বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ‘ঠাটারি’ পেশা
![বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ‘ঠাটারি’ পেশা](https://cdn.jagonews24.com/media/imgAllNew/BG/2019November/7pick-20220626172214.jpg)
হাসমত সরকার পেশায় একজন ঠাটারি (কাঁসারি)। এলাকায় তিনি ‘ঠাঠারে’ নামেই পরিচিত। দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে ঠাটারির কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। তার কাজ হলো ঘরের পুরোনো তৈজসপত্র মেরামত করা। সকালে তিনি সাইকেল নিয়ে কাজের উদ্দেশে বের হয়ে পড়েন।
গ্রাম ঘুরে ঘুরে তিনি গৃহস্থালী নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবহার্য জিনিসপত্র মেরামত করেন। যেমন- টিনের বা সিলভারের প্লেট, হাঁড়ি-পাতিল, ঢাকনা, হারিকেন, বালতি, অ্যালুমিনিয়ামের জিনিসপত্র ইত্যাদি। এ ছাড়াও তেলের ড্রামের মুখ কেটে চাল রাখার উপযোগী করে দেন। তাতে তালা-চাবিরও ব্যবস্থা করে দেন।
হাসমত ঠাটারির সাইকেলের সামনে এখনো লাগানো আছে হারিকেন। হারিকেনটি তিনি রাতে পথে দেখে চলার জন্য ব্যবহার করছেন। তবে বর্তমান প্রজন্মকে হারিকেন দেখানোও তার উদ্দেশ্য। সাইকেলের পেছনের সিটে কাঠের বাক্স ভর্তি যন্ত্রপাতি। তাতে হাতুরি, চিমটি, প্লাস, মারতুল, হাপর, পিচ, জোরা দেওয়ার স্টিল, টিন, সীসার অংশ ও টুকরো বস্তু আছে।
হাসমত সরকারের বাড়ি বগুড়ার সোনাতলার কামারপাড়া গ্রামে। চার সন্তানের বাবা হাসমত বড় দুই মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য নিজের শেষ সম্বল বাড়িও বিক্রি করেন। এরপর পাশের গ্রামেই ভাঙা টিনের বাড়িতে মাসে ৩০০ টাকায় ভাড়া থাকেন। নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান হওয়ায় বেশি পড়ালেখা করতে পারেননি। মাত্র তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। পরিবারে অভাব থাকায় বাবার সাথে গ্রামে ঘুরে ঘুরে ঠাটারির কাজ করেছেন। বাবার কাছ থেকেই মূলত এ কাজ শেখেন।
হাসমতের তিন মেয়ে ও এক ছেলে। ছোট মেয়ে বগুড়া শহরের এক বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করেন। অভাবের কারণে ছেলেকেও বেশি পড়াতে পারেননি। পঞ্চম শ্রেণিতেই পড়ালেখার ইতি টানে ছেলে সুজন (২০)। সুজন সাপ্তাহিক চুক্তিভিত্তিক ৫০০ টাকা করে একটি ব্যাগ তৈরির কারখানায় কাজ করেন।
হাসমত সরকার জাগো নিউজকে বলেন, ‘হামার বাপ-দাদার পেশাও আসলো (ছিল) ঠাঠারে। আগে ঠাঠারেদের মেলা (অনেক) কদর ছিল। একন আর সে কদর নাই। আগে বাড়ি বাড়ি যায়া ঠাঠারের কাজ করে হামার বাপ-দাদারা সংসারের ঘানি টানছেন। একন আর সম্ভব হয় না।’
আগে হাসমত সরকার হাপর জ্বালিয়ে এক বাড়িতে কাজ করতে বসলে নানা বাড়ির লোকজন জিনিসপত্র ঠিক করার জন্য নিয়ে আসতো তার কাছে। তখন গ্রাম ঘুরে ঘুরে যা পেত, তা দিয়েই খুব ভালোভাবে সংসার চলে যেত। এখন বেশ কয়েক বছর ধরে দিনে ২০০-৩০০ টাকার কাজও হয় না। মাঝে মাঝে গ্রাম ঘুরে কাজ ছাড়াই ফিরতে হয়।
এ পেশার কদর সম্পর্কে হাসমত সরকার জাগো নিউজকে বলেন, ‘আগে মানুষজন তাগেরে ব্যবহার্য জিনিসপাতি ঠিক করত। এখন আর কেউ ঠিক করে না। একটা প্লেট ট্যেরা হলেও হামার কাছে আসতো। কাচের জিনিস আর প্লাস্টিকের জিনিসপাতি বেশি হওয়ায় এগুলো আর কেউ ঠিক করবের চায় না। এখন ত্রিশ-চল্লিশ টাকা হলেই প্লাস্টিকের গামলা পাওয়া যায়। একন এগুলো থুয়ে কে পুরাতন জিনিস ঠিক করবে?’
পেশাও পরিবর্তন করতে পারছেন না হাসমত সরকার। তিনি বলেন, ‘জীবনের মেলা সময় কাটাইলাম এই পেশায়। শেষ বয়সে এসে পেশা পরিবর্তন করে আর কী হবে? এইভাবে জীবন চালাইতে খুবই কষ্ট হচ্ছে। এমনিতেই বাজারত আগুন। তার উপর এই ইনকাম দিয়া চলা একদম কঠিন।’
হাসমত সরকারের স্ত্রী শিল্পী বেগম জাগো নিউজকে বলেন, ‘নিজের থাকার জায়গা বেচি বড় দুই মাইয়ার বিয়ে দিয়েছি। এখন ভাড়া বাড়িত থাকি। ছোট মাইয়াটা বিয়ে দেওয়ার উপযুক্ত হইছে। মানষের বাড়িতে কাজ করে বলে বিয়াও দিবের পাচ্ছি নে। হামার স্বামী যা আয় করে, তা দিয়ে সংসারই চলে না। কারিগর পাড়ায় হামিও সাপ্তাহিক ৩০০ টাকা চুক্তিতে কাজ করি। এই দিয়েই সংসার চলে হামাগেরে। দুই শতক জমি হলি পরে ঘর বানে থাকতে পারতাম।’
পূর্ব কামারপাড়া গ্রামের প্রবীণ আব্দুল হান্নান বেপারী জাগো নিউজকে বলেন, ‘হাসমত মানুষের বাড়িতে ভাড়া থাকে। গ্রামের ছোট থেকে বড় সবাই তাকে ঠাঠারে নামেই চেনে। তার বাপও ঠাটারে ছিলেন। তারা ছাড়া আমাদের এই গ্রামে আর কোনো ঠাটারে ছিল না। দেশে একন আধুনিক জিনিসপাতি আসায় কেউ আর ঠাটারের কাছ যায় না।’
এসইউ/জিকেএস