ইনসুলিন ব্যবহারের শত বছর

ইনসুলিনের নাম শোনেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। বর্তমানে ডায়াবেটিস একটি সাধারণ রোগে পরিণত হয়েছে। ডায়াবেটিস চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ ইনসুলিন। বিশ্বে প্রায় ৯০ লাখ টাইপ-১ ডায়াবেটিস রোগী আছে। টাইপ-২ ডায়াবেটিস আছে প্রায় ছয় কোটি মানুষের। তাদের কিডনি ও দৃষ্টিশক্তি ঠিক রাখতে ইনসুলিনের বড় ভূমিকা রয়েছে।
তবে জানেন কি? ইনসুলিনের আবিষ্কার হয়েছিল ডায়াবেটিস রোগ আবিষ্কারের অনেক পরে। খ্রিস্টপূর্ব ৫৫২ সাল থেকে ডায়াবেটিসের কথা জানতো মানুষ। এমনকি মিশরের বিভিন্ন মমির গবেষণায় জানা যায় তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন। অর্থাৎ সারাবিশ্বেই ছিল এই রোগেই বিস্তার।
তবে তখনকার দিনে ডায়বেটিস রোগীরা এক থেকে দুই বছরের বেশি বাঁচতো না। মৃত্যুর হার ছিল শতভাগ। কারণ এই রোগের কোনো প্রতিকার জানা ছিলো না। সবচেয়ে কার্যকর চিকিৎসা ছিলো কঠিন ডায়েট। সারাদিনে মাত্র ৪৫০ কিলো ক্যালোরি। সারাদিনে মাত্র এক স্লাইস পিজ্জা বা দুটি চিকেন ফ্রাই খেতেন ইউরোপ আমেরিকার মানুষ। ফলে খুব বেশি দিন বাঁচতেন না তারা। একে তো ডায়াবেটিসে শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতি হচ্ছে সেই সঙ্গে পুষ্টির অভাব। হাসপাতালগুলো ভরে থাকতো মৃত্যুপথযাত্রী ডায়বেটিস রোগী দিয়ে।
১৯২২ সালে ফ্রেডেরিক ব্যান্টিং এবং চার্লস বেস্ট নামের দুই বিজ্ঞানী আবিষ্কার করেছিলেন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের একমাত্র ওষুধ ইনসুলিন। এজন্য ১৯২৩ সালে ফ্রেডেরিক ব্যান্টিং ও জন ম্যাকলেয়ড চিকিৎসা ক্ষেত্রে নোবেলও পেয়েছেন। পরর্তীতে ফ্রেডেরিক ব্যান্টিং তার পুরস্কারের অর্থের অর্ধেক চার্লস বেস্টের সঙ্গে ভাগ করেন এবং জন ম্যাকলেয়ড পুরস্কারের বাকি অর্ধেক জেমস কলপের সঙ্গে ভাগ করে নেন। তবে ইনসুলিন একদিনেই আবিষ্কার হয়নি।
১৯২০ সালে প্রথম তারা এটি নিয়ে কাজ শুরু করেন। এরই মধ্যে অগ্ন্যাশয়ের কোষের ক্লাস্টারগুলো চিহ্নিত করেছিলেন, যাকে আইলেট বলা হয়। যা ইনসুলিন তৈরি করে এবং কাজ করে যে এই কোষগুলোই টাইপ ১ ডায়াবেটিসে ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর তারা গ্রাউন্ড-আপ অগ্ন্যাশয় কোষ থেকে ইনসুলিন নিষ্কাশন করার চেষ্টা করেন, কিন্তু সেগুলো সবই ব্যর্থ প্রমাণিত হয়। চ্যালেঞ্জটি ছিল অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন নিষ্কাশন করার উপায় খুঁজে বের করা, এটি প্রক্রিয়ায় ধ্বংস না করে।
অস্কার মিনকোভস্কি এবং জোসেফ ভন মেরিং নামের দুই গবেষক ডায়াবেটিস নিয়ে গবেষণা করছিলেন অনেকদিন থেকেই। তারা দেখতে পান যেসব কুকুরদের অগ্ন্যাশয় সরিয়ে ফেলা হয়েছিল তাদের ডায়াবেটিস হয়েছে। ফ্রেডেরিক ব্যান্টিং এবং চার্লস বেস্ট এই গবেষণার ব্যাখা দেন, যারা ডায়াবেটিস হওয়া কুকুরদের স্যালাইন দ্রবণে অগ্ন্যাশয়ের নির্যাস দিয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের পথ খুঁজে পেয়েছিলেন। জেমস কলিপ এবং জন ম্যাকলেয়ড নামের দুই বায়োকেমিস্ট বাছুরের অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন সংগ্রহ করে তা পরিশোধন পদ্ধতিতে বিশুদ্ধ করেন এবং মানুষের ব্যবহারের উপযোগী করে তোলার মাধ্যমে তা চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে আসেন।
১৯২২ সালের ২৩ জানুয়ারি তারা ১৪ বছর বয়সী লিওনার্ড থম্পসন শরীরে প্রথম ইনসুলিন প্রয়োগ করেন। টাইপ ১ ডায়াবেটিসে ভুগছিলেন লিওনার্ড থম্পসন। ইনসুলিন প্রয়োগের ২৪ ঘন্টার মধ্য তার রক্তে শর্করার মাত্রা আকাশ চুম্বি ৫২০মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার থেকে ১২০মিলিগ্রাম/ডেসিলিটারে নেমে যায়। চাক্ষুস তার অবস্থার উন্নতি হয়েছিল। এরপর যতদিন বেঁচে ছিলেন ইনসুলিন গ্রহণ করেছেন প্রতিদিন। ইনসুলিনের জন্য লিওনার্ড থম্পসনের মৃত্যুর দ্বার থেকে বেঁচে আসাটা বিশ্বজুড়ে সমস্ত ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য আশার আলো হয়ে উঠে।
১৯৮২ সাল থেকে ইনসুলিনের উৎপাদনের জন্য আর প্রাণীর উপর নির্ভর করতে হয়নি। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অগ্রগতির ফলে ব্যাক্টেরিয়া থেকে মানব ইনসুলিন উৎপাদন করতে সক্ষম হয়। ১৯৮৫ সালে ইনসুলিন পেন আবিষ্কার করা হয়। ১৯৯৭ সালের দিকে ইনসুলিনের পুরোনো আবিষ্কারগুলো মানবদেহের উপযোগী অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়ে আসে। ইনসুলিন ১০০ বছরের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বর্তমান অবস্থায় এসেছে।
সূত্র: ডায়াবেটিস ইউকে
কেএসকে/জিকেএস