বিশ্বজুড়ে জলাতঙ্কেই বছরে ঝরে ৫৫ হাজার প্রাণ

আবদুল্লাহ আল মিরাজ
আবদুল্লাহ আল মিরাজ আবদুল্লাহ আল মিরাজ , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:৩০ এএম, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২
ফাইল ছবি

জলাতঙ্ক বা হাইড্রোফোবিয়া। মারাত্মক এই ভাইরাল সংক্রমণটি সাধারণত গৃহপালিত প্রাণী ও বন্যপ্রাণী থেকে মানুষে ছড়ায়। রোগটি শতভাগ প্রতিরোধযোগ্য আবার এর সংক্রমণে মৃত্যুও শতভাগ অনিবার্য।

পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বে প্রতি ১০ মিনিটে একজন এবং প্রতি বছর প্রায় ৫৫ হাজার মানুষ জলাতঙ্কে মারা যায়। বাংলাদেশেও বছরে গড়ে ৪০ থেকে ৫০ জন রোগী মৃত্যুবরণ করেন জলাতঙ্কে। শুধু মানুষই নয়, প্রতি বছর প্রায় ২৫ হাজার গবাদিপশুও জলাতঙ্কে আক্রান্ত হয় দেশে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোনো প্রাণীর কামড় বা আঁচড়ের শিকার হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই চিকিৎসা নেওয়া হলে এটি শতভাগ প্রতিরোধযোগ্য। কিন্তু এর ব্যতিক্রম হয়ে ভাইরাস যদি শরীরে ছড়িয়ে যায় তাহলে আর সেই রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয় না।

এ অবস্থায় পৃথিবীর ১২টি দেশের সঙ্গে মিল রেখে ২০০৭ সাল থেকে বাংলাদেশে ২৮ সেপ্টেম্বর পালিত হচ্ছে জলাতঙ্ক দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘জলাতঙ্ক: মৃত্যু আর নয়, সবার সঙ্গে সমন্বয়’।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার (সিডিসি) জুনেটিক ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের তথ্যমতে, ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত দেশে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২৪ জন। কুকুর, বিড়াল কিংবা শিয়ালের কামড়ের কারণে ২ লাখ ৯৯ হাজার ৯৮৯ জন টিকা নিয়েছেন।

এর আগে ২০২০ সালে এতে মারা যান ২৬ জন, টিকা নিয়েছিলেন ১ লাখ ৫২ হাজার ১৪ জন। ২০২১ সালে জলাতঙ্কে মারা গেছেন ৪০ জন, টিকা নিয়েছেন ২ লাখ ৭৮ হাজার ৬২৩ জন। এর আগে জলাতঙ্কের কারণে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ৫৭ জন করে মারা যান। ২০১৮ সালে ২ লাখ ৫৩ হাজার ৪০৯ জন এবং ২০১৯ সালে ২ লাখ ৫৩ হাজার ৮৬১ জন টিকা নিয়েছিলেন।

সরেজমিনে জাতীয় সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, হাসপাতালটিতে কুকুরের কামড়ে আক্রান্ত হয়ে টিকা নিতে আসা রোগীর সংখ্যাই বেশি।

আরও পড়ুন: জলাতঙ্ক যেভাবে হয়, জেনে নিন রোধের উপায়

কুকুরের কামড়ের শিকার হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছে ১০ বছরের শিশু মো. হোসাইন। শিশুটির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তার বাড়ি সাভারে। সেখানে সোমবার (২৬ সেপ্টেম্বর) কুকুরের আঁচড় খেয়ে একদিন পর টিকা নিতে বাবার সঙ্গে এসেছে এই শিশু।

শিশুটির বাবা জানান, শঙ্কামুক্ত থাকতেই নিয়ে এসেছেন ছেলেকে।

মো. ইমামুল সরকার নামে আরেকজন বিড়ালের আক্রমণের শিকার হয়ে তৃতীয় দিনের মতো টিকা নিতে এসেছেন এই হাসপাতালে। তাকে অন্য বাড়ির বিড়াল পায়ে আঁচড় দিয়েছিল।

জাতীয় সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের তথ্যমতে, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ হাসপাতালে জলাতঙ্কে মারা গেছেন ৩১ জন। তাদের মাঝে ১০ জন শিশু ও ২১ জন প্রাপ্তবয়স্ক। আক্রমণের শিকার হয়ে টিকা নিয়েছে ৬২ হাজার মানুষ। এদের মধ্যে ৩৭ হাজার ৫৬৭ জন কুকুরের ও ২৪ হাজার ৯৩৩ জন অন্যান্য প্রাণীর কামড়ের শিকার হয়ে টিকা নিয়েছেন।

বিশ্বজুড়ে জলাতঙ্কেই বছরে ঝরে ৫৫ হাজার প্রাণ

এ বিষয়ে জাতীয় সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের পরিচালক ডা. মিজানুর রহমান বলেন, জলাতঙ্কে আক্রান্ত হলে তিনটি লক্ষণ দেখা দেয়। তার মধ্যে আছে পানিভীতি, আলোভীতি ও বায়ুভীতি। এই ধরনের লক্ষণ যখন প্রকাশ পায় তখন রোগীকে আর বাঁচানো সম্ভব হয় না। এ ধরনের উপসর্গ দেখা দিলে তারা হাসপাতালে ভর্তি হন। এসব উপসর্গ নিয়ে বেশিরভাগ রোগীই ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই মারা যান।

আরও পড়ুন: প্রতি ১০ মিনিটে এক জনের প্রাণ কেড়ে নেয় জলাতঙ্ক

তিনি জানান, ৯ দিন থেকে তিন মাস, অনেক ক্ষেত্রে এক বছর পরও এই রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। এটি মূলত কোন স্থানে কামড়েছে তার ওপর নির্ভর করে। যেহেতু রোগটি ব্রেইনকে আক্রান্ত করে, সেক্ষেত্রে মাথার যত কাছাকাছি প্রাণীর আক্রমণের শিকার হয় তত দ্রুত উপসর্গ দেখা দেয়। সেজন্য প্রাণী যখন কামড় দেয় তখন থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই টিকা নিয়ে নিতে হবে। হাসপাতালে আসার পর ক্যাটাগরি ভিত্তিতে টিকা দেওয়া হয় রোগীদের।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. শ.ম. গোলাম কায়ছার জাগো নিউজকে জানান, সারাদেশে জেলা ও উপজেলা হাসপাতাল পর্যায়ে ৩০০টির বেশি জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়া রাজধানী ঢাকার মহাখালীতে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল ও ৫টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং কামরাঙ্গীরচর ৩১ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে জলাতঙ্কের আধুনিক চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। প্রতি বছর প্রায় তিন লাখের অধিক জলাতঙ্ক সংক্রমণকারী প্রাণীর কামড়/আঁচড়ের রোগীকে বিনামূল্যে জলাতঙ্কের টিকা দেওয়া হচ্ছে। ফলে জলাতঙ্কে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে।

আরও পড়ুন: কুকুরে কামড়ালে প্রথমেই যা করবেন

তিনি আরও জানান, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বাংলাদেশ সরকারের গাইডলাইন অনুসারে বর্তমানে জলাতঙ্ক প্রতিরোধী ভ্যাকসিনের পূর্ণ ভোজ তিনটি। শূন্য, তিন ও সাতদিন। এক সপ্তাহে দেওয়ার ফলে রোগীদের অর্থ ও সময় সাশ্রয় হচ্ছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সব সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হয়েছে। জলাতঙ্কের প্রধান উৎস কুকুরের মধ্যে ব্যাপকহারে জলাতঙ্ক প্রতিরোধী ভ্যাকসিন প্রদান করা হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, ব্যাপকহারে কুকুরের টিকাদান (এমডিভি) কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রায় ২২ লাখ ৫১ হাজার ডোজ জলাতঙ্ক প্রতিরোধী টিকা প্রদান করা হয়েছে কুকুরকে।

এএএম/এমএইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।