করোনা চিকিৎসায় আইভারমেকটিনের ভূমিকা কী?
চিকিৎসা বিজ্ঞানে পেনিসিলিন ও অ্যাসপিরিনের পরে তৃতীয় যে ওষুধটিকে ‘বিস্ময়কর ওষুধ’ (wonder drug) হিসেবে ধরা হয়, সেটি হলো আইভারমেকটিন। স্বাস্থ্য ব্যবস্থায়, বিশেষ করে গরিবের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আইভারমেকটিনের অবদান অপরিসীম।
শুরুতে পশু চিকিৎসায় ব্যবহৃত হলেও পরে মানবদেহের ভেতরের ও বাইরের প্যারাসাইট ধ্বংসে কয়েক যুগ ধরে ওষুধটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কৃমি, ফাইলেরিয়াসিস, উকুন, রিভার ব্লাইন্ডনেস, খোস-পাঁচড়াসহ বহু প্যারাসাইটিক ইনফেকশনে ওষুধটির কার্যকারিতা অনবদ্য। বৈচিত্র্যময় কার্যপরিধি, সহজলভ্যতা, সাশ্রয়ী মূল্য এবং স্বল্প পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া— সবমিলে আইভারমেকটিন আসলেই বিস্ময়কর ওষুধ।
কোভিড-১৯ চিকিৎসায় সম্ভাব্য কার্যকারিতা নিয়ে ওষুধটি এখন আলোচিত বিষয়।
আইভারমেকটিন আবিষ্কৃত হয় গত শতাব্দীর ‘৭০-এর দশকে, জাপানের কিতাসাতো ইনস্টিটিউটে। একধরনের জাপানিজ মাইক্রো-অর্গ্যানিজম থেকে এর উৎপত্তি। প্যারাসাইটিক রোগনির্মূল ও নিয়ন্ত্রণসহ জনস্বাস্থ্যের ওপর বিশাল অবদানের জন্য ওষুধটির আবিষ্কারক ও ডেভেলপার সাতোশি ওমুরা ও উইলিয়াম সি. ক্যাম্পবেল ২০১৫ সালে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান। ওই বছরের মার্চ মাসে অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় কোভিড-১৯ চিকিৎসায় আইভারমেকটিন কার্যকর দাবি করলে বিজ্ঞানীরা নড়েচড়ে বসেন।
গবেষণায় বলা হয়, ইন ভিট্রো (in vitro) আইভারমেকটিন কোভিড-১৯ রোগের ভাইরাস সার্স-কোভ-২-কে দমন করতে পারে, এবং সেল কালচারে (in cell culture) ওষুধের একটি সিঙেল ডোজ ভাইরাসের সংখ্যা ৫০০০ ভাগের এক ভাগে নামিয়ে আনতে পারে। এছাড়াও বলা হচ্ছে, আক্রান্ত হবার প্রাথমিক পর্যায়ে প্রয়োগ করা হলে আইভারমেকটিন করোনা রোগীকে সুস্থ করতে পারে।
বাংলাদেশের একদল চিকিৎসক আইভারমেকটিন ও ডক্সিসাইক্লিন দ্বারা চিকিৎসা দিয়ে ৬০ জন কেভিড-১৯ রোগীকে সুস্থ করেছেন বলে দাবি করেছেন। এখন দেখা যাক, আইভারমেকটিন কীভাবে কাজ করে?
স্নায়ুতন্ত্র বা নার্ভাস সিস্টেমের একটি ইনহিবিটরি নিউরোট্রান্সমিটার (inhibitory neurotransmitter) হচ্ছে গাবা (GABA), যার কাজ নার্ভ কন্ডাকশন (স্নায়ুতন্ত্রের সঞ্চালন)-কে দমন করা। আর স্নায়ুতন্ত্র (বিশেষ করে motor nerve) দমিত হলে মাংসপেশিও নিস্তেজ হয়ে পড়ে। ফলে প্যারালাইসিস হয়। আইভারমেকটিনের একটি কাজ হলো GABA সিস্টেমকে উত্তেজিত করে নার্ভ কন্ডাকশন প্রক্রিয়াকে তীব্রভাবে দমন করা। অমেরুদণ্ডি প্রাণীর ক্ষেত্রে (যেমন কৃমি), আইভারমেকটিন প্রথমে গ্লুটামেট-গেটেড ক্লোরাইড চ্যানেল (glutamate-gated chloride channel)-কে সক্রিয় করে ক্লোরাইডের জন্য সেল মেমব্রেন (কোষ-ঝিল্লি)-এর ভেদ্যতা (permeability) বাড়িয়ে দেয়। ফলে কোষে প্রচুর ক্লোরাইড প্রবেশ করে, অতিরিক্ত ক্লোরাইড আয়ন ঢোকার ফলে নেগেটিভ চার্জ বেড়ে গিয়ে নিউরো-মাসকুলার সেল (neuromuscular cell) হাইপার-পোলারাইজড হয়, ফলে নার্ভ কন্ডাকশন দুর্বল হয়ে পড়ে এবং শ্বাসনালী ও দৈহিক পেশিসমূহ প্যারালাইজড হয়ে মৃত্যু ঘটে।
প্রশ্ন হতে পারে, যারা আইভারমেকটিন খায়, তারা কেন প্যারালাইজড হয় না? আইভারমেকটিন GABA, এবং গ্লুটামেট-গেটেড ক্লোরাইড চ্যানেলের মাধ্যমে কৃমিসহ অন্যান্য প্যারাসাইট ধ্বংস করে। অমেরুদণ্ডি প্রাণীতে GABA রিসেপ্টর পেরিফেরাল নার্ভে থাকে নিউরো-মাসকুলার জাংশনে, এবং আইভারমেকটিনের প্রতি ১০০ গুণ বেশি সংবেদনশীল হয়। আর স্তন্যপায়ীদের ক্ষেত্রে GABA রিসেপ্টর প্রধানত ‘সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম’ (Brain)-এ থাকে। কিন্তু ব্লাড-ব্রেন-বেরিয়ার (Blood Brain Barrier) ভেদ করে আইভারমেকটিন মস্তিষ্কে যেতে পারে না। এ কারণে ব্লাড-ব্রেন-বেরিয়ার পূর্ণ ডেভেলপড না হওয়ায় পাঁচ বছরের কম বয়সী বা ১৫ কেজির কম ওজনের শিশুদের জন্য আইভারমেকটিন নিষিদ্ধ, যদিও এখন মনে করা হয় ব্যাপারটি সেরকম না-ও হতে পারে।
অন্যদিকে, গ্লুটামেট-গেটেড ক্লোরাইড চ্যানেল শুধুমাত্র অমেরুদণ্ডি প্রাণীতে থাকে, মেরুদণ্ডি প্রাণীতে থাকে না। ফলে আইভারমেকটিন মানুষ বা অন্য স্তন্যপায়ী প্রাণীকে প্যারালাইসিস করে না। আর যে ডোজে ওষুধ প্রয়োগ করা হয়, তা প্যারাসাইট মারার জন্য যথেষ্ট, তবে মানব কোষ ধ্বংস করে না। তবে উচ্চমাত্রার ডোজ দিলে অন্যান্য লিজান্ড-গেটেড আয়ন চ্যানেল সক্রিয় হতে পারে, তবে সেটা ভিন্ন বিষয়।
এবার দেখা যাক, করোনায় আইভারমেকটিনের ভূমিকা কী? প্যারাসাইটের ওপর আইভারমেকটিন যে আয়ন চ্যানেল প্রক্রিয়ায় কাজ করে, সেই একই প্রক্রিয়া ভাইরাসের ওপর প্রযোজ্য নয়। কিন্তু ডেঙ্গু ভাইরাস পরীক্ষায় দেখা গেছে, আইভারমেকটিন মশা (mosquito vector) থেকে ভাইরাল লোড কমিয়ে দেয়, যদিও কারণটা এখনও অজানা। কিছু হিউম্যান স্ট্যাডিও হয়েছে, কিন্তু সেখানে কোনো ভাইরাল লোড কমেনি বা আশাব্যঞ্জক ফল পাওয়া যায়নি। যেহেতু ডেঙ্গু ভাইরাসও সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের মতো একই রকম RNA ভাইরাস, হয়তো এ কারণেই আইভারমেকটিন করোনার ওষুধ হিসেবে চলে এসেছে— কোনো মেকানিজম থাকুক আর নাই থাকুক।
মোনাশ ইউনিভার্সিটির ইন ভিট্রো গবেষণায় যে মাত্রার ডোজে আইভারমেকটিন ব্যবহৃত হয়েছে তা অনেক বেশি। এত উচ্চ মাত্রায় ব্যবহার করা হলে অনেক ড্রাগই কোনো নির্দিষ্ট ভাইরাসকে ইন ভিট্রো দমন করতে পারে। সমমাত্রার আইভারমেকটিন রক্তপ্রবাহে পেতে হলে যে পরিমাণ ডোজ লাগবে, তা মানব দেহের জন্য নিরাপদ ভাবা সত্যিই কঠিন। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন করোনাভাইরাসের জন্য আইভারমেকটিন গ্রহণ না করার জন্য জনগণকে সতর্ক করেছে।
কিছু পজিটিভ রেজাল্টও আছে। আগেই বলা হয়েছে, আইভারমেকটিন ইন ভিট্রো করোনাভাইরাসকে দমন করে। করোনাভাইরাস সেল মেমব্রেনের ACE-2 (angiotensin-converting enzyme 2)-এর সাথে যুক্ত হয়ে কোষের ভেতরে ঢুকে পড়ে। ভাইরাল প্রোটিন এরপরে গলজি বডি-কে ব্যবহার করে ট্রান্সপোর্টার প্রোটিন তৈরি করে, যার সহায়তা নিয়ে নিউক্লিয়ার মেমব্রেন ভেদ করে নিউক্লিয়াসে ঢুকে অনুলিপি (রেপ্লিকেশন) তৈরি করতে থাকে। আইভারমেকটিন ট্রান্সপোর্টার প্রোটিন থেকে ভাইরাল প্রোটিনকে অপসারণ করে নিজে সেখানে অবস্থান নেয়। ফলে ভাইরাল প্রোটিন আর নিউক্লিয়াসে ঢুকতে পারে না এবং রেপ্লিকেশন বন্ধ হয়ে যায়।
সার্স-কোভ-২ না হলেও অন্য ভাইরাস, যেমন- পোরসাইন সারকো ভাইরাস নিয়ে ইন ভিভো (in vivo) স্ট্যাডিতে দেখা গেছে, আইভারমেকটিন ভাইরাসটিকে দমন করতে সক্ষম। যাই হোক, কোভিড-১৯ চিকিৎসায় আইভারমেকটিন কতটুকু কার্যকর বা আদৌ কার্যকর কি-না, তা আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বলা যাবে। আমরা ক্লোরোকুইন, হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন, রেমডেসিভির নিয়ে সম্ভাবনার কথা শুনেছি, কিন্তু ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে এখন পর্যন্ত কনক্লুসিভ রেজাল্ট পাওয়া যায়নি। আমরা জানি, মোটামুটি ৮০% কোভিড রোগী এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। সুতরাং এই ৮০% রোগীর ওপর পরীক্ষা চালিয়ে লাভ নেই। তারা ওষুধ খেলেও সুস্থ হবেন, না খেলেও সুস্থ হবেন। বরং যে ২০% রোগীকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয় বা বিশেষ করে যেসব রোগীকে মেকানিক্যাল ভেন্টিলেশন দেয়া হয়, তাদের ওপর আইভারমেকটিন কাজ করে কি-না সেটা দেখা দরকার।
বিশ্ব ইতোমধ্যে করোনার পাশাপাশি সেল্ফ-মেডিকেশন, ওষুধ-ঘাটতি, এমনকি ক্লোরোকুইন ওভার-ডোজের মহামারি দেখেছে। এসবের যেন পুনরাবৃত্তি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। যেকোনো ওষুধ ব্যাপকভাবে প্রয়োগের আগে তার কার্যকারিতা সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া দরকার। আর অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ খাবেন, সেল্ফ মেডিকেশন আর নয়।
লেখক- কদরুল হুদা, বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইডিসিএল
এমএআর/জেআইএম