শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা: কারণ ও উত্তরণের উপায়

জাগো নিউজ ডেস্ক
জাগো নিউজ ডেস্ক জাগো নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৪:৫৮ পিএম, ০৩ এপ্রিল ২০২৪

এ কিউ এম সিফাতুল্লাহ

সমাজজীবনে হরেক রকমের সমস্যা বিদ্যমান। তার মধ্যে আত্মহত্যা অন্যতম একটা ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এই ব্যাধি শুধু কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের ব্যাধি নয় বরং বিশ্বব্যাপী এটি ভয়ংকরভাবে লক্ষণীয়। বলা যায় যে, এটা একটা ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে। দিনে দিনে এর মাত্রা বাড়ছে তো কমছে না। শিশু থেকে বৃদ্ধ এবং প্রত্যেক শ্রেণিপেশার মানুষের মধ্যেই এর প্রবণতা দেখা যায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা ভয়ঙ্করভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পেছনে নানা কারণ আছে। যা এই ব্যাধির প্রসারতার জন্য বিবেচিত হতে পারে।

প্রথমেই একটি গবেষণার রিপোর্টে চোখ বোলানো যাক। সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা নিয়ে বাংলাদেশের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘আচল’র একটি গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। যা দেখে চক্ষু চড়কগাছ হওয়ার মতো! রিপোর্ট বলছে, ২০২৩ সালে ৫১৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এর মধ্যে ২২৭ জন স্কুলশিক্ষার্থী, ১৪০ জন কলেজশিক্ষার্থী, ৯৮ জন বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষার্থী এবং ৪৮ জন মাদ্রাসাশিক্ষার্থী। সংগঠনটি জানিয়েছে, ১৩-১৯ বছর বয়সী ৩৪১ জন আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। যা মোট আত্মহননকারীর ৬৬.৫%। সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপার হলো এর মধ্যে ৬০.২% নারী শিক্ষার্থী!

আচলের গবেষণা রিপোর্ট অনুযায়ী, ৩২.২% মানসিক অবসাদগ্রস্থতার কারণে, প্রেম-বিয়ের কারণে ১৪.৮%, মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির কারণে ৯.৯%, ডমেস্টিক ভায়োলেন্সের কারণে ৬.২%, অ্যাবিউজিংয়ের কারণে ১.৪%, পারিবারিক চাপের কারণে ৪.৫%, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে ৩.৪%, পাবলিক পরীক্ষায় আশানুরূপ সাফল্য অর্জনে ব্যর্থতার দরুণ ১.৮%, যৌন হয়রানির শিকার হয়ে ২.৫ % এবং অপমানের কারণে ০.৮% আত্মহত্যা করেছেন।

রিপোর্ট বলছে, সবার শীর্ষে যথাক্রমে ঢাকা বিভাগ ১৪৯ জন, চট্টগ্রাম ৮৯ জন, রাজশাহী ৭৭ জন, খুলনা ৬৪ জন, বরিশাল ও রংপুর ৪৩ জন, ময়মনসিংহ ৩৬ জন এবং সিলেটে ১২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন।

বিভিন্ন গবেষণা রিপোর্ট, গণমাধ্যম রিপোর্ট, সমীক্ষা, প্রাতিষ্ঠানিক রিভিউ পর্যালোচনা করলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া এই ব্যাধির নানাবিধ কারণ শনাক্তকরণ সম্ভব। তার মধ্যে মান-অভিমান, প্রেম-ভালোবাসার সমাধি, পারিবারিক অভাব-অনটন, মা-বাবার মধ্যে দাম্পত্য কলহ, পারিবারিক নির্যাতন, পড়ালেখার সীমাহীন চাপ ও প্রত্যাশিত আউটকাম অর্জন করতে না পারা, যৌন হয়রানি, সাইবার বুলিং, ভবিষ্যৎ জীবনের অনিশ্চয়তা, মাদকাসক্তি, অতি আত্মকেন্দ্রিকতা, রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অস্থিরতা, পরমত সহিষ্ণুতার অভাব, অতিরিক্ত প্রযুক্তিনির্ভরতা, জেনারেশন গ্যাপকে মোটাদাগে দায়ী করা যেতে পারে।

প্রত্যেক ব্যাধি যেমন নিরাময়যোগ্য; ঠিক তেমনই এই ভয়ানক সামাজিক ব্যাধিও নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। এর জন্য চাই, পারিবারিক, সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ। যেমন:

১. কাউন্সিলিং ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে। এর জন্য সবার আগে আত্মহত্যার সিম্পটমগুলো সম্পর্কে অবগত হতে হবে। কারো আচরণের মধ্যে কোনো অস্বাভাবিক পরবর্তন দেখা যায়, যা আত্মহত্যার জন্য যথেষ্ট হিসেবে বিবেচিত হয়। তৎক্ষণাৎ তাকে কাউন্সিলিংয়ের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

২. সমস্ত চ্যালেঞ্জের মধ্যে সম্ভাবনা খুঁজে পাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। এজন্য পজিটিভ থিংকিং অত্যাবশ্যক।

৩. বিভিন্ন সেক্টরে উপেক্ষা না করে সহমর্মিতা, ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্ববোধের মাধ্যমেও অবসাদগ্রস্ততা থেকে রক্ষা করা যেতে পারে।

আরও পড়ুন

৪. অতি আত্মকেন্দ্রিকতা ভুলে গিয়ে মানুষের সাথে মিশতে হবে এবং যাবতীয় সমস্যার কথা বলতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে মানুষ নির্বাচনের দিকে মনযোগী হতে হবে। এমন বিশ্বস্ত বন্ধু বা সার্কেল ক্রিয়েট করতে হবে, যাদের কাছে সব প্রাইভেসি বজায় থাকবে এবং সুযোগ বুঝে দুর্বলতাকে পুঁজি করে আঘাত করবে না।

৫. মাদকের ভয়াবহ ছোবল থেকে তরুণ-তরুণীদের রক্ষা করতে সবার এগিয়ে আসতে হবে। মাদকের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। এর বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন ও এর ভয়াবহতা সম্পর্কে ব্যাপক ক্যাম্পেইন পরিচালনা করে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা যেতে পারে।

৬. সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে তরুণদের জন্য কাজের সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে এবং সবকিছুতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যেতে পারে।

৭. বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত থাকা যেতে পারে। যাতে একাকিত্বের কবর রচনা করা যাবে।

৮. পর্যাপ্ত পরিমাণে খেলাধুলার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে।

৯. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় যৌন নিপীড়ন বিরোধী নীতি খুব শক্তিশালী করতে হবে এবং তার নিরপেক্ষ বাস্তবায়ন হলে এই ব্যাধি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

১০. অতিরিক্ত প্রযুক্তি নির্ভরতা কমিয়ে প্রডাক্টিভ কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত থাকা যেতে পারে।

১১. আত্মহত্যা যে মঙ্গলজনক কিছু নয়, এমন ধারণা সবার মননে ও মগজে ঢুকিয়ে দিতে হবে।

১২. নিজেকে অনেক বেশি ভালোবাসতে হবে এবং স্বাস্থ্য সচেতন হতে হবে।

সর্বোপরি আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। যে কোনো সমস্যার মধ্যে যদি আমরা সম্ভাবনা অনুসন্ধানের অভ্যাস গড়ে তুলি, তাহলে তা মঙ্গলজনকই হবে।

এই সামাজিক দুর্যোগের কবল থেকে মুক্তির উপায়ের জন্য ব্যক্তিগত সচেতনতার পাশাপাশি পারিবারিক, সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ খুবই জরুরি। সবার সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমে এই ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। তাই সমাজের প্রত্যেক স্টেকহোল্ডারকে আত্মহত্যা নামক সামাজিক দুর্যোগ মোকাবিলায় এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

এসইউ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।