আজও কাঁদায় সিডর
২০০৭ সালে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে আঘাত হানে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডর, যা বিদ্যুৎ, খাদ্য এবং আশ্রয়শূন্য করে দিয়েছিলো গোটা জনপদকে। কেউ কেউ তাণ্ডবের কবল থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারলেও বাঁচাতে পারেননি নিকট আত্মীয়স্বজনকে। কারো কারো মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া গেলেও অনেকে রয়েছেন নিখোঁজ। সেদিনের সে মহাপ্রলয়ের নয় বছর কেটে গেলেও আজও স্মৃতির মানসপটে দুঃস্বপ্নের মতো ভেসে ওঠে। আজও কাঁদায় এবং ভয়ে শিউরে ওঠে এলাকার মানুষজন। সিডরের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত অন্যতম জেলা ভোলার মানুষজন বর্তমানে কেমন আছেন- তা নিয়ে ছোটন সাহার চার পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে প্রথম পর্ব।
সাগরে ট্রলার ডুবেছে, মরদেহের সন্ধান মেলেনি। তাই কারো প্রতীক্ষা স্বামীর জন্য, কারো বাবা, কারো বা ভাই আর সন্তানের। একদিন জীবিত ফিরে আসবেন তাই এ অপেক্ষা। এভাবে নয় বছর কেটে গেলেও আজো ফিরে আসেনি কেউ।
ভোলা সদরের ভেলুমিয়া ইউনিয়নের চন্দ্র প্রসাদ গ্রামে ঘূর্ণিঝড় সিডরে নিখোঁজ নয় জেলে পরিবারে এমন অপেক্ষার প্রহর যেনো কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। নয় বছর পেরিয়ে গেলেও আজও সন্ধান মেলেনি সেই নয় জেলের। অনেক খোঁজাখুঁজি করে তাদের মরদেহটাও পাওয়া যায়নি। তারা বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন- সেটাও জানে না কেউ। তবে পরিবারের সদস্যেরা আজো তাদের প্রতীক্ষায় আছেন। প্রিয়জনের কথা মনে করে কেঁদে ওঠেন ক্ষণে ক্ষণে। যেনো এ কান্নার শেষ নেই।
পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের না পেয়ে এসব পরিবারে নেমে এসেছে সীমাহীন দুর্ভোগ। স্বজনদের হারিয়ে অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে দিন কাটছে তাদের।
চন্দ্র প্রসাদ গ্রামে সরেজমিন গিয়ে জানা গেছে, জসিম মাঝির ট্রলার নিয়ে সিডরের কয়েক দিন আগে মাছ শিকারের গিয়েছিলেন ভোলার চন্দ্র প্রসাদ গ্রামের নয় জেলে। মাছ শিকার শেষে কারো নতুন ঘর তৈরি, কারো বিয়ে বা সন্তানের বই-খাতা আর স্কুলে ভর্তি করানোর কথা ছিলো। কিন্তু সিডরের ঝড়ে ট্রলারডুবিতে নিখোঁজ হয়েছেন বজলু, রুবেল, জসিম, নুরু, সহিদুল, ইব্রাহিম, মামুন, জামাল আর রুবেল নামের নয় জেলে। তারা ফিরে না আশায় অসমাপ্ত কাজগুলোর কিছুই করা হয়নি।
নিখোঁজ বজলু মালের স্ত্রী মনোয়ারা নয় বছর ধরে স্বামীর অপেক্ষায় আছেন, তার দাবি স্বামী একদিন জীবিত ফিরে আসবেন। স্বামীর প্রতীক্ষায় আজো পথ চেয়ে আছেন তিনি।
মনোয়ারা বলেন, পাঁচ মেয়ে রেখে স্বামী মাছ শিকারে গিয়ে সিডরে ট্রলারডুবিতে নিখোঁজ হয়েছেন। অন্যের বাড়ি কাজ করে একবেলা খাওয়ালেও দু’বেলা না খেয়ে দিন কাটাতে হয়েছে। মানুষের কাছ থেকে সাহায্য আর ঋণ নিয়ে দুই মেয়ে বিয়ে দিয়েছি। এখনও তিন মেয়ে রয়েছে, তাদের বিয়ে দেব কীভাবে। স্বামী থাকলে এমন দুশ্চিন্তায় পড়তে হতো না।
নিখোঁজ রুবেলের মা আমেনা খাতুন। তার বিশ্বাস ছেলে ফিরে আসবে, তাই এখনও ছেলের জন্য অপেক্ষা। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ছেলেকে বিয়ে দেয়ার জন্য মেয়ে ঠিক করে রেখেছি, বিয়ের আয়োজন করা হয়েছিলো, কথা ছিলো মাছ শিকার করে বাড়িতে ফিরলেই আনন্দ-উৎসব করে বিয়ে দেবো, কিন্তু কিছুই হলো না, ছেলে ফিরে এলো না।
নিখোঁজ জেলে জসিমের ভাই নাছির বলেন, ট্রলারডুবির পর থেকে বিভিন্ন স্থানে ভাইয়ের সন্ধান করেছি, কিন্তু কোথাও তাকে খুঁজে পাইনি। ছোট্ট তিনটি ছেলেকে নিয়ে তার স্ত্রী জেসমিন আজো স্বামীর প্রতীক্ষায় আছেন।
একই গ্রামের খালেক মাঝির ছেলে নুরু উদ্দিনও ছিলেন ওই ট্রলারের জেলে। সিডরের পর থেকে সেও নিখোঁজ। সন্ধান মেলেনি তার।
নুরু উদ্দিনের বোন মমতাজ বলেন, যেখানেই থাকুক না কেনো ভাই ফিরে আসবেই। তার মরদেহ পাওয়া যায়নি, তাই সে বেঁচে আছে।
তিনি বলেন, স্বামীর অপেক্ষা করে নুরুর স্ত্রী রাবেয়া অন্যত্র বিয়ে করেছেন। কিন্তু রেখে গেছেন দুই ছেলে। তাদের দেখাশোনা করার কেউ নেই, অসহায় ছেলেদের ভরণ-পোষণের কষ্টে দিন কাটছে তাদের।
আনিছ চৌকিদারের ছেলে সহিদুল। কথা ছিলো সাগরে মাছ শিকার করে বাড়িতে এসেই নতুন ঘর তৈরি করবেন। সহিদুলের স্ত্রী আকলিমা বলেন, ছোট্ট শিশুকে রেখে মাছ শিকারে গিয়েছিলো, বলেছিলো বাড়িতে ফিরে এসেই নতুন করে ঘর করবেন, সন্তানকে বই কিনে দেবেন। কিন্তু এসবের কিছুই হলো না। স্বামীর অপেক্ষায় এখনও পথ চেয়ে আছি।
নিখোঁজ ইব্রাহিমের বোন নাজমা বলেন, ভাইকে বিয়ে করানোর কথা ছিলো। কিন্তু ভাই ফিরে এলো না, তার কথা মনে করে আজো কেঁদে যাচ্ছি। একইভাবে নিখোঁজ মামুনের স্বজন কুলসুমও কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন একই কথা। তারা জীবিত ফিরে আসবেন- অবিরাম এমন অপেক্ষার যেনো শেষ নেই তাদের।
স্বামীর অপক্ষো করে ইউনুস খাঁর ছেলে জামাল খাঁর স্ত্রী রোকসানা অন্যত্র বিয়ে করেছেন। অভাব প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়াচ্ছে। তাই পেটের টানেই বিয়ে করছেন তিনি।
নিখোঁজ স্বজনদের অভিযোগ, সিডরের ঝড়ে নিখোঁজ হলেও সরকারের দফতর থেকে তাদের কোনো সাহায্য করা হয়নি। তাদের খোঁজ-খবরও নেয়নি কেউ।
এ ব্যাপারে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, নদীতে ঝড়-দুর্যোগসহ নিখোঁজ ব্যক্তিদের কোনো সহযোগিতা করা হয় না। তবে যাদের মরদেহ পাওয়া গেছে তাদের সহয়াতা করা হয়। সরকারে পক্ষ থেকে কখনও যদি নিখোঁজদের সহায়তা দেয়া হয়, তাহলে চন্দ্র প্রসাদের নয় জেলে পরিবারকে বরাদ্দ দেয়া হবে।
এফএ/পিআর