ভিডিও EN
  1. Home/
  2. একুশে বইমেলা

বই আলোচনা

দেশে বিদেশে: মানুষ যেখানে মানচিত্রের চেয়ে বড়

সাহিত্য ডেস্ক | প্রকাশিত: ০৩:০৮ পিএম, ০২ অক্টোবর ২০২৫

অনিরুদ্ধ সাজ্জাদ

আচ্ছা, একটা বই পড়ে আপনার কখনো এমন মনে হয়েছে যে, এখনই ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে? অথবা মাঝরাতে হঠাৎ করেই মনে হয়েছে, রান্নাঘরে গিয়ে দেখি তো পোলাও রান্না করার মতো চাল-ডাল-মাংস কিছু আছে কি না? যদি আপনার উত্তর ‘না’ হয়, তবে ধরে নিতে হবে, আপনি সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশে বিদেশে’ বইটি এখনো পড়েননি। আর যদি পড়ে থাকেন, তবে আপনি নিশ্চিতভাবেই আমার দলের লোক। যে দলের সদস্যরা বইয়ের পাতায় কাবাবের ঘ্রাণ পায়, বরফঢাকা কাবুলের শীত নিজের ঘাড়ে অনুভব করে এবং আবদুর রহমান নামের একজন বাবুর্চির জন্য মন খারাপ করে।

বাংলা সাহিত্যে ভ্রমণকাহিনি নেহাত কম লেখা হয়নি। কিন্তু সব ভ্রমণকাহিনি ‘দেশে বিদেশে’ হয়ে ওঠে না। কারণ, মুজতবা আলী কেবল একজন পর্যটক ছিলেন না; তিনি ছিলেন একজন রসিক পর্যটক, একজন গল্পকার এবং সবচেয়ে বড় কথা, তিনি ছিলেন একজন মানুষ-সংগ্রাহক। তিনি যেখানেই গেছেন, সেখানকার পথঘাট, দালানকোঠার চেয়ে বেশি করে সেখানকার মানুষগুলোকে নিজের মনের অ্যালবামে তুলে রেখেছেন। আর সেই অ্যালবাম যখন তিনি পাঠকের সামনে খুলে ধরেন, তখন আমরা হাওড়া স্টেশন থেকে পেশাওয়ার হয়ে কাবুল পর্যন্ত একটা আস্ত জীবনকে চাক্ষুষ দেখি।

বইয়ের শুরুটা ঠিক যেন কোনো সিনেমার প্রথম দৃশ্য। হাওড়া স্টেশনের সেই ভিড়, মানুষের কোলাহল, টিকিট চেকারের হাঁকডাক, সব মিলিয়ে এক জীবন্ত ক্যানভাস। এখান থেকেই লেখকের যাত্রা শুরু, গন্তব্য আফগানিস্তান। কিন্তু আফগানিস্তানে পৌঁছানোর আগে পথিমধ্যে যে ছোট ছোট স্টেশনগুলো আসে, সেগুলোও কম আকর্ষণীয় নয়। বিশেষ করে পেশাওয়ারের বর্ণনা যখন পড়ছিলাম, তখন মনে হচ্ছিল, এ তো এক হারানো দিনের ছবির মতো। সেখানকার পাঠানদের সরলতা, আতিথেয়তা আর বন্ধুত্বের যে চিত্র মুজতবা আলী এঁকেছেন, তা আজকের এই জটিল পৃথিবীতে বসে পড়লে রূপকথার মতো মনে হয়।

পাঠানদের জীবনযাপনের দর্শনটাও অদ্ভুত। লেখকের ভাষায়, তাদের কাছে অবসর কাটানোর অন্যতম সেরা উপায় হলো বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া, আর সেই আড্ডাকে দীর্ঘায়িত করার জন্য সাইকেলের চাকার পিন খুলে ফেলার মতো ছেলেমানুষি করা! ভাবুন তো একবার, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমরা যেখানে প্রতি মিনিটে হোয়াটসঅ্যাপ বা মেসেঞ্জারের নোটিফিকেশন চেক করি, সেখানে একদল লোক ঘণ্টার পর ঘণ্টা একসঙ্গে বসে গল্প করছে, চা খাচ্ছে আর নির্ভেজাল হাসিতে ফেটে পড়ছে। এই চিত্র আমাদের মনে করিয়ে দেয়, জীবনকে উপভোগ করার জন্য খুব বেশি উপকরণের প্রয়োজন হয় না, প্রয়োজন হয় কিছু ভালো মনের মানুষের।

আর সেই মানুষগুলোর আপ্যায়নের কথা? সে তো এক মহাকাব্য! পোলাও, কোর্মা, রেজালা, শিক কাবাব, শামি কাবাব, খাবারের এমন তালিকা আর তার এমন স্বাদু বর্ণনা আপনি খুব কম বইতেই পাবেন। মুজতবা আলী যখন খাবারের বর্ণনা দেন, তখন মনে হয় তিনি শুধু স্বাদ বা গন্ধের কথা বলছেন না, তিনি আসলে সেই খাবারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা একটা সংস্কৃতির কথা বলছেন। লেখকের বর্ণনায়, সেই খাবার শুধু পেট ভরার জন্য নয় বরং তা ছিল বন্ধুত্বের প্রতীক, আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশ। লেখকের ভাষায়, লান্ডিকোটাল থেকে পেশোয়ারে পৌঁছানোর দীর্ঘ যাত্রায় আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে তিন দিন করে থাকতে থাকতে আর তাদের আপ্যায়ন গ্রহণ করতে করতে সময় কীভাবে কেটে যেত, তার হিসেব থাকত না। এই ধীরগতির জীবনই হয়তো মানুষকে একে অপরের কাছাকাছি আসার সুযোগ করে দিতো।

বইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং আমার মতে, সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হলো কাবুল পর্ব। খাইবার পাসের রুক্ষ, বিপদসংকুল পথ পেরিয়ে বরফঢাকা আফগানিস্তানের রাজধানীতে লেখকের প্রবেশ। আর সেখানেই তার পরিচয় হয় আবদুর রহমান নামের এক অসামান্য চরিত্রের সঙ্গে। আবদুর রহমান লেখকের পার্সোনাল বাবুর্চি কিন্তু সে কেবলই একজন কর্মচারী নয়। সে লেখকের বন্ধু, অভিভাবক এবং আফগান জীবনের এক জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া। পানশিরের বরফে সাত দিন আটকে থাকার গল্প কিংবা তার রান্নার পেছনের ছোট ছোট রহস্যগুলো যখন লেখক আমাদের সামনে তুলে ধরেন, তখন আবদুর রহমান আর বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ থাকেন না, তিনি যেন আমাদের পরিচিত কেউ হয়ে ওঠেন।

আরও পড়ুন
হাজার রঙের ক্যানভাস: আলো-অন্ধকারের কথা 
হ‌ুমায়ূন আহমেদের ‘১৯৭১’: অনন্য সৃষ্টি 

আমার কাছে আবদুর রহমান চরিত্রটি এই বইয়ের এক নীরব নায়ক। তার পোলাও রান্নার যে বর্ণনা লেখক দিয়েছেন, তা পড়লে জিভে জল আসতে বাধ্য। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হলো তার ব্যক্তিত্ব। চরম প্রতিকূলতার মধ্যেও অবিচল থাকা, নিজের দায়িত্ববোধ এবং সর্বোপরি তার মনিবের প্রতি যে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা, তা আজকের দিনে প্রায় দুর্লভ। আবদুর রহমানের মাধ্যমেই মুজতবা আলী আমাদের আফগানিস্তানের ভেতরের রূপটা দেখিয়েছেন। যে আফগানিস্তানকে আমরা আজ কেবল যুদ্ধ, সংঘাত আর তালেবানের দেশ হিসেবে চিনি, সেই দেশের মানুষের মনে যে এতটা মায়া, এতটা আন্তরিকতা লুকিয়ে থাকতে পারে, ‘দেশে বিদেশে’ না পড়লে তা হয়তো অজানাই থেকে যেত।

মুজতবা আলীর গদ্য নিয়েও কিছু কথা বলা প্রয়োজন। তিনি যে কত বড় মাপের পণ্ডিত ছিলেন, তা তার লেখার প্রতিটি ছত্রে স্পষ্ট। সংস্কৃত, ফারসি, পশতু, ফরাসি, জার্মান, কত ভাষার শব্দ যে তিনি তার লেখায় অনায়াসে ব্যবহার করেছেন, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। কিন্তু পাণ্ডিত্য জাহির করার জন্য নয় বরং বিষয়বস্তুর গভীরতাকে বোঝানোর জন্যই তিনি এই বহুভাষিকতার আশ্রয় নিয়েছেন। তার ভাষা এতটাই সহজ, প্রাঞ্জল আর সরস যে পড়তে শুরু করলে মনে হয়, লেখক যেন আপনার সামনে বসে গল্প বলছেন। তার রসবোধ অসাধারণ। সুক্ষ্ম থেকে সুক্ষ্মতর বিষয়ের বর্ণনা দিতে গিয়েও তিনি এমন সব মন্তব্য করেন, যা পাঠককে না হাসিয়ে ছাড়ে না। কলকাতার বাড়িতে সবুজ কালির কলম দিয়ে লেখার অভ্যাস কিংবা পরিচিতদের কাছে নিজের লেখা পড়ে শোনানোর যে চিত্র তিনি এঁকেছেন, তা আমাদের এক অন্য মুজতবা আলীকে চিনতে সাহায্য করে।

এই বই পড়ার পর আমার ব্যক্তিগত একটি উপলব্ধি হয়েছে। আজকের দিনে আমরা ভ্রমণ বলতে বুঝি দ্রুত এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পৌঁছানো, কিছু দর্শনীয় স্থান দেখা, ছবি তোলা এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করা। কিন্তু মুজতবা আলীর ভ্রমণ ছিল অন্যরকম। তার ভ্রমণ ছিল ‘অভিজ্ঞতা’ সঞ্চয়ের ভ্রমণ। তিনি কেবল স্থান পরিবর্তন করেননি, তিনি সেই স্থানের মানুষের সঙ্গে মিশেছেন, তাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে বোঝার চেষ্টা করেছেন, তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়েছেন। এজন্যই তার ভ্রমণকাহিনি কেবল নিছক বর্ণনা হয়ে থাকেনি, তা হয়ে উঠেছে এক জীবন্ত দলিল।

‘দেশে বিদেশে’ একটি সময়ের দলিলও বটে। ১৯২৭ থেকে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন, বাচ্চা-ই-সাক্কাওর বিদ্রোহ এবং আমানুল্লাহ খানের পতনের মতো ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো লেখক খুব কাছ থেকে দেখেছেন এবং তার নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছেন। ফলে, বইটি পড়ার সময় আমরা কেবল একজন পর্যটকের অভিজ্ঞতার শরিক হই না, আমরা একটা দেশের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে উঠি।

পরিশেষে একটা কথাই বলতে চাই, ‘দেশে বিদেশে’ এমন একটি বই যা বারবার পড়া যায়। প্রতিবার পড়ার সময় নতুন কিছু আবিষ্কার করা যায়। এটি এমন এক সফর, যা আপনাকে হাসাবে, কাঁদাবে, ভাবাবে এবং সবচেয়ে বড় কথা, আপনাকে মানুষের ওপর বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে। আজকের এই বিভেদ আর অবিশ্বাসের পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে আফগানিস্তানের রুক্ষ প্রান্তরের মানুষের সরলতা আর আন্তরিকতার গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, দেশ, কাল, ধর্ম, ভাষার ঊর্ধ্বে সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো ‘মানুষ’।

লেখক: শিক্ষার্থী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।

এসইউ/জিকেএস

আরও পড়ুন