ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ক্যাম্পাস

তদন্ত শেষ হয়নি ১০ মাসেও

আওয়ামী সহযোগিতায় ১২ বছর ছুটিতে বিএনপিপন্থি শিক্ষক!

ইরফান উল্লাহ | প্রকাশিত: ০১:১৭ পিএম, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) এক অধ্যাপকের রহস্যময় ছুটি নিয়ে প্রশাসনের নীরব অবস্থানের অভিযোগ উঠেছে। এই বিষয়ে তদন্ত কমিটির মেয়াদ ১০ মাস পর হলেও প্রতিবেদন জমা হয়নি। অভিযুক্ত ওই শিক্ষক লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. এস এম শফিকুল আলম।

তথ্য মতে ২২ বছরের চাকরি জীবনে প্রায় ১২ বছরই ছুটিতে কেটেছে তার। এদিকে তার বিভিন্ন মেয়াদে ভোগ করা ছুটির বৈধতা ও আওয়ামী প্রশাসনের সঙ্গে লেনদেন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জিয়া পরিষদ নেতাসহ একাধিক শিক্ষক।

জানা যায়, অধ্যাপক ড. এস এম শফিকুল আলম চাকরিতে যোগদান করেন ২০০৩ সালের ১১ ডিসেম্বর। পরে ২০০৬ সালের ১২ ডিসেম্বর তিনি সহকারী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান। তার দীর্ঘ ছুটি ভোগের যাত্রা শুরু হয় ২০১০ সালের ২৯ জুন। তিনি ২০১০ সালের আগস্ট থেকে ২০১৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত পাঁচ বছর সবেতনে শিক্ষা ছুটি ও পরবর্তীকালে ২০১৬ সালের নভেম্বর পর্যন্ত এক বছর দুই মাসের বেশি সময় বিনা বেতনে ছুটি ভোগ করেন। এরপর ২০১৭ সাল থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত তিনি চিকিৎসা ও শ্রান্তিবিনোদনের জন্য একাধিকবার অর্জিত ও অর্ধগড় বেতনের ছুটি নেন। এর মধ্যে ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে ২০১৯ সালের আগস্ট পর্যন্ত এক বছর স্যবটিক্যাল ছুটিও ছিল।

সর্বশেষ তিনি চিকিৎসা ও ফিনল্যান্ডে অবস্থানের জন্য ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অর্জিত ছুটি নেন। ছুটি শেষে ২০২৩ সালের ১ মার্চ তার কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার কথা থাকলেও তিনি আর যোগদান করেননি। ফলে প্রতিবেদন লেখার সময়কাল অর্থাৎ ২০২৫ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত তিনি কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ব্যতীত কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন। সব মিলিয়ে তিনি মোট ৩৩০১ দিন (প্রায় ৯ বছর) ছুটি ভোগ করেছেন ও পরবর্তীতে ৯৭৪ দিন (প্রায় আড়াই বছরেরও বেশি সময়) ধরে কর্মস্থলে অননুমোদিতভাবে অনুপস্থিত আছেন।

এদিকে অর্থ ও হিসাব শাখায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে তার বেতন স্থগিত করা হয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে তিনি বিদেশে অবস্থান করলেও তার বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।

এদিকে গত ১০ ফেব্রুয়ারি তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বর্তমান উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম এয়াকুব আলীকে আহ্বায়ক, আল ফিকহ অ্যান্ড ল’ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আনোয়ারুল ওহাবকে সদস্য এবং উপ-রেজিস্ট্রার আলীবদ্দীন খানকে সদস্যসচিব করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে প্রশাসন। তবে দীর্ঘ ১০ মাস পেরোলেও প্রতিবেদন জমা দেয়নি ওই কমিটি।

আরও পড়ুন:
অবৈধভাবে ডরমিটরিতে বসবাসের তালিকায় উপ-উপাচার্য!
ইবির আইন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক জহুরুল ইসলামকে চাকরিচ্যুত
অভ্যুত্থানবিরোধী ভূমিকা রাখায় ‌‘ফ্যাসিস্ট’ ১৯ শিক্ষককে শোকজ

এ বিষয় পূর্ববর্তী প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে জিয়া পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক ড. ফারুকুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘উনি আমাদের বিএনপির লোক বলেই আমি জানি। বিরোধী মতাদর্শী হওয়া সত্ত্বেও তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রশাসনের কাছ থেকে এত দীর্ঘদিনের ছুটিসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পাওয়া আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে। কীভাবে এত ছুটি পেয়েছে এইটা আমার কাছে একটু কনফিউশন মনে হয়েছে।’

ছুটির নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিষয়টি আমার কাছে অবাক লেগেছে। সে ভিন্নমতের শিক্ষক হয়েও শতভাগ ঠিক ছুটি সে হয়তো নিয়েছে। কিন্তু এই ছুটিগুলো বিচার বিবেচনা করে দেওয়া দরকার। একজন মানুষ ছুটি চাইলেই পাওয়া উচিত না, তার ছুটি ডিপার্টমেন্টের কাজে লাগতে হবে। আমাদের ইউনিভার্সিটির অনেক সিস্টেম আছে যেগুলো খুব খারাপ সিস্টেম। এর ফায়দা নিয়ে ফাঁক-ফোঁকড়ে অনেকেই সুযোগ নিয়ে যায়। কিন্তু এটা বন্ধ করা দরকার। একটা সংস্কার প্রক্রিয়া চালানো দরকার।’

ওই শিক্ষক জিয়া পরিষদের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে দলীয় কোনো সিদ্ধান্ত আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দলীয়ভাবে সে আমাদের সঙ্গে কানেক্টেড না। সে দলে ছিল, এটা আমার মনে আছে। তবে এই ১২-১৪ বছর আমি তার কোনো খোঁজখবর জানি না।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক বলেন, ‘সাধারণত ছুটি নিতে হলে প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তর ঘুরে কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হয়। ফ্যাসিস্ট শাসনামলে আওয়ামী প্রশাসনের বিপরীত মতাদর্শ ও জিয়া পরিষদের কোনো সদস্য এই অস্বাভাবিক ছুটি পাওয়া ছিল অসম্ভব। এ ক্ষেত্রে ধরে নেওয়া যায় প্রশাসনের কোনো একটি হাত অথবা পুরো চক্র লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। আর শিক্ষাছুটির পরে নির্দিষ্ট একটি সময় কাজে উপস্থিতির বিষয় থাকলেও তিনি তা করেননি।’

আরও পড়ুন:
অর্থসংকটে স্থবির ইবির নির্মাণাধীন হল, সাইট ছাড়লেন শতাধিক শ্রমিক
গঠনতন্ত্র প্রণয়নে ধীরগতি, ইকসু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা
পারিবারিক কারণ দেখিয়েও রাজনৈতিক বিবেচনায় ভর্তি ছাত্রদল নেতা

তিনি আরও বলেন, ‘সাধারণত ২৫ বছর চাকরি (বা সুপারিশ অনুযায়ী ১৫ বছর) পূর্ণ হলে বা অবসরে গেলে পেনশন চালু হয়। এ ক্ষেত্রে পেনশন পাওয়ার জন্য ওই শিক্ষক এই অসৎ উদ্দেশ্য লালন করতেও পারেন। তিনি নিয়মের তোয়াক্কা না করে বিগত সময়ের ও বর্তমান প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের কাছ থেকে এই ছুটির সুবিধা ভোগ করে চলেছেন। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় জীবনযাপন করছেন। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, তিনি কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ব্যতীত দেশের বাইরে অবস্থান করলেও বর্তমান প্রশাসন নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।’

শফিকুল আলমের ছুটির পদ্ধতিগত বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষক সেলের উপ-রেজিস্ট্রার এনামুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, ওই শিক্ষক ২০২৩ সালের ১ মার্চ থেকে কর্মস্থলে অনুপস্থিত। পূর্ববর্তী সব প্রশাসন তার ছুটি মঞ্জুর করার কারণেই এত দীর্ঘ সময় তিনি ছুটি ভোগ করেছেন।

বিষয়টি নিয়ে গত ২৯ নভেম্বর তদন্ত গঠিত কমিটির সদস্য সচিব উপ-রেজিস্ট্রার আলীবদ্দীন খান বলেন, ‘আমাদের কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে। আমরা অফিশিয়ালভাবে এটা ভাইস চ্যান্সেলর মহোদয়ের কাছে বুধবারে (৩ ডিসেম্বর) জমা দেব।’

শনিবার (৬ ডিসেম্বর) তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত সপ্তাহে আমি প্রোভিসি স্যারকে দেখিয়েছি তবে এতে কিছু সংশোধন হয়েছে তাই রোববার (৭ ডিসেম্বর) মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হবে।’

তদন্তের অবজার্ভেশন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সই না হওয়া পর্যন্ত এটা বলা যাচ্ছে না। আমরা এটা উপাচার্যের কাছে জমা দেব।’

এ বিষয়ে অভিযুক্ত শিক্ষক ড. এস এম শফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, বর্তমানে তিনি ফিনল্যান্ডের নাগরিকত্ব পেয়ে সেখানে স্ত্রী-বাচ্চাসহ অবস্থান করছেন। তিনি বলেন, ‘গতবছর আমার শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় আমি দেশে ফিরতে পারিনি। আগামী সপ্তাহে সর্বশেষ মেডিকেল চেকআপ আছে। সেটার পর ডিসেম্বরে দেশে ফিরে আমি চাকরি থেকে রিজাইন দিতে চাই। আমার বর্তমান শারীরিক অবস্থা অনেক খারাপ। ছাত্রদের টিচিং করার মতো সামর্থ্য নেই আমার।’

সম্প্রতি পোস্ট ডক্টোরাল গবেষণা ছুটি শেষে নির্ধারিত সময়ে কর্মস্থলে যোগদান না করায় চাকরিচ্যুত হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি (আইসিটি) বিভাগের অধ্যাপক ড. বিকাশ চন্দ্র সিংহ। বিশ্ববিদ্যালয়ে শৃঙ্খলা বিধি লঙ্ঘন হওয়ায় গত ১০ জুন থেকে তাকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়।

এমএন/জেআইএম