ভিডিও EN
  1. Home/
  2. আইন-আদালত

সিআইডির চূড়ান্ত প্রতিবেদন

কর্নেল নাজমুল হুদা হত্যাকাণ্ডে জিয়াউর রহমানের সম্পৃক্ততা মেলেনি

আশিকুজ্জামান | প্রকাশিত: ০৭:৩৮ পিএম, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা বীর বিক্রম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দীর্ঘ তদন্ত শেষে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। দীর্ঘ ৪৭ বছর পর করা মামলার তদন্তে হত্যাকাণ্ডের সত্যতা পাওয়া গেলেও অভিযুক্ত হিসেবে যাদের নাম এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ মেলেনি।

সিআইডির প্রতিবেদনে তৎকালীন সেনাপ্রধান ও শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, মেজর (অব.) মো. আবদুল জলিল ও মেজর (অব.) আসাদ উজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি জানিয়ে তাদের মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

এছাড়া তদন্তে ওই হত্যাকাণ্ডে লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) আবু তাহেরের দায় থাকার ধারণা দেওয়া হলেও মৃত হওয়ায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেননি তদন্ত কর্মকর্তা।

সম্প্রতি ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির ঢাকা মেট্রোর পরিদর্শক সিকদার মহিতুল আলম।

৪৭ বছর পর মামলা

ঘটনার ৪৭ বছর পর ২০২৩ সালের ১০ মে ঢাকা মহানগর পুলিশের শেরেবাংলা নগর থানায় মামলাটি করে কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদার মেয়ে সাবেক সংসদ সদস্য নাহিদ ইজাহার খান। ঘটনার সময় তার বয়স ছিল মাত্র পাঁচ বছর।

মামলায় পূর্বপরিকল্পিতভাবে হত্যা এবং হত্যাকাণ্ডে সহায়তা ও প্ররোচনার অপরাধের অভিযোগে দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর ৩০২/১০৯/৩৪ ধারায় মামলা হয়েছে।

মামলার নথিতে নাহিদ ইজাহার বলেন, ওই সময় তার বাবা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৭২ ব্রিগেডের কমান্ডার হিসেবে রংপুরে কর্মরত ছিলেন। সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থানের সময় জাতীয় সংসদ ভবন প্রাঙ্গণে সেনাবাহিনীর বিপথগামী ও বিশৃঙ্খল সদস্যদের হাতে তার বাবা শহীদ হন। একই ঘটনায় সেক্টর কমান্ডার বীর উত্তম মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ এবং বীর বিক্রম লে. কর্নেল এ টি এম হায়দারও নিহত হন।

তিনি মামলায় আরও উল্লেখ করেন, পরে তার বাবার কোর্সমেট, সহকর্মী ও বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানতে পারেন ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সকালে কর্নেল নাজমুল হুদাসহ অন্য দুই সামরিক কর্মকর্তা দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসে অবস্থান করছিলেন, যা তখন ঢাকার জাতীয় সংসদ ভবনের এমপি হোস্টেলে অস্থায়ীভাবে ছিল। নাশতার সময় দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি থেকে টেলিফোনে একটি কল আসার পর দশম ইস্ট বেঙ্গলের কর্মকর্তারা তাদের বাইরে নিয়ে যান।

আরও পড়ুন
বীর বিক্রম নাজমুল হুদা খুনের ৪৮ বছর পর মামলা, নির্দেশদাতা জিয়া
৪৮ বছর পরে কার স্বার্থে কর্নেল নাজমুল হত্যা মামলা, প্রশ্ন অলির
২৫ ডিসেম্বর দেশে ফিরছেন তারেক রহমান

মামলার অভিযোগ অনুযায়ী, তৎকালীন সেনাপ্রধান ও শহীদ রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান, জাসদ নেতা লে. কর্নেল (অব.) আবু তাহের, মেজর (অব.) মো. আব্দুল জলিল এবং দশম ইস্ট বেঙ্গলের অন্যান্য কর্মকর্তা, জেসিও ও সৈনিকসহ আনুমানিক ২০-২৫ জন অজ্ঞাতনামা সদস্য সংঘবদ্ধভাবে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ভোর ৪টা থেকে সকাল ৮টার মধ্যে জাতীয় সংসদ ভবনের এমপি হোস্টেলের মাঠে কর্নেল নাজমুল হুদাসহ তিন সামরিক কর্মকর্তাকে গুলি করে হত্যা করেন। একই সঙ্গে মৃত্যু নিশ্চিত করতে বেয়নেট চার্জ করেন। হত্যাকাণ্ডের সময় দশম ইস্ট বেঙ্গলের কর্মকর্তা লে. কর্নেল সিরাজ (তৎকালীন ক্যাপ্টেন) ও মেজর মুকতাদির (তৎকালীন ক্যাপ্টেন) ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।

নাহিদ ইজাহার মহান মুক্তিযুদ্ধে বাবার অবদানও উল্লেখ করে মামলার নথিতে বলেন, কর্নেল নাজমুল হুদা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন এবং যশোরের ৮ নম্বর সেক্টরের বয়রা সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার নেতৃত্বে গরিবপুরের ট্যাংক যুদ্ধ ও চৌগাছা যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী পরাজিত হয় এবং ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর যশোর বাংলাদেশের প্রথম মুক্ত জেলা হিসেবে স্বাধীন হয়।

মামলায় সেসময় তিনি লিখেছেন, দীর্ঘদিন ধরে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি এবং পরিবারটি অবহেলা ও অপমানের শিকার হয়েছে। বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সরকারের সময়ে তিনি তার বাবাসহ তিন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সামরিক কর্মকর্তার হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার দাবি করেন এবং নিয়মিত মামলা রুজু করে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানান।

মামলায় সংযুক্তি হিসেবে মৃত্যুসনদ এবং মেজর আসাদউজ্জামানের একটি ছবি জমা দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়।

তদন্তে যা উঠে এসেছে

সিআইডির তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘটনার সময় দেশে অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানের চরম অস্থিরতা চলছিল। ৭ নভেম্বরের সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তৎকালীন সেনাপ্রধান ও শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান গৃহবন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত হন। ওই সময় সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক শক্তির সংঘাতে নিয়ন্ত্রণহীন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

তদন্তে ঘটনাস্থল পরিদর্শন, সাক্ষীদের জবানবন্দি, গোপন সূত্রের তথ্য, আর্মি হেডকোয়ার্টার্স ও জাতীয় আর্কাইভসের নথি, সমসাময়িক পত্রিকা এবং অনলাইন উৎস পর্যালোচনা করা হয়। কর্নেল নাজমুল হুদার মৃত্যুসনদে মৃত্যুর কারণ হিসেবে ‘Bullet wound’ (বুলেটের ক্ষত) উল্লেখ রয়েছে।

আরও পড়ুন
ইতিহাস ও বাস্তবতায় জিয়াউর রহমান
৭ নভেম্বরের বিপ্লবই অর্থনীতি-গণতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করেছিল
অতীতে কোনো নেতা পাননি—তারেক রহমানকে এমন সংবর্ধনা দিতে চায় বিএনপি

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, এজাহারে নাম উল্লেখ করা জেনারেল ও শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, মেজর (অব.) মো. আব্দুল জলিল এবং মেজর (অব.) মো. আসাদউজ্জামান হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ছিলেন- এমন কোনো সাক্ষ্য, তথ্য বা বস্তুগত প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বাদীকে একাধিকবার নোটিশ দেওয়া হলেও তিনি নতুন কোনো নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য বা প্রমাণ হাজির করতে পারেননি।

তদন্তে ধারণা দেওয়া হয়, অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে লে. কর্নেল আবু তাহেরের নেতৃত্বাধীন পাল্টা অভ্যুত্থানের সময় অজ্ঞাতনামা সেনাসদস্যদের দ্বারা হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়ে থাকতে পারে। তবে লে. কর্নেল আবু তাহের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ায় তার বিরুদ্ধেও চার্জশিট দাখিল করা সম্ভব নয়।

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) প্রসিকিউশন বিভাগের শেরেবাংলা নগর থানার সাধারণ নিবন্ধন শাখার এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত ১০ ডিসেম্বর মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা পড়েছে। পরবর্তী ধার্য তারিখে আদালতে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হবে।’

তিনি বলেন, সবদিক বিবেচনায় তদন্তে ১৮৬০ সালের পেনাল কোডের ৩০২/১০৯/৩৪ ধারার অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সত্যতা পাওয়া গেলেও কোনো জীবিত ও শনাক্তযোগ্য আসামি না থাকায় মামলাটি ‘সত্য কিন্তু অনিষ্পন্ন’ হিসেবে চূড়ান্ত প্রতিবেদন আকারে দাখিল করা হয়েছে। ভবিষ্যতে নতুন কোনো তথ্য বা প্রমাণ পাওয়া গেলে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করার সুযোগ রাখা হয়েছে।

এ বিষয়ে কথা বলতে সাবেক সংসদ সদস্য নাহিদ ইজাহার খানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তাকে খুদে বার্তা পাঠিয়েও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

এমডিএএ/ইএ/এমএস