নিম্নবিত্ত কৃষক পরিবার থেকে শিক্ষা ক্যাডারে রেজাউল
মো. রেজাউল হক ৪০তম বিসিএসে সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে (গণিত বিভাগ) দশম হয়েছেন। তার শৈশব ও বেড়ে ওঠা বরেন্দ্রভূমি উত্তরবঙ্গের নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার চককেশব গ্রামের নিম্নবিত্ত কৃষক পরিবারে। গ্রামেই কেটেছে তার শৈশব-কৈশোরের সোনালি দিনগুলো। তিনি বালুবাজার শুকুরউদ্দিন মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং বালুবাজার শফিউদ্দিন মোল্যা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগ থেকে বিএসসি ও এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন।
বর্তমানে তিনি চলনবিলের নগরী নাটোরের সিংড়া উপজেলার গোল-ই-আফরোজ সরকারি কলেজের গণিত বিভাগে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত। সম্প্রতি তার বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও সফলতার গল্প শুনিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—
জাগো নিউজ: ৪০তম বিসিএসে সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পেয়েছেন, আপনার অনুভূতি কী?
মো. রেজাউল হক: বিসিএস অন্যরকম ভালো লাগার নাম। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের একজন সদস্য হতে পারা অনেক গৌরবের বিষয়। আনন্দের খবরটা প্রথম বাবা-মাকে জানাই। তারপর ছোট মামা মেজর ডা. রাসেলকে জানাই। আমার সফলতার পিছে যার অবদান অনস্বীকার্য। আমার গ্রাম থেকে এবং স্কুল-কলেজ থেকে এখন পর্যন্ত আমিই একমাত্র বিসিএস ক্যাডার হতে পেরেছি। এই অনুভূতিটা অসাধারণ।
জাগো নিউজ: বিসিএসের স্বপ্ন দেখেছিলেন কখন থেকে?
মো. রেজাউল হক: সত্যি বলতে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকেই একাডেমিক পড়াশোনার প্রতি তেমন আগ্রহ ছিল না। তাই বাইরের পড়াশোনা করতাম তখন থেকেই। তবে আমার পরিবারের ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো ছিল না। তাই যে কোনো একটি চাকরি জরুরি—এমন প্রবণতা থেকেই মূলত বিসিএসের দিকে ধাবমান হওয়া। কিন্তু তখনো এতটা বুঝতাম না যে বিসিএস ক্যাডার কীভাবে হতে হয়। তারপর একসময় আসক্তি সৃষ্টি হয়ে যায়।

জাগো নিউজ: বিসিএস যাত্রার গল্প শুনতে চাই, পাশাপাশি প্রস্তুতি কীভাবে নিয়েছেন?
মো. রেজাউল হক: আমি একটি বিষয়ে দৃঢ় সংকল্প ছিলাম যে, আমি পারি বা না পারি শেষ পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যাবো। আমার বিসিএস ক্যাডার হওয়ার পেছনে মূলত কাজ করেছে এই ‘লেগে থাকা’ বিষয়টি। সেই থেকে শুরু। ২০২০ সালে চাকরি পেলাম নন-ক্যাডার থেকে বস্ত্র অধিদপ্তরের প্রশিক্ষক পদে। এরপর ২০২১ সালে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরে ইন্সট্রাক্টর পদে। এরপর ২০২২ সালে ৪০তম বিসিএস থেকে সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশ পাই। রাবিতে ফলিত গণিত বিভাগে পড়ার সুবাদে গণিতের প্রস্তুতিটা ভালো ছিল। সোনালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার আমার সহপাঠি বন্ধু রাজিব কুমার সরকার এবং আমি রুমমেট ছিলাম। দুজন শেয়ার করে পড়াশোনা করেছি কিছুদিন। বিসিএস একটি তীব্র নেশার মতো। একবার আসক্তি এসে গেলে অন্য কিছু ভালো লাগে না। একটি বিসিএসের তিনটি ধাপ সম্পন্ন করে চাকরিতে যোগদান করতে প্রায় তিন থেকে চার বছর লেগে গেলো। ঢাকার উত্তরায় দু’তিনটি টিউশনি করতাম। চাকরি পেতে দীর্ঘসময় লাগার কারণে খুব অসহায়ত্ব বোধ হতো। করোনা মহামারির শুরুর দিনগুলো আমার জীবনের সবচেয়ে দুর্ভোগের ছিল। টিউশনে সারাদিন চলে যেতো আর রাতে বিসিএসের পড়াশোনা করতে হতো। খুব ভালো সাপোর্ট পেয়েছি বন্ধুপ্রতীম ছোট মামা মেজর ডা. রাসেলের কাছ থেকে।
জাগো নিউজ: পর্দার আড়াল থেকে কেউ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন?
মো. রেজাউল হক: যার নামটি একটু আগেই বলেছি মেজর ডা. রাসেল। আমরা একই সঙ্গে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। মামা-ভাগ্নে হলেও আমরা ছিলাম বন্ধুর মতো। মূলত তিনিই আমার মধ্যে বিসিএসের নেশা জাগিয়ে তুলেছিলেন। ক্যাডার হতে হবে এমন বোধ জন্ম নিয়েছিল আমার মধ্যে। তাই বাবা-মায়ের পাশাপাশি তাকেও পেয়েছি অনুপ্রেরণা হিসেবে।
জাগো নিউজ: নতুনরা বিসিএস প্রিলির জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নেবেন?
মো. রেজাউল হক: প্রথম কথা হলো লেগে থাকতে হবে। হাল ছাড়া যাবে না। যতই নিজের প্রস্তুতি খারাপ বলে মনে হোক। সিলেবাসটা পিএসসির ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড করে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো বিস্তারিত পড়তে হবে। যে কোনো একটি প্রকাশনীর একসেট বই কিনে পড়া শুরু করা যেতে পারে। মোটামুটি সিলেবাসটা কভার দেওয়ার পর সমসাময়িক বিষয় নিয়মিত পড়তে হবে। যত বেশি সম্ভব পরীক্ষা দিতে হবে। বাজার থেকে মডেল টেস্টের যে কোনো একটি বই কিনে নিজের প্রস্তুতি ঝালাই করে নেওয়া যেতে পারে। সবচেয়ে বেশি খেয়াল রাখতে হবে সময় ও নেগেটিভ মার্কের ওপর। যেহেতু ভুল উত্তরে নম্বর কাটা যায়। সঠিক উত্তর জানা না থাকলে উত্তর না করাই ভালো। বাড়িতে কিছু মডেল টেস্ট দিয়ে নির্ধারিত সময়ে পরীক্ষা শেষ করার প্র্যাকটিস করতে হবে। প্রশ্নের প্যাটার্ন বুঝে সব বিষয়েই নিজেকে দক্ষ করে তুলতে হবে। বিগত কিছু বছরের প্রশ্ন সমাধান ও পর্যালোচনা করলে প্রস্তুতি সহজ হয়ে যায়। গ্রুপ স্ট্যাডি প্রিলিমিনারি পরীক্ষা প্রস্তুতির খুব ভালো একটি পন্থা। এতে অনেক কনফিউশন দূর হয়ে যায় এবং প্রশ্ন মনে থাকে দীর্ঘসময়।
জাগো নিউজ: প্রিলি শেষ করার পর বিসিএস লিখিত প্রস্তুতি নিয়ে আপনার পরামর্শ কী?
মো. রেজাউল হক: আমার মনে হয় প্রিলিমিনারি পরীক্ষার জন্য ভালো করে বিস্তারিত পড়লে লিখিত পরীক্ষার অর্ধেক প্রস্তুতি হয়ে যায়। একইভাবে সিলেবাস এবং বিগত বিসিএস লিখিত পরীক্ষার প্রশ্ন দেখে একটি আইডিয়া তৈরি করে নিতে হবে। লিখিত পরীক্ষা যেহেতু লম্বা সময় ধরে হয়ে থাকে। তাই বাসায় লেখালেখির অভ্যাস তৈরি করতে হবে। হাতের লেখার গতি বাড়াতে হবে। বেসিক যেমন- অসমাপ্ত আত্মজীবনী, সংবিধান, নবম-দশম শ্রেণির বাংলা, গণিত, বিজ্ঞান, আইসিটি বইসমূহ লিখিত পরীক্ষার জন্য সহায়ক হবে। তা ছাড়া দৈনিক পত্রিকা থেকে তথ্য, উক্তি, ডাটা-চার্ট দিলে নম্বর বেশি পাওয়া যায়। ইংরেজিতে ফ্রি-হ্যান্ড রাইটিং অভ্যাস করতে হবে।

জাগো নিউজ: বিসিএস ভাইভার প্রস্তুতি কেমন হতে হয়?
মো. রেজাউল হক: প্রিলি ও লিখিত পরীক্ষার জন্য সিলেবাস আছে। কিন্তু মৌখিক পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত কোনো সিলেবাস নেই। তাই মৌখিক পরীক্ষায় যতটুকু জানি; ততটুকু আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারতে হবে। সমসাময়িক বিষয়ে যেহেতু বেশি প্রশ্ন হয়, তাই সেদিকটা ভালো করে প্রস্তুত করে যেতে হবে। কিছু কমন ফিল্ড থেকে নিয়মিত প্রশ্ন হয়ে থাকে যেমন- নিজের পরিচয়, নিজের পঠিত বিষয় এবং নিজ জেলা। পরিপাটি পোশাক, সুন্দর বাচনভঙ্গি এবং আত্মবিশ্বাস থাকলে মৌখিক পরীক্ষা সহজ হয়ে যাবে। ইংরেজিতে কথা বলার অভ্যাস করতে পারলে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যাবে।
জাগো নিউজ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
মো. রেজাউল হক: আমাদের দেশে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে সরকারিভাবে কিছু উচ্চশিক্ষা বৃত্তি দেওয়া হয়ে থাকে। তার কোনো একটি নিয়ে দেশের বাইরে গিয়ে পিএইচডি করে দেশে ফিরে শিক্ষাক্ষেত্রে আরও বৃহৎ অবদান রাখার স্বপ্ন দেখি। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের একজন গর্বিত সদস্য হিসেবে দেশের কল্যাণে কাজ করতে চাই। সেই সঙ্গে পরিবার-পরিজন নিয়ে সাধারণ জীবনযাপন করতে চাই।
এসইউ/এএসএম