ভারতে নির্বাচন

উদ্বেগ বাড়াচ্ছে এআই ও ডিপফেক

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১:৫৬ পিএম, ১৮ মে ২০২৪

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (এআই) টুলগুলো দিনদিন আরও উন্নত হয়ে উঠেছে। এতে ব্যবহার সহজ হয়ে উঠলেও নতুন একটি চিন্তা ঘিরে ধরেছে বিশেষজ্ঞদের। সেটি হলো, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আরও পরিশীলিত হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ‘ভুয়া তথ্যকে সঠিক দাবি করে’ মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার শঙ্কা।

এ বিষয়ে ভারতের সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এস ওয়াই কোরেশি বলেন, গুজব বরাবরই নির্বাচনী প্রচারের সঙ্গে মিশে ছিল। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে এটি দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তে পারে।

প্রযুক্তির সাহায্যে শব্দ ও বার্তায় হেরফের
সাম্প্রতিক প্রযুক্তিগত উন্নতির সুবিধা নেওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোই কিন্তু প্রথম নয়। প্রতিবেশী পাকিস্তানে এই একই প্রযুক্তি ব্যবহার করে এক রাজনৈতিক সমাবেশে ভাষণ দিয়েছিলেন দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান।

ভারতে খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর জন্য। তিনি হিন্দিতে জনতাকে সম্বোধন করেন এবং মুহূর্তের মধ্যে তার সেই বক্তব্য তামিলে অনুবাদ করে দেয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তৈরি ‘ভাষিণী’। এটি ভারত সরকারেই তৈরি করা টুল।

আরও পড়ুন>> 

এই কৌশলগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে শব্দ এবং বার্তা হেরফের করার ক্ষেত্রেও। গত মাসেই দুটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল যেখানে বলিউড তারকা রণবীর সিং এবং আমির খানকে কংগ্রেসের হয়ে প্রচার করতে দেখা যায়।

ওই ভিডিও ‘ডিপফেক’ জানিয়ে দু’জন অভিনেতাই পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। একইসঙ্গে উল্লেখ করেছিলেন, তাদের অনুমতি ছাড়াই বানানো হয়েছিল ওই ভিডিও।

এরপর গত ২৯ এপ্রিল নরেন্দ্র মোদী এই প্রযুক্তির অপব্যবহার সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তার এবং বিজেপির অন্যান্য নেতাদের বক্তব্য বিকৃত করার বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়েছিলেন তিনি।

পরের দিন, এই ঘটনায় পুলিশ দুজনকে গ্রেফতার করে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের ভিডিও কেটে ছেঁটে উপস্থাপন করার অভিযোগ ছিল তাদের বিরুদ্ধে। গ্রেফতার ব্যক্তিদের মধ্যে একজন কংগ্রেসের, অন্যজন আম আদমি পার্টির কর্মী।

অন্যদিকে, কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ তুলছে বিরোধী দলগুলো।

AIএআই দিয়ে তৈরি রাহুল গান্ধী, অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও মমতা ব্যানার্জীর ছবি। ছবি: সংগৃহীত

রাজনীতি ও প্রতিযোগিতা
সংশ্লিষ্ট মহলের বক্তব্য অনুযায়ী, এই ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হলেও জাল এবং বিকৃত কনটেন্ট মোকাবিলা করার মতো তেমন কোনো আইনি ব্যবস্থা ভারতে নেই।

তথ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ক গবেষক শ্রীনিবাস কোডালি বিষয়টার ব্যাখ্যা করে বলেন, এর অর্থ হলো, আপনি যদি কোনো ভুল কাজ করতে গিয়ে ধরা পড়েন, তাহলে আপনাকে হালকা শাস্তি দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হবে।

এই পরিস্থিতিতে ব্যক্তিগত আদর্শ এবং নীতির ওপর ভিত্তি করেই কোন কাজ করবেন আর কোনটা করবেন না সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন কনটেন্ট ক্রিয়েটররা।

আরও পড়ুন>> 

জানা গেছে, রাজনীতিবিদরা বিরোধীদের অশ্লীল ছবি ও বিকৃত ভিডিও তৈরি করতে বলেছেন কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের। উদ্দেশ্য একটাই, জনতার কাছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ভাবমূর্তি নষ্ট করা।

এ বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন ‘দ্য ইন্ডিয়ান ডিপফেকার’ (টিআইডি)-এর প্রতিষ্ঠাতা দিব্যেন্দ্র সিং জাদাউন। টিআইডি বিনামূল্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সফটওয়্যার ব্যবহার করে রাজনীতিবিদদের জন্য প্রচারমূলক কনটেন্ট তৈরি করতে সাহায্য করে।

তিনি বলেন, একবার আমাকে একটি আসল ভিডিওর ডিপফেক তৈরি করতে বলা হয়েছিল। কারণ, আসল ভিডিওটা ব্যাপকভাবে শেয়ার হলে (ওই ভিডিওতে) দৃশ্যমান রাজনীতিবিদের ভাবমূর্তি খারাপ হতে পারে। আর ঠিক সেই কারণে ওই নেতার দল চেয়েছিল, আমি একটি ডিপফেক ভিডিও তৈরি করি, যেটাকে ওরা আসল বলে প্রচার করতে পারে।

জাদাউন দাবি করেছেন, যাতে কোনো বিভ্রান্তি তৈরি না হয়, সেজন্য তার সংস্থার তৈরি প্রতিটি ভিডিওতে বিধিবদ্ধ সতর্কবার্তা থাকে যে, সেটি আসল নয়। তা সত্ত্বেও বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে আনা এখনো কঠিন।

দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ভুল তথ্য
পশ্চিমবঙ্গের এক মার্কেটিং এজেন্সিতে কাজ করেন শাহিদ শেখ। তার তৈরি কনটেন্ট রাজনীতিবিদ বা রাজনৈতিক দলগুলো যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাকে (শাহিদ শেখকে) ক্রেডিট না দিয়েই শেয়ার করে থাকে, সে বিষয়টি লক্ষ্য করেছেন শাহিদ।

তিনি বলেন, একজন রাজনীতিবিদ কোনো প্রসঙ্গ ছাড়াই আমার আঁকা নরেন্দ্র মোদীর ছবি ব্যবহার করেছিলেন এবং ছবিটা যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তৈরি করা হয়েছে, সে কথারও উল্লেখ করেননি তিনি।

আরও পড়ুন>> 

এখন ডিপফেক কনটেন্ট তৈরি করা এতটাই সহজ হয়ে গেছে, যে কেউ তা করতে পারে। দিব্যেন্দ্র বলেন, আগে এই কাজটা করতে সাত থেকে আট দিন সময় লাগতো, এখন তিন মিনিটেই তৈরি হয়ে যায়। কেবল দরকার একটি কম্পিউটার।

এতটা ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ভারত প্রাথমিকভাবে বলেছিল, তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কিত আইন প্রণয়নের কথা ভাবছে না। তবে ছবিটা বদলে যায় এ বছরের মার্চ মাসে।

‘মোদী কি ফ্যাসিবাদী?’ এই প্রশ্নের জবাবে গুগলের জেমিনি চ্যাটবটের উত্তরকে ঘিরে বিতর্ক শুরু হয়। এই ঘটনার পরেই পদক্ষেপ নেয় ভারত সরকার। ভারতীয় তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী রাজীব চন্দ্রশেখর সে সময় জানিয়েছিলেন, এটি ভারতের প্রযুক্তি আইনের লঙ্ঘন।

তখন থেকেই ভারত সরকার প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে জেনারেটিভ এআইয়ের ক্ষেত্রে ‘কম পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়েছে’ এবং ‘নির্ভরযোগ্য নয়’ এমন মডেল বা টুল প্রকাশের আগে সরকারের অনুমতি নেওয়ার নির্দেশ দেয়।

‘এআই টুলের’ এমন কোনো উত্তর যা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলতে পারে, সে বিষয়েও প্রযুক্তি সংস্থাগুলোকে সতর্ক করা হয়েছিল।

কিন্তু এটাই যথেষ্ট নয়। ভুয়া কনটেন্ট প্রকাশ্যে আনা কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলেই জানিয়েছেন ফ্যাক্ট-চেকাররা। নির্বাচনের সময় যখন ভুল তথ্য ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, সে সময় এই কাজটা আরও কঠিন হয়ে পড়ে।

শ্রীনিবাস কোদালি বলেন, ভুয়া কনটেন্ট মূলধারার মিডিয়াতেও ছড়িয়ে পড়ছে। তা সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে প্রকাশ্যে নীরবতা পালন করছে। এর জন্য কোনো আইন নেই। কোনো আইন তৈরির বদলে তারা বিষয়টি প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর স্বনিয়ন্ত্রণের ওপর ছেড়ে দিয়েছে।

অবশ্য এর কোনও সুনির্দিষ্ট সমাধান নেই বলেও জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এস ওয়াই কোরেশি বলেছেন, এই মুহূর্তে যারা ভুয়া ভিডিও অন্যদের পাঠাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে যদি ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তাহলে হয়তো অন্যরা যাচাই না করা তথ্য শেয়ার করতে ভয় পাবে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা
কেএএ/

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।