লক্ষ্মীপুর
মাদকের ছোবলে বাড়ছে অশান্তি-অপরাধ
লক্ষ্মীপুরে ছেলের হাতে বাবা, স্বামীর হাতে স্ত্রী ও বন্ধুর হাতে বন্ধু হত্যাসহ নানা ধরনের অপরাধ ঘটে চলেছে অহরহ। এছাড়াও প্রতিদিনই ডাকাতি, চুরি-ছিনতাই, কিশোর গ্যাংসহ সামাজিক অপরাধ ও বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব অপরাধের নেপথ্য খুঁজতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে অধিকাংশই ঘটনার পেছনেই রয়েছে মাদকের ছোবল। মাদক সেবনের জন্য টাকা না পেয়ে বৃদ্ধ মা-বাবাসহ পরিবারের সদস্যদের মারধর ও বাসাবাড়িতে ভাঙচুর করার ঘটনাও ঘটছে। এ নিয়ে অভিভাবকদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে।
জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির প্রতিটি মাসিক সভায় একাধিক বক্তা মাদকের কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে উপস্থাপন করেন। কিন্তু রাজনৈতিক মদদ আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘ম্যানেজের’ কারণে আশানুরূপ সুফল আসছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।
সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, মাদকরোধে আইনের শাসন আর রাজনীতিবীদদের অঙ্গীকার প্রয়োজন। এ ব্যবসার সঙ্গে জনপ্রতিনিধিরাও জড়িত। মাদক ব্যবসায়ীরা রাতারাতি কোটিপতি হয়। এ লোভ অন্যদেরও টানে। এ সংকট রুখতে পারিবারিক-সামাজিক আন্দোলনের পাশাপাশি নৈতিকতা-মূলোবোধ জাগ্রত করার তাগিদ দিতে হবে।
‘গ্রামেও এখন রাজনৈতিক মদদে ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা বিক্রি হচ্ছে। মোবাইলফোনে বিক্রেতার সঙ্গে চুক্তি করে চলার পথে মাদক হাতবদল হয়। বিকাশেও টাকা লেনদেন হয়।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলার গ্রামগুলোতে ফেরি করে বিক্রি হচ্ছে ইয়াবা ও গাঁজা। এসব সেবনে নেশায় ডুবছে তরুণ-যুবকরা। এর প্রভাবে মাদকাসক্তদের ঘরে ঘরে দেখা দিয়েছে অশান্তি।
জানা যায়, গত বছরের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত জেলায় মাদকাসক্তদের হাতে ৭টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে আলোচিত সদরের বশিকপুরে বসতঘরের দরজা তালা দিয়ে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দুই সন্তানসহ স্ত্রীকে হত্যা, রামগতির চরকলাকোপা গ্রামে কুপিয়ে স্ত্রী-শ্বশুরকে হত্যার অন্যতম। এছাড়া সদরের গঙ্গাপুর গ্রামে ছেলের হাতে মা, উত্তর টুমচর গ্রামে ভাইয়ের হাতে ভাই খুন হওয়ার ঘটনা ঘটে।
- আরও পড়ুন:
লক্ষ্মীপুরে অস্ত্র-ইয়াবাসহ ৩ যুবক আটক
যৌথবাহিনীর অভিযানে ফেনসিডিলসহ জুলাই যোদ্ধা আটক
নেশার টাকা না পেয়ে বাবাকে কুপিয়ে মারলো ছেলে
এছাড়া গত ১ জুন মাদক ব্যবসার দ্বন্দ্বে লক্ষ্মীপুর সদরের উত্তর জয়পুরে আজাদ হোসেন বাবলু নামে একজনকে কুপিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষ। ১১ জুন রায়পুর উপজেলার উত্তর চরবংশী গ্রামে মাদক ব্যবসার প্রতিবাদ করায় বৃদ্ধ আলী দেওয়ানকে কুপিয়ে হত্যা করে মামুন নামে মাদকাসক্ত ছেলে। ১১ এপ্রিল সদরের পূর্ব চৌপল্লী গ্রামে মাদকের দ্বন্দ্বে রুবেল হোসেন নামে একজনকে গুলি করা হয়। ৯ এপ্রিল লক্ষ্মীপুর উত্তর তেমুহনীর নিউ মার্কেটের ছাদে কলেজছাত্র সিরাজ ৩ বন্ধুকে গাঁজা সেবনকালে ছাদ থেকে গেলে ঢাকায় নেওয়ার পথে তিনি মারা যায়। ১৫ মার্চ রাতে পৌরসভার কালু হাজী সড়কের ভাড়া বাসায় ঘুমন্ত স্ত্রী রিনা বেগমের দুই পায়ের রগ কেটে মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে জখম ও পাথর দিয়ে হাত-পা থেতলে নির্যাতনের অভিযোগ উঠে মদ্যপ স্বামী আলমগীরের বিরুদ্ধে।
এছাড়াও সদরের লতিফপুর গ্রামে প্রতিবাদ করায় ৮ সেপ্টেম্বর অষ্টম শ্রেণির ছাত্রসহ ১০ তরুণ-যুবকের বিরুদ্ধে মামলা করে মাদক কারবারি আবুল কালাম জহির। তিনি ৬ মাদক মামলার আসামি ও পুলিশের তালিকাভুক্ত ব্যবসায়ী।
‘মাদক নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে কঠোর অবস্থান প্রয়োজন। মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে পুলিশ যথাযথ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করলেও মানুষ আদালতে সাক্ষ্য দেয় না। মাদকের সঙ্গে পুলিশের কোনো দুর্বলতা-আপস নেই। এর উদ্ধার ও বিক্রেতাদের গ্রেফতারে নিয়মিত অভিযান চলছে।’
র্যাব-১১ জানিয়েছে, ২০২৩ সালের ৩ জানুয়ারি লক্ষ্মীপুরে সবচেয়ে বড় ইয়াবার চালানসহ সদরের চর রমনী ইউপি সদস্য (মেম্বার) মনির হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়। তার কাছে ৮৫ হাজার ইয়াবা পাওয়া যায়। এরপর মনির ও তার সহযোগীদের তথ্য মতে, কয়েক ধাপে লক্ষাধিক ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।
পুলিশ জানিয়েছে, ৯ মার্চ রায়পুরে ইয়াবা-গাঁজাসহ মাদক ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেন মাইকেল ও পরান হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়। ওই দুই যুবকের বিরুদ্ধে থানায় ২১টি মামলা রয়েছে। তারা গ্রেফতার হলে আইনের ফাঁক দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে জামিনে বের হয়ে ফের এ ব্যবসা শুরু করেন। অন্য মাদক কারবারিদেরও একই অবস্থা।
- আরও পড়ুন:
‘অনিরাপদ’ গাজীপুর সিটি, ৬ হাজার মানুষের নিরাপত্তায় একজন পুলিশ - চড়া দামে ইলিশের স্বাদ ভুলতে বসেছে মানুষ
- এক মণ কচুরিপানা বিক্রির টাকায় মিলছে দুই মণ ধান
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৬ সালে লক্ষ্মীপুর জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। এর আগে নোয়াখালী থেকে এ জেলা নিয়ন্ত্রণ করা হতো।
জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কার্যালয় সূত্র জানায়, সদর, রায়পুর, রামগঞ্জ, কমলনগর ও রামগতিতে গত এক বছরে তাদের ১ হাজার ২৮৭টি অভিযান হয়। এসময়ে ২ হাজার ৯২৯ পিস ইয়াবা, ৪৭ কেজি গাঁজা, দেশীয় মদ উদ্ধার করা হয়। এসব ঘটনায় ১৬৬টি মামলায় ১৬৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
ওই কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের ভাষ্য মতে, লক্ষ্মীপুরে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ৪২ জন। এরমধ্যে গডফাদার ৮, পাইকারি বিক্রেতা ১৩ এবং খুচরা বিক্রেতা ১৯ জন।
জেলা পুলিশ বিভাগ জানিয়েছেন, লক্ষ্মীপুরে গত এক বছরে অভিযানে ১৮ হাজার ১৭৬ পিস ইয়াবা, ৪ মণ গাঁজাসহ বেশ কিছু বিদেশি ও চোলাই মদ উদ্ধার করা হয়। এসব ঘটনায় ২৬০টি মামলায় ৩৪০ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রায়পুর ও সদর উপজেলার তিনজন ইউপি চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, গ্রামেও এখন রাজনৈতিক মদদে ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা বিক্রি হচ্ছে। মোবাইলফোনে বিক্রেতার সঙ্গে চুক্তি করে চলার পথে মাদক হাতবদল হয়। বিকাশেও টাকা লেনদেন হয়।
মাদক সহজলভ্য হওয়ায় খুনোখুনি বাড়ছে জানিয়ে লক্ষ্মীপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি হোসাইন আহমেদ হেলাল বলেন, এজন্য আইনের শাসন আর রাজনীতিবিদদের অঙ্গীকার প্রয়োজন। মাদক কারবারিরা রাতারাতি কোটিপতি হয়। এ লোভ অন্যদেরও টানে। মামলার দুর্বলতার কারণেই আসামিরা জামিনে বেরিয়ে ফের মাদক ব্যবসা শুরু করে। আমরা বলে-লেখেও লাভ নেই।
জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়ের পরিদর্শক আবদুর রহিম বলেন, লক্ষ্মীপুরে মাদকের ব্যবহার ও বিক্রি আগের চেয়ে তুলনামূলক কিছুটা বেড়েছে। রাজনৈতিক মদদে অনেকে এ ব্যবসা করছেন। তবে আমাদের নিয়মিত অভিযান চলছে। পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতিমাসেই আমরা স্কুল-কলেজে আলোচনা সভা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা করছি।
জেলা বিএনপির যুগ্ম-আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট হাছিবুর রহমান বলেন, পুলিশের দুর্বলতার কারণে মাদক ব্যবসার বিস্তার ঘটছে। এজন্য পুলিশ, সেনাবাহিনীসহ যৌথ অভিযান প্রয়োজন। আমাদের দলের কোনো নেতাকর্মী এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
লক্ষ্মীপুর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড আপস) মো. হাসান মোস্তফা স্বপন বলেন, মাদক নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে কঠোর অবস্থান প্রয়োজন। মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে পুলিশ যথাযথ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করলেও মানুষ আদালতে সাক্ষ্য দেয় না। মাদকের সঙ্গে পুলিশের কোনো দুর্বলতা-আপস নেই। এর উদ্ধার ও বিক্রেতাদের গ্রেফতারে নিয়মিত অভিযান চলছে।
কাজল কায়েস/এমএন/জেআইএম