তামাকের ব্যবহার রোধে ওরাল ক্যান্সার ৫০ শতাংশ কমানো সম্ভব

বাংলাদেশে ক্যান্সার রোগীদের মধ্যে ফুসফুস ক্যান্সারের পরই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হন ওরাল (মুখের) ক্যান্সারে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, নানা কারণেই হতে পারে ওরাল ক্যান্সার। তবে শুধুমাত্র সিগারেট, তামাকযুক্ত পানসহ তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার করা বন্ধ করলে ওরাল ক্যান্সার ৫০ শতাংশ কমে যাবে।
বিশ্ব ক্যান্সার দিবস-২০১৮ উপলক্ষে সোমবার বিকেলে জাতীয় প্রেস ক্লাবের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে আয়োজিত ‘ওরাল ক্যান্সার : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে এ তথ্য জানানো হয়।
বাংলাদেশ ওরাল ক্যান্সার সোসাইটির সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সাখাওয়াত হোসেন সায়ন্থ বাংলাদেশে ওরাল ক্যান্সার পরিস্থিতি তুলে ধরে বলেন, তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহারে বাড়ছে ক্যান্সার। চিবিয়ে খাওয়া তামাক ও সিগারেট মুখের ক্যান্সার বাড়ায়।
তিনি বলেন, ৩০ থেকে ৪০টি সিগারেট খেলে মুখের ক্যান্সারের যে ঝুঁকি তার চেয়ে বেশি ঝুঁকি ৮/১০ বার চিবিয়ে তামাক খেলে। আর ৪০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের এ ঝুঁকি আরও বেশি।
ডা. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ৫০ শতাংশ ক্যান্সার আমরা প্রতিরোধ করতে পারি যদি আমরা সচেতন হই। তামাকজাতদ্রব্য থেকে দূরে থাকি। প্রাথমিক পর্বে রেডিও থেরাপি কিংবা অপারেশন করেই মুখের ক্যান্সার রোধ করা যায়। তবে অধিকাংশ এ রোগের রোগীরা আসেন লেট স্টেজে। প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা না করালে মুখের ক্যান্সার গলায়, এরপর শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তখন চিকিৎসা অত্যন্ত জটিল ও এমনকি অসম্ভব হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশ ওরাল ক্যান্সার সোসাইটি'র সভাপতি অধ্যাপক ডা. মতিউর রহমান মোল্লার সভাপতির বক্তব্যে বলেন, মুখে সাদা ও লাল ঘা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এসব ক্ষেত্রে লক্ষণ দেখা দেয়া মাত্রই বিলম্ব না করে পরীক্ষা করুন, ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
তিনি বলেন, ধানের পরিবর্তে তামাক তৈরি হচ্ছে। সরকারও অনেক বেশি ট্যাক্স পাচ্ছে। তামাক দিয়ে সিগারেট-বিড়ি তৈরি করতে গিয়ে গরিবদের অল্প মজুরি দিয়ে বলা যায় কিনে নেয়া হচ্ছে। আর তৈরি করা হচ্ছে ক্যান্সারের রাজত্ব। এটা অবশ্যই বন্ধ হওয়া উচিত।
ক্যান্সার ইনস্টিটিউট থাকলেও তা অপ্রতুলতায় ভরা। আমাদের অনেক ডাক্তারের সমস্যা আছে, চিকিৎসা ভালো দেন না। বিদেশ চলে যান। কিন্তু সব ডাক্তারকে এক করে দেখবেন না। অনেক ডাক্তারই আছেন, মন-প্রাণ দিয়ে রোগী দেখেন। রোগীর সমস্যায় নিজেও কষ্ট পান -বলেন তিনি।
ডা. মতিউর রহমান মোল্লা আরও বলেন, ক্যান্সার রোগের চিকিৎসা দেশে কিংবা বিদেশ, এটা ব্যয় বহুল। কিন্তু এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে গরীব মানুষই বেশি। তাদের জন্য আমাদের কিছু করা দরকার। রাষ্ট্র যেমন চিকিৎসা সেবা বিনা খরচে করার দায়িত্ব তেমনি আমাদেরও দায়িত্ব সচেতনতা। রোগ মুক্তির উপায়ের পথে হাঁটা।
আলোচনা সভায় স্কয়ার হাসপাতালের ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, মানব শরীর অনেকগুলো কোষ দ্বারা গঠিত। কোষ মারা যায় আবার নতুন করে তৈরি হয়। এর ব্যতিক্রম ঘটলে টিউমার হয়। আর টিউমারই ক্যান্সার রোগের প্রাথমিক ভিত্তি।
তিনি বলেন, নিজের মুখ নিজে দেখুন। প্রতিদিন আয়নায় দাঁড়াই, ব্রাশ করি। একটু খেয়াল করলেই মুখের ক্যান্সার হলে বোঝা সম্ভব এবং তাৎক্ষণিক চিকিৎসা নিতে হবে। জরায়ু, ফুসফুস ক্যান্সারসহ ৩০ ভাগ ক্যান্সার হয় তামাকের কারণে। ইনফেকশন থেকে ওরাল ক্যান্সার হয় ৯ ভাগ, ৩৫ ভাগ ক্যান্সার হয় খাবারে অনিয়মের কারণে।
ফরমালিন, ইথিলিন, ইউরিয়া, ক্রোমিয়াম ক্যান্সারের ক্ষেত্রে বেশি ঝুঁকির কারণ। তাৎক্ষণিকভাবে এর প্রতিক্রিয়া হলেও ভবিষ্যতে মারাত্মক ক্ষতি ও ঝুঁকির কারণ। শারীরিক পরিশ্রম না করলেও ক্যান্সার হতে পারে।
তিনি বলেন, ক্যান্সার রোগীর দেশের বাইরে যাবার কোনো প্রয়োজন নেই। দেশেই খুব ভালো চিকিৎসা সম্ভব। চিকিৎসা ক্ষেত্রে যদি সরকার ট্যাক্স হলি ডে চালু বা ট্যাক্স মওকুফ করেন তাহলে চিকিৎসা খরচ অনেক কমে যাবে। তাহলে দেশের বাইরে যাবার প্রয়োজন পড়বে না। বিশ্বের সেরা মানের চিকিৎসা আমরা দেশেই সম্ভব।
ওরাল ক্যান্সার সোসাইটির ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. ইকবাল শহীদ বলেন, গ্রামাঞ্চলের মা-বোনরা বেশি ওরাল ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। কারণ, তারা সারাদিন কাজ করেন আর সাথে মুখে রাখেন তামাকযুক্ত পান, গুল। যা ৫/৭ ঘণ্টাও থাকে। এতে ওরাল ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওরাল অ্যান্ড ম্যাক্সিলোফেসিয়াল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওয়ারেছ উদ্দিন বলেন, আমরা যেসব ক্যান্সারের অপারেশন ঝুঁকি নিয়ে করি তাও ভালো হয় না। পরে বিদেশে গিয়েও হয় না। কারণ, রোগীরা এমন অবস্থায় আসে তখন কিছু করার থাকে না। প্রাথমিক পর্যায়েই যদি ওরাল ক্যান্সার রোগীরা আসেন তাহলে ভালো চিকিৎসাই দেয়া সম্ভব।
ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জন্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. রুহুল আমিন বলেন, ওরাল ক্যান্সারের ব্যাপারে সচেতনতার জন্য আমরা দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প করছি। এ রোগের ব্যাপারে গণমাধ্যমের সহযোগিতা বেশি জরুরি।
জেইউ/আরএস/এমএস