বাবাকে বেশি অনুভব করেছি, নিজে বাবা হওয়ার পর

ফিচার ডেস্ক
ফিচার ডেস্ক ফিচার ডেস্ক
প্রকাশিত: ১১:২৯ এএম, ১৬ জুন ২০২৪
বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝলাম বাবা এক বটবৃক্ষ

অলোক আচার্য

ওপার বাংলার প্রখ্যাত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘বাবা’ শিরোনামে একটা কবিতা আছে। কবিতাটির অংশবিশেষ হলো- ‘বাবা বললেন/ অন্ধকারে একটুখানি দাঁড়িয়ে থাক আমার জন্য/ মাটির তলার একটা সুরঙ্গে নেমে গেলেন খুব আস্তে আস্তে/ আকাশে প্রান্ত নির্ণয় ভুল করে ছুটে গেল একটা উল্কা/

বন্দরে একটাও জাহাজ নেই, রাস্তাগুলো দুলে ওঠে/ কী যে হল/ বুঝতে বুঝতেই কেটে গেল আরও উনিশটা বছর/এর মধ্যে কত হুড়োহুড়ি, কত মধুলোভীদের সঙ্গে ঘুরপাক/ বাবা, বাবা/ বোতাম বোতাম মাশরুম খুব ইচ্ছে করে বাবাকে খাওয়াতে/ আর রুমালি রুটি...........’ আরও অনেক আবেগ দিয়ে লেখা একটা কবিতা।

বাবা মানে একটি শব্দ, একটি ভরসা অথবা একটি আদর্শ। বাবা মানে শব্দের থেকেও বেশি কিছু। বুক দিয়ে আগলে রাখা একটি ভরসার জায়গা হলো বাবা। যদিও সবাই আদর্শ বাবা হতে পারেন না, কিন্তু বাবা হন ঠিকই। সন্তান আজও বড় হয় বাবার বুকে। একদিন দু’দিন করে বাবার বুকেই কেটে যায় শৈশবের কয়েকটি বছর।

আজ যেভাবে আমার সন্তানকে রাতে বুকের ওপর শুইয়ে রাখি, একদিন আমার বাবাও তার বুকের ওপর আমাকে ঘুমিয়ে রাখতেন। বাবারা এভাবেই সব সহ্য করে। বুকে সন্তান আর মাথায় সংসারের বোঝা বহন করেন বাবা। কোনোদিন সন্তান বোঝা না হলেও ঠিকই অনেক বাবা একদিন সন্তানের কাছে বোঝা হয়! কেউ কেউ তাদের ছুঁড়ে ফেলে রাস্তায়!

আমার বাবাকে আমি বহুভাবে দেখেছি। আমার শিশুবেলায় বাবার কাঁধে চড়ে যখন পৃথিবীটাকে দেখতাম তখন বাবা ছিল একরকম। বুঝতাম, বাবাদের কাঁধ আমার আশ্রয়। বিকেল হলেই কাঁধে চড়ে মাঠে যেতাম। যখন শিশুকাল পেরিয়ে আমি মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়াই কৈশরের রঙিন জগতে বাবা তখন আমার হিরো। আমি বাবাকেই অনুসরণ করতাম।

আর আমার বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝলাম বাবা এক বটবৃক্ষ। শুধু বটবৃক্ষ নন, বাবা এক মেশিন। টাকা দরকার, পাচ্ছি। খাবার দরকার বাবা বাজার থেকে আনছেন। সত্যি বলতে জীবনে যে নিশ্চিন্ত কয়েকটি বছর তা কেবল বাবা-মা জীবিত থাকাকালীন শৈশব আর কৈশরের দিনগুলো। তারপর থেকে সব ফ্যাকাশে হতে থাকে।

সংসারের বাবাকে আমি বেশি অনুভব করেছি আমি নিজে বাবা হওয়ার পর। বাবাকে নিয়ে যেসব প্রশ্নের উত্তর আমি যৌবনে পাইনি, সেসবের উত্তর পেয়েছি আমি বাবা হওয়ার পর। বাবা যে সংসারের একটি বটগাছ তখন আমি আস্তে আস্তে বুঝতে শুরু করি।

আমাদের সমাজে যখন মাতৃত্বের জয়গান, সেখানে কমই বন্দনা হয় পিতৃত্বের, এ দোষ সমাজের নয়। আমাদের দৃষ্টিতে। এই দৃষ্টিভঙ্গির সূত্রপাত সংসারেই। পরিশ্রান্ত সংসারের বাবার সঙ্গে তার আদরের সন্তানদের দেখা হয় কমই। আহারের যোগান দিতেই কেটে যায় দিন-রাত।

একটি কোনোমতে টানা সংসার সন্তান নিয়ে মা যখন কষ্ট করেন, তখন সেটা চোখে পরে সবার কিন্তু পেছন থেকে পুরো পরিবারের জন্য অবিশ্রান্ত খেটে যান শুধু সংসারের বাবা। আমার শৈশবের দেখা বাবা তখন বদলে যায়। আমি তখন বাবাকে বুঝতে শিখি। আমি বুঝতে পারি কেন বাবার কাছে চাইলেই কোনো জিনিস সহজে পাই না।

একসময় ভাবতাম হয়তো বাবা ইচ্ছে করেই দেন না। পরে বুঝলাম, এর জন্যও বাবার চোখের পানি ঝরে। এই বাবার হাত ধরেই আমার স্কুল জীবনের সঙ্গে পরিচয়, আমার প্রথম বাইরের জগতে পা রাখা। যখন আমি আমার সন্তানের চাহিদার যোগান দিতে পারতাম না, তখন বাবার মুখটা মনে পরতো।

আরও পড়ুন

বাবাও হয়তো দিতে না পারার কষ্টে বিঁধতো। আমি ভাবতাম বাবা চাইলেই পারেন। বাবার ঘামে ভেজা শার্টের প্রতি বিরক্ত ছিলাম। বছর কেটে যেত এক জোড়া শার্ট আর প্যান্ট দিয়ে। জুতা জোড়া কেটে যেত বছরের পর বছর। কোনোদিন দেখিনি একটু বিলাসিতা করে সময় কাটানো।

ভাবতাম, বাবারা মনে হয় এতোই ব্যস্ত হয়। তবে বুঝতাম না সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কেন বাবা ব্যস্ত থাকেন? আজ জানি, মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবারা কোনোদিনই অবকাশ পান না। পরিবারের সদস্যদের চিন্তা করতে করতেই দিন-রাত এক হয়ে যায়।

এই যে আজ কত বাবাদের দেখা পাওয়া যায় দেশের বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে, এসব কেন হয়েছে? আইন করে বাবা-মাকে সন্তানদের কাছে রাখতে বাধ্য করতে হবে। যখন দেখি সম্পত্তি ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্বে বাবার লাশটা পর্যন্ত কবর দিতে আটকে রাখা হয়েছে, তখন মনে হয় বাবার ছোট্ট ওই বুকটা যে বড় জমিন ছিল সেখানে তো সবার ঠাঁই ছিল। আজ তবে কেন এই পরিহাস!

একবার অবশ্য অবসরের সময় পায়, আমার বাবাও পেয়েছিল। যেদিন আমার বাবার দেহটা নিথর নিস্তব্ধ হয়ে গেলো, সেদিন আর বাবার কোনো ব্যস্ততা দেখলাম না। আমার মধ্যবিত্ত বাবার তখন আর কোনো তাড়া নেই! নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। সংসারের সব ভার তিনি তখন ছেড়ে দিয়েছেন আমার উপর।

আমরা ভুলেই যাই যে, আমরা বড় হতে হতে বাবাদেরও বয়স বাড়ে, তারা বার্ধক্যে পৌঁছান। তখন তারাও একেকজন শিশু হয়ে ওঠেন। তাদের প্রয়োজন হয় আলাদা যত্নের, যেমনটি তারা আমাদের ছোটবেলায় পালন করতেন। ঠিক এই সময়টায় আমরা বাবা-মার কাছ থেকে দূরে সরে আসি।

সবাই নন, তবে অধিকাংশই। সারাদিনের ব্যস্ততা আর বউ-সন্তানদের নানামুখী আবদার যেন মাথার উপর চাপ হয়ে থাকে। বাবা-মা সব বোঝেন। চুপচাপ দূরেই থাকেন। তবে তাদের এই একাকিত্ব ভাব দূর করাটাও আমাদেরই কর্তব্য। এ সময়টা যেন আমরা তাদের একা করে না রাখি।

এই আমি এতদিন বাবার উপর নিশ্চিন্ত ছিলাম। মধ্যবিত্ত সংসার আমাকে স্পর্শ করেনি। অথচ মানুষটাকে আমি কোনোদিন নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পর্যন্ত দেখিনি। ঘুমের ভেতরেও কি যেন ভাবতেন! আমি জানি বাবা সংসারের কথা ভাবতেন। পরদিন কি দিয়ে চলবে সেই কথা ভাবতেন। মধ্যবিত্ত বাবাদের এ কথা ভাবতে হয়।

প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত আমি বাবাকে সংগ্রাম করতে দেখেছি। আমি নিজেও এখন বাবার মতো হয়ে গেছি। এক শার্ট গায়েই মাসের পর মাস কেটে যায়। আর নতুন জুতা তো কয়েক বছর। আমিও পরের দিনের কথা ভাবি। আর রাত একটু গভীর হলে মাথা নিচু করে বাড়ি ফিরি।

এভাবে বহু বাবা রাতে ব্যর্থতার বোঝা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে, সন্তানের চাহিদা পূরণ করতে না পারায় নিরব থাকে। রাতের আকাশের নিচে দাড়িয়ে কোটি কোটি নক্ষত্রের মাঝে বাবাকে খুঁজি। বাবাকে কিছু কথা বলতে চাই। বলতে চাই, বাবা আমি ধীরে ধীরে তোমার মতো হয়ে গেছি। একদিন ঠিক তোমার কাছেই চলে আসবো।

বাবাকে এখন সবচেয়ে বেশি মিস করি। তখন বাবার সম্পর্কে যে ধারণাগুলো ছিল এখন তা পাল্টেছে। জানি, একদিন আমিও বাবার মতো থেমে যাবো। সব বাবাদেরই থেমে যেতে হয়। আবার সব বাবাই বেঁচে থাকেন সন্তানের বুকে। কবির ভাষায়, ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুদের অন্তরে। আমার বুকেও ঘুমিয়ে আছে বাবা, বড় শান্তির ঘুম।’

লেখক- প্রাবন্ধিক

জেএমএস/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।