কাঠঠোকরার পরিত্যক্ত বাসায় আশ্রয় খোঁজে তারা
পাখির অপরূপ সৌন্দর্যের মাঝে হারিয়ে যায়নি এমন মানুষের সংখ্যা নেহাতি কম। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে পাখিদের কিচিরমিচির, স্বচ্ছ আকাশে ডানা ঝাপটে উড়ে বেড়ানো, দেশ থেকে দেশান্তর ঘুরে বেড়ানোর দৃশ্য যে কাউকেই পাখিদের প্রতি আকৃষ্ট করবে। এমনি একটি দৃষ্টিনন্দন পাখি বড় বসন্ত বৌরি।
বড় বসন্ত বৌরিকে অনেকে বড় বসন্ত বাউরি বা ধনিয়া পাখি নামেও ডাকে। এরা বাংলাদেশের স্থায়ী বাসিন্দা। গাছের নরম কাণ্ড খুঁজে সেখানে গর্ত করে থাকার ঘর বানায়। আবার সেই ঘরে আশ্রয় দেয় বাদুড় ও কাঠবিড়ালির মতো প্রাণীকেও। তবে বাসার স্থান নির্বাচন করতে এরা ৩-৫ দিন সময় নেয়।
বাংলাদেশে ৫ প্রকার বসন্ত বৌরি আছে। এরা হলো নীলগলা বসন্ত, নীলকান বসন্ত, সেকরা বসন্ত, দাগি বসন্ত এবং বড় বসন্ত। এদের মধ্যে নীলগলা বসন্ত বৌরি সবচেয়ে বেশি সুন্দর। বাংলাদেশের রেইন ফরেস্ট খ্যাত লাউয়াছড়ায় নীলগলা বসন্ত বৌরি বেশি চোখে পড়ে। এদের পছন্দের খাবার বটফল। তবে কদম, দেবদারু, ডেউয়া, আম, কলা, তেলাকুচা ও ছোট ছোট পোকামাকড়ও খেয়ে থাকে।
আরও পড়ুন: বুড়িগঙ্গা: ভেনিসের সঙ্গে যার তুলনা করতেন ইউরোপীয়রা
বসন্তে বড় বসন্ত বৌরির আনাগোনা ও কিচিরমিচির বেশি শোনা যায় । বড় বসন্ত বৌরি বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত , ভুটান , নেপাল, মিয়ানমার, থাইল্যান্ডের বনাঞ্চলে বাস করে।
এটির ইংরেজি নাম ‘ব্লু থ্রোটেড বারবেট’। বৈজ্ঞানিক ভাষায় একে সাইলোপোজন লিনেটাস বলা হয়। এরা মেগালাইমিডি গোত্রের অন্তর্ভূক্ত দক্ষিণ ও দক্ষিণ এশিয়ার একই প্রজাতির পাখি।
এরা গাছের ডালে বসে কুটুর-কুটুর-কুটুর করে তিনবার থেমে থেমে ডাকে। এভাবে থেমে থেমে অনেক সময় ধরে ডাকে। শব্দও বেশ তীক্ষ। এদের গলার আওয়াজ অনেক দূর থেকেও শোনা যায়।
বড় বসন্ত বৌরির মুখাবয়ব, গলা ও বুকের উপরের দিক গাঢ় আসমানী নীল। বাকি সারা সবুজ। লাল মাথার উপরে চূড়া বরাবর হলুদ ও কালো পরপর দুটি পট্টি। বুকের দুইপাশে একটি করে রক্তের মতো লাল ছোপ। ঠোঁটের সামনের অর্ধেক কালো, বাকি অংশ নীলাভ নাহয় নীলের উপরে হলুদের আভা। পা ধূসর বা পাটকিলে বর্ণের। চোখের তারা লালচে। চোখের চারিদিকে লাল পট্টি বিশিষ্ট চামড়া দেখা যায়। লেজের তলার অংশে ফিকে নীল। স্ত্রী ও পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। তবে কম বয়সের বড় বসন্ত বৌরির চেহারায় বয়স্কদের লাল-নীলের চাকচিক্য থাকে না। এদের দৈর্ঘ্য ২৫ সেন্টিমিটারের মতো।
বড় বসন্ত বৌরি সাধারণত ছোট ছোট দলে থাকে। তবে অনেক সময় ৩০-৪০ জনের বড় বড় দলেও এদের দেখা যায়। সাধারণত শীতকালে এবং বড় কোন খাদ্যের উৎসকে কেন্দ্র করে এরা বড় দল গঠন করে।
পাখিটির প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে জুলাই। তাই এই সময়ের মধ্যে বাসা তৈরির কাজ শেষ করে তারা। কাঠঠোকরার মতো গাছের গায়ে ছোট গর্ত করে এরা বাসা বাঁধে। কখনো কাঠ ঠোকরার পরিত্যক্ত বাসাও ব্যবহার করে। তারপর স্ত্রী পাখি ২-৩টি সাদা বর্ণের ডিম পাড়ে। এরপর ডিম ফুটে বাচ্চা না হওয়া পর্যন্ত বাবা-মা পাখি পালাক্রমে সেটিতে তা দেয়।
আরও পড়ুন: ৭ দিন কফিনবন্দি হয়ে কবরে কাটালেন তিনি
এরপর ডিম ফুটে বাচ্চা বের হলে স্ত্রী-পুরুষ পাখি বাচ্চাদের সমান যত্ন নেয়। দুজনেই পালাক্রমে ছানাদের জন্য ফল ও পোকামাকড় বাসায় নিয়ে আসে। এরপর মাসখানেকের মাঝে ছানারা উড়তে শিখে গেলে একে একে বাসা ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়।
পরিবেশবিদদের মতে, ফলাহারি বসন্ত বৌরি কয়েক দশক ধরে আগের তুলনায় কমে গেছে। এর কারণ হিসেবে ধরা যায় অত্যাধিক পরিমাণে বনাঞ্চল ধ্বংস করা। এছাড়াও বিভিন্ন টাওয়ারের অত্যাধিক রেডিয়েশন এই পাখির অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ।
কেএসকে/এএসএম