্পটা চা দিয়েই শুরু হোক। যদিও আমি চা পছন্দ করি না। তবে রাজু চা পছন্দ করে। রাজু হচ্ছে আমাদের আজকের গল্পের নায়ক। বয়স কত হবে, চৌদ্দ কিংবা পনেরো। যদিও বয়স অনুযায়ী তার বই-খাতা নিয়ে বিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা। বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা করার কথা। কিন্তু দরিদ্রতা তাকে কাজে নামিয়ে দিয়েছে। বেঁচে থাকার চেষ্টায় বোতল টোকাতে প্ল্যাস্টিকের বস্তা নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে হাট-বাজার কিংবা গ্রামে। বোতল টোকানোর টাকায় সংসারের হাল ধরা শিখতে হয়েছে কিশোর রাজুকে। রাজুর পরিবারে মাসহ এক ছোট ভাই আছে।

কলেজের বন্ধুদের নিয়ে মাঝে মাঝেই বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যেতাম। সঙ্গে যে দু’চারজন বন্ধু জুটিয়ে নিতাম। তারাও বেশ ভ্রমণপিপাসু। তাই আমাদের ঘুরতে যাওয়ার ভেতরে বিশেষ একটা আমেজ থাকতো। এবার গিয়েছিলাম চট্টগ্রামে। লক্ষ্য ছিল সেখানকার সবগুলো দর্শনীয় স্থানে ঘুরবো।

আমরা চট্টগ্রামের দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে শুরু করলাম। এর ফাঁকে একদিন বিকেলে সেখানকার রেল স্টেশনে যাই। সূর্যের তেজ কমে এলে নাকি এখানে ছবি ভালো আসে, তাই। এক এক করে সবাই ছবি তুললাম। এবার একটি গ্রুপ ছবি না তুললেই নয়। তখনই বিপত্তি। ছবি তুলে দেবে কে? আশপাশে তাকালাম। তেমন কাউকে দেখতে পেলাম না। দূরে একটা ছেলে বস্তা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। একজন তাকে ইশারায় ডাক দিলো। যদিও সে আমাদের দিকে তাকালো। তবে এগিয়ে এলো না। আবারও ডাকা হলো, আগের মতোই সাড়াশব্দ নেই।

আরও পড়ুন: অত্যধিক হর্নে শ্রবণশক্তি হারাচ্ছে শিশুরা

একটু খটকা লাগলো। সবাই মিলে একটি সেলফি তুলে তার কাছে গেলাম। সবার ভেতর কিছুটা ক্ষোভ। একটা ছবি তুলে দিলে কী এমন হতো? এটা জানতেই তার কাছে গেলাম। কাছে যেতে না যেতেই দৌড়ে পালালো। এবার আরও খটকা লাগলো। বাকিদের বললাম তাকে ধরে আনার জন্য। কিছুক্ষণ ওর পেছনে দৌড়ে অবশেষে ধরা গেল। একটু রাগ দেখিয়েই জিজ্ঞেস করলাম, ‘তখন ডাকলাম এলে না কেন? আমাদের দেখে দৌড়াচ্ছিলে কেন?’ খেয়াল করলাম সে ভয়ে কাঁপছে। বুঝতে বাকি নেই, কোনো না কোনো কারণে সে আমাদের দেখে ভয়ে পেয়েছে। কী সেই কারণ?

কারণ জানার আগে তাকে আশ্বস্ত করা দরকার, আমরা খারাপ কেউ নই। আমাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। খানিকটা বোঝানোর পর কিছুটা সফল হই। তার ভয় কিছুটা কমেছে, তবে পুরোপুরি নয়। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমাদের দেখে ভয় কেন পালাচ্ছিলে?’ আমাদের কথার উত্তর না দিয়ে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আমনেরা কি টিকটক করেন?’ বললাম, ‘না, আমরা টিকটক করি না। এখানে ঘুরতে এসেছি।’ এতে সে কিছুটা স্বস্তি পেল।

এবার আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলাম, ‘আচ্ছা, ব্যাপারটা কী হয়েছে একটু খুলে বলো তো।’ এবার সে বলতে শুরু করল। তার কথা অনুসারে- তার নাম রাজু। বাসা সেখান থেকে মোটামুটি দূরে। তবে প্রায়ই সেখানে বোতল টোকাতে আসে। কিন্তু যতবারই সেখানে এসেছে; ততবারই সমস্যার ভেতরে পড়েছে।

আরও পড়ুন: হাওয়াই মিঠাইয়ের একাল-সেকাল

তার কথায় বুঝলাম, এখানে প্রায় সময় টিকটকাররা ভিডিও বানাতে আসে। তখন তাকে দিয়ে নানা কাজ করায়। তবে বিনা পারিশ্রমিকে। যদি সে না বলে; তবে নানাভাবে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। বয়স বেশি না হওয়ায় এসব ঘটনায় বেশ ভয় পেয়ে যায়। তবুও কাজের তাগিদে এসব জায়গায় আসতে হয়। তাই এসব এলাকায় কাউকে দেখলে সে ভাবে, এরাও টিকটকার। এসব ভেবেই আমাদোর দেখে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেছিল।

আমরা তাকে সম্পূর্ণভাবে আশ্বস্ত করি, আমরা কোনো টিকটকার নই। আমরা এখানে ঘুরতে এসেছি। রাজুর বাবা নেই। আছে মা ও এক ছোট ভাই। মা ঘর সামলান। তাই রাজুকেই বাইরে আসতে হয়। সে বোতল কুড়িয়ে যে টাকা পায়, তা দিয়ে সবার জীবন চলে। যদি কোনোদিন বোতল বিক্রি না হয়; সেদিন উপোস করতে হয় সবাইকে।

রাজুরাও ভালোভাবে বাঁচতে চায়। তাদেরও শখ আছে। হয়তো বোতল কুড়াতে গিয়ে সেই শখ-আহ্লাদকে বিসর্জন দিতে হয়েছে। তবুও তারা একটি ভালো দিনের অপেক্ষা করে। তারাও সুন্দর একটা জীবনে ফিরতে চায়। ব্যাগে বই নিয়ে ফিরতে চায় স্কুলে।আসুন এমন রাজুদের স্বপ্নপূরণের সাথী হই।

লেখক: ফ্রিল্যান্স ফিচার রাইটার।

এসইউ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।