গ্রামবাংলার ম্লান হওয়া মুখচ্ছবি

তথ্যপ্রযুক্তি ডেস্ক
তথ্যপ্রযুক্তি ডেস্ক তথ্যপ্রযুক্তি ডেস্ক
প্রকাশিত: ০২:৩৭ পিএম, ০১ জুলাই ২০২৫

তানজিদ শুভ্র

একটা সময় ছিল, যখন সন্ধ্যা নামলেই বাংলার প্রতিটি ঘরে আলো জ্বলত হারিকেনের। আবার রাতের নিঃশব্দতা ভেঙে কিংবা কাকডাকা ভোর হতেই উঠানে কটকটে শব্দ তুলে চাল ভাঙত ঢেঁকি। বিদ্যুৎ ছিল না, আধুনিক যন্ত্রও না। ছিল মাটির ঘর, ধানের গোলা, হারিকেনের আলো আর ঢেঁকির ছন্দে জেগে ওঠা এক জীবন্ত গ্রামবাংলা।

হারিকেন: আলো জ্বালানো স্মৃতির বাতি

হারিকেন ছিল কেরোসিনচালিত কাঁচঘেরা বাতি। নিচে তেলের পাত্র, তার উপর সলতা বসানো হতো। আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হলে, কাঁচের চিমনির মধ্যে আটকে রাখা হতো সেই শিখা যাতে বাতাসে নিভে না যায়। বাতির শিখা ছোট-বড় করা যেত। কেউ ঝুলিয়ে রাখত, কেউ হাতে নিয়ে হাঁটত।

সন্ধ্যা পড়লেই শুরু হতো হারিকেন পরিষ্কারের প্রস্তুতি। কাঁচ মুছে তেল ভরা, সলতা ঠিক করা শিশুরা এই কাজে আনন্দ পেত, দায়িত্ব নিয়ে করত। পড়ার টেবিলে, রান্নাঘরে, বারান্দার গল্পে হারিকেন ছিল নীরব সঙ্গী। ঝড়বৃষ্টি হলে তো হারিকেন ছাড়া উপায়ই ছিল না।

তখনকার ডাকপিয়নদের হাতে যেমন চিঠির থলি থাকত, তেমনি থাকত হারিকেন। এমনকি ডাক বিভাগের প্রতীকেও আজও আছে সেই প্রতিচ্ছবি। কিন্তু সময় বদলেছে। এখন চার্জার লাইট, ফ্ল্যাশলাইট, সোলার ল্যাম্পের যুগে হারিকেন কেবলই স্মৃতি। কেউ কেউ এখনো স্মারক হিসেবে রেখে দেয়, কেউ রেস্তোরাঁয় সাজসজ্জায় ব্যবহার করে। পুরোনো হারিকেনের জায়গা এখন শুধুই স্মৃতির মঞ্চে।

ঢেঁকি: নারীর শ্রম আর সমাজের ছন্দ

একইভাবে ঢেঁকিও একসময় গ্রামীণ জীবনের অপরিহার্য অংশ ছিল। সব কাজ শেষ করে রাতে কিংবা ভোর হলে গৃহস্থবাড়ির উঠানে কিংবা আলাদা ঘরে নারীরা জড়ো হতেন ঢেঁকির পাশে। কাঠের ভারী এই যন্ত্রটি লিভারের নীতিতে কাজ করত, পা দিয়ে চাপ দিলে ঢেঁকির অন্য প্রান্ত উপরে উঠে ধান ভাঙত।

এই কাজ ছিল কঠিন, তবে ছন্দবদ্ধ। একটানা চালালে হাত আটকে যাওয়ার ভয় থাকত, তাই একসঙ্গে কয়েকজন নারীর দরকার হতো। কেউ চালাতেন, কেউ ধান দিতেন, কেউ চাল ছেঁকে নিতেন। আর এই সময়েই চলত গান, গল্প, হাসি।

ঢেঁকি ছিল নারীর পরিণত হবার ঘোষণার এক মাধ্যমও। ‘আমার মেয়ে ঢেঁকি চালায়’ এই কথা ছিল গর্বের। উৎসবের আগে, বিশেষ করে পিঠার মৌসুমে ঢেঁকি চালানোর ধুম পড়ে যেত।

কিন্তু আধুনিকতার স্রোতে এখন ঢেঁকি প্রায় হারিয়ে গেছে। মেশিন এসেছে, কাজ সহজ হয়েছে। তবু হারিয়ে গেছে সেই সম্মিলিত সামাজিকতা, নারীর আত্মনির্ভরতার ঘরোয়া মঞ্চ। আজকের প্রজন্ম জানেও না ঢেঁকি দেখতে কেমন ছিল।

মুছে যাওয়া নয়, স্মরণে রাখাই শেকড়ের চিহ্ন

হারিকেন আর ঢেঁকি, দু'টি জিনিসই ছিল গ্রামীণ জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। একটিতে আলো জ্বলত, অন্যটিতে জেগে উঠত রুটি-রুজির প্রস্তুতি। কিন্তু দুটোই এখন কালের গর্ভে হারাতে বসেছে। আমরা যারা এই সবের প্রত্যক্ষ সাক্ষী নই, তাদের জন্যই দরকার এসব গল্প বলা। প্রয়োজন হারিয়ে যাওয়া এই উপকরণগুলোকে জাদুঘরে রাখা, পাঠ্যবইয়ে স্থান দেওয়া, লোকসাহিত্যে সংরক্ষণ করা। হয়তো জীবনে আর ব্যবহার হবে না, কিন্তু স্মৃতিতে জায়গা করে নিক তারা যেখানে শেকড়ের ঘ্রাণ এখনো টিকে আছে।

কেএসকে/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।