জামিনের দুই আসামিকে রিমান্ড
দু-একজনের নেতিবাচক কাজের ভাগিদার হয় পুরো বাহিনী: হাইকোর্ট
ছিনতাই মামলায় উচ্চ আদালত থেকে জামিন পাওয়া কয়েকজন আসামি ও তাদের স্বজনদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে ৭২ লাখ টাকা আদায়ের ঘটনায় জড়িত পুলিশ কর্মকর্তাদের বিষয়ে আদেশের জন্য আগামী ১৫ অক্টোবর দিন ঠিক করেছেন হাইকোর্ট।
উভয় পক্ষের শুনানি নিয়ে রোববার (২০ আগস্ট) হাইকোর্টের বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আমিনুল ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
আদালতে এ দিন শুনানিতে ছিলেন রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সারওয়ার হোসেন বাপ্পী। পুলিশ কর্মকর্তার পক্ষে শুনানিতে ছিলেন অ্যাডভোকেট শাহ্ মুনজুরুল হক। আর আবেদনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মুজিবুর রহমান মিয়া।
এসময় হাইকোর্ট বলেন,আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অনেক ভালো কাজ করছে। দু’একজন সদস্যের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের জন্য পুরো বাহিনীকে দায়ী করা ঠিক নয়। কিন্তু পুলিশ বাহিনীর দু’একজন সদস্যের এ ধরনের কর্মকাণ্ডে দুর্নামের ভাগিদার হতে হয় সবাইকে।
আদালত বলেন, এ মামলায় আমরা আসামিদের আগাম জামিন দিয়েছি। সেই জামিনের ল’ইয়ারস সার্টিফিকেটও ছিঁড়ে ফেলেছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। শুধু ছিঁড়েই ফেলেননি, আসামিদের গ্রেফতার করে আদালতে পাঠিয়েছেন। এমনকি রিমান্ডের আবেদন দিয়েছেন। পাশাপাশি আসামিদের গ্রেফতার করে নির্যাতন করেছেন। এত ধৃষ্টতা দেখানোর সাহস পুলিশ পায় কোথায়? এ ধরনের কর্মকাণ্ড করার পর এখন তারা সবকিছু অস্বীকার করছেন। যেন “ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাই নাই।”
তলবে উপস্থিত শরীয়তপুরের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. আল ইমরান। আদালতের প্রশ্নের জবাব তাকে দিতে হয়। এ পর্যায়ে হাইকোর্ট বলেন, পুলিশ শ্যোন অ্যারেস্টের আবেদন দিলেই আপনি সেটা মঞ্জুর করবেন, তাহলে বিচারক হয়েছেন কেন? আপনাকে জুডিসিয়াল মাইন্ড প্রয়োগ করতে হবে। মামলার নথিপত্র দেখে তবেই আদেশ দিতে হবে।
শুনানিতে আদালতে নড়িয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির ও পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। এর আগে তাদের দুজনকেই সাময়িক বরখাস্ত করেছে পুলিশ প্রশাসন।
এরও আগে গত ২৪ জুলাই আদালতে ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ (এএম) আমিন উদ্দিন। ওইদিন আদালতের নির্দেশে সকালে হাজির হন পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মুস্তাফিজুর রহমান, শরীয়তপুর জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির এবং শরীয়তপুরের চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। ওইদিন পুলিশের পক্ষ থেকে লিখিত ব্যাখ্যা আদালতে দাখিল করেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ (এএম) আমিন উদ্দিন।
এ বিষয়ে আইনজীবী মজিবুর রহমান মিয়া বলেন, জামিনে থাকার পরও তাদের ধরে নিয়ে শুধু নির্যাতনই করেনি। তাদের রিমান্ডও চাওয়া হয়েছে। আদালত প্রশ্ন তোলেন, আসামিদের জামিন হয়েছে কী হয়নি এটাতো অনলাইনে দেখা যায়। এরপরও কেন তাদের পুলিশের কাস্টডিতে দেওয়া হলো। কেন রিমান্ডে নেওয়া হলো।
আইনজীবী মজিবুর রহমান বলেন, ছিনতাই মামলায় সাতজন আসামিকে উচ্চ আদালত থেকে জামিন করাই। এ জামিনপ্রাপ্তির পরও সাতজনের মধ্যে দুইজনকে আটক করে পুলিশ। পরে তাদের নির্যাতন করে টাকা আদায় করে আদালতে সোপার্দ করেন। অন্যদিকে, আদালত জামিনের তথ্য যাচাই-বাছাই না করে আসামিদের কারাগারে পাঠিয়ে দেন। এ ঘটনায় পত্রিকার প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। এরপর বিষয়টি নিয়ে আমি আবার আদালতে উপস্থাপন করি। আদালত শুনানি নিয়ে বিচারকসহ দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে তলব করেন।
পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, উচ্চ আদালত থেকে জামিন পাওয়া কয়েকজন আসামি ও তাদের স্বজনদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে ৭২ লাখ টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। নড়িয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির ও পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ করা হয়।
এ ঘটনায় পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ও শরীয়তপুরের পুলিশ সুপারকে (এসপি) অবস্থান ব্যাখ্যা করতে বলা হয়। ওই আসামিদের বিষয়টি আদালতে উপস্থাপনের পর এ সংক্রান্ত আবেদনের শুনানি নিয়ে গত ১৩ জুন হাইকোর্টের একই বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
আদেশের বিষয়ে ওইদিন আবেদনকারী আইনজীবী অ্যাডভোকেট মুজিবুর রহমান মিয়া বলেন, একটি ছিনতাই মামলার আসামিদের শারীরিক নির্যাতন করে আহত করার অভিযোগের ব্যাখ্যা দিতে শরীয়তপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (নড়িয়া সার্কেল) রাসেল মনির ও সদ্য প্রত্যাহার হওয়া ওসি শেখ মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমানসহ চারজনকে তলব করেছিলেন হাইকোর্ট।
তিনি আরও বলেন, একই সঙ্গে উচ্চ আদালতের জামিনাদেশ থাকার পরও আসামিদের জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠানোর ঘটনায় চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে তলব করা হয়। ১৬ জুলাই তাদের সশীররে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা করতে বলা হয়। পাশাপাশি পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ও শরীয়তপুরের পুলিশ সুপারকে (এসপি) এ বিষয়ে অবস্থান ব্যাখ্যা করতে বলা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় তারা আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে গত ২৩ মে দ্রুত বিচার আইনে পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানায় একটি ছিনতাই মামলা হয়। মামলায় শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার নাওডোবা আহম্মেদ চোকদারকান্দি এলাকার সাদ্দাম চোকদার, বকুল চোকদারসহ ৯ জনকে আসামি করা হয়। সেই মামলায় ২৯ মে সাদ্দাম, বকুল, সাইদুল উচ্চ আদালত থেকে ৬ সপ্তাহের আগাম জামিনে নেন।
জামিনে আসার পর ৩০ মে রাতে তারা এ মামলার আরেক আসামি আনোয়ারকে নিয়ে ঢাকা কেরানীগঞ্জ সাদ্দামের বন্ধু আলমগীর চোকদারের বাসায় যান। ওইদিন রাতে তথ্য পেয়ে সেই বাসায় হাজির হন এএসপি রাসেল মনির ও ওসি মোস্তাফিজুর রহমান, জাজিরা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রুবেলসহ ১০ থেকে ১২ জন পুলিশ সদস্য।
আইনজীবী মুজিবুর রহমান জানান, ২৯ মে তিন আসামিকে ৬ সপ্তাহের জামিন দেন হাইকোর্ট। পরদিন ৩০ মে আসামিদের গ্রেফতার করে মারধর করা হয়। এসময় উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রুবেল উপস্থিত ছিলেন। পরদিন থানায় নিয়ে এসে আসামিদের বাবার কাছ থেকে ৭২ লাখ টাকার চেক লিখে নেওয়া হয় এবং নওডোবা বাজারে দুটি দোকান লিখে দিতে বলা হয়।
এফএইচ/এমআইএইচএস/জেআইএম