রাখাইনের জন্য মানবিক করিডোর, নিরাপত্তা নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ

জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে শর্ত সাপেক্ষে মিয়ানমারের রাখাইনে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানোর জন্য করিডোরের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার উভয় দেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণে অন্তর্বর্তী সরকার এ সিদ্ধান্ত নিতে পারে কি না সে প্রশ্ন উঠছে বিভিন্ন মহলে। এমনটাই উঠে এসেছে বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে।
এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ বলেন, সরকার নীতিগতভাবে সম্মতি দিয়ে ভালো করেছে। কারণ যে করিডোর দিয়ে সহায়তা যাবে সেই একই করিডোর দিয়ে বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠিয়ে তাদের জন্য সেখানেই মানবিক সহায়তার কথা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বলতে পারবে বাংলাদেশ।
তিনি আরও বলেন, করিডোর জাতিসংঘ করলেও এতে যুক্তরাষ্ট্র, চীন বা ভারত কিংবা এমন আরও কোনো শক্তি যুক্ত আছে কি না সেটা জানতে হবে এবং তারা কিসের ভিত্তিতে যুক্ত হবে সেটাও সরকারকে পরিষ্কার করতে হবে। মনে রাখতে হবে, এটা করতে গিয়ে প্রতিবেশীদের সঙ্গে যেন নতুন সংকট তৈরি না হয়।
তবে প্রস্তাবিত মানবিক করিডোরের ব্যবস্থাপনা জাতিসংঘের হাতে থাকলেও এর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশের হাতেই থাকতে হবে বলে মন্তব্য করেন চীনে বাংলাদেশের সাবেক এই রাষ্ট্রদূত। তিনি জানান, এতে করে প্রয়োজন হলে বাংলাদেশ নিজেই তা বন্ধ করে দিতে পারবে। তা না হলে বাংলাদেশ প্রত্যাশা করে না এমন কিছু সেখানে ঘটে যেতে পারে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, দেশের ভেতরে রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া এবং একই সঙ্গে মিয়ানমারে জান্তা সরকার ও আরাকান আর্মি ছাড়াও দেশটিতে প্রভাব আছে এমন আঞ্চলিক সব পক্ষ একমত না হলে প্রস্তাবিত করিডোরটি বাংলাদেশের জন্য সামরিক ও নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
তাদের মতে, জাতিসংঘ এবং পশ্চিমা দেশগুলো মানবিক করিডোরের জন্য বাংলাদেশের বিকল্প হিসেবে মিয়ানমারের সিতওয়ে বন্দর ছাড়াও বঙ্গোপসাগরের মিয়ানমার উপকূলের অনেক জায়গা ব্যবহার করতে পারে।
করিডোর স্থাপন নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে যা বলা হচ্ছে:
করিডোর স্থাপনের সরকারি সিদ্ধান্তের বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন রোববার (২৭ এপ্রিল) সাংবাদিকদের জানান, নীতিগতভাবে আমরা এতে সম্মত। কারণ এটি একটি হিউম্যানিটেরিয়ান প্যাসেজ (ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানোর জন্য করিডোর) হবে। কিন্তু আমাদের কিছু শর্ত আছে। সেগুলোর বিস্তারিততে যাচ্ছি না। সেই শর্তগুলো যদি পালিত হয়, আমরা অবশ্যই জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সহযোগিতা করব।
তবে জাতিসংঘের প্রস্তাবে কী বলা হয়েছে কিংবা শর্ত হিসেবে বাংলাদেশ কী চেয়েছে এবং সেই একই করিডোর দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ার সুযোগ থাকবে কি না- এসবের কোনো তথ্যই সরকার প্রকাশ করেনি।
মিয়ানমারের রাখাইনে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলেও এখনো সরকারি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে দেশটির রাজধানী।
এর পাশাপাশি আরাকান আর্মির অস্ত্র ও রসদ সরবরাহের পথও জান্তা বাহিনী বন্ধ করে রেখেছে বলে জানাচ্ছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো।
গত বছরের ১১ ডিসেম্বর জানা যায়, আরাকান আর্মি মংডু শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে এই প্রথম মিয়ানমারের একটি রাজ্যের পুরো নিয়ন্ত্রণ নেয় কোনো বিদ্রোহী গোষ্ঠী। এরকম পরিস্থিতিতে তখন বিভিন্ন মহল থেকে আরাকান আর্মির সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ করার প্রসঙ্গটি আলোচনায় উঠে আসে।
এর আগে ওই বছরের নভেম্বরেই জাতিসংঘ রাখাইনে মানবিক সংকট তীব্র হওয়ার খবর দেয়। সৃষ্ট পরিস্থিতিকে দুর্ভিক্ষ উল্লেখ করে আরও বেশি মানুষ বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল। এর ধারাবাহিকতায়ই পরে মানবিক করিডোরের প্রসঙ্গ আলোচনায় আসে।
আলোচনার শুরু যেভাবে:
মংডু আরাকান বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে আসার পর গত বছরের ১৪ ডিসেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘রোহিঙ্গা সংকট ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা: বাংলাদেশের প্রাসঙ্গিক বিবেচনাসমূহ’ শিরোনামের একটি আলোচনা সভায় অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ভার্চুয়াল বক্তৃতায় প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি সংক্রান্ত বিশেষ প্রতিনিধি খলিলুর রহমান আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগের ব্যাপারে ধারণা দেন।
ওই আলোচনা সভায় সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের সাবেক প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহফুজুর রহমান মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু ও মানবিক করিডোর খোলার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
এরপর চলতি বছরের মার্চের শুরুতে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে রাখাইনের যুদ্ধবিধ্বস্ত বেসামরিক নাগরিকদের জন্য বাংলাদেশ ও আরাকান আর্মির মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠা করা উচিত বলে মন্তব্য করে বাংলাদেশ-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড নিয়ে কাজ করা মানবাধিকার সংস্থা ফরটিফাই রাইটস।
এর কিছুদিন পর জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ঢাকায় আসেন ও রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। তখন রাখাইনে মানবিক সহায়তার জন্য একটি করিডোর চালু করতে বাংলাদেশের কাছে প্রস্তাব দেয় জাতিসংঘ।
৮ এপ্রিল ঢাকার ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ প্রতিনিধি খলিলুর রহমান মানবিক সহায়তা পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিকল্প না থাকার বিষয়টি তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ হচ্ছে একমাত্র চ্যানেল যার মাধ্যমে এটা করা সম্ভব। কারণ রাখাইনের উপকূল এখনও তাতমাদোর (জান্তা বাহিনী) দখলে এবং অন্যান্য জায়গা দিয়ে সহজে ত্রাণ পৌঁছানোও সম্ভব নয়।
তিনি তখন জানান, মানবিক চ্যানেল (প্রস্তাবিত করিডোর) তৈরির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও আরাকান আর্মিকে আলোচনায় বসাচ্ছে জাতিসংঘ। আর আরাকান আর্মি এবং মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে আলাদাভাবে আলোচনা করছে বাংলাদেশ।
তিনি আরও জানান, গত ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে আলোচনায় হিউম্যানিটারিয়ান চ্যানেলে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততার বিষয়টি প্রথম আসে।
আরাকান আর্মি, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং মিয়ানমার সরকার- সবার সঙ্গে আলোচনা করেই তখন জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে গিয়েছিলেন বলে জানান তিনি। পরদিন ৯ এপ্রিল খলিলুর রহমানকে একই সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পদেও নিয়োগ দিয়ে সরকার জানায়, এখন থেকে তার পদবি হবে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং রোহিঙ্গা সমস্যা বিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ।
এরপরই সরকার হিউম্যানিটারিয়ান প্যাসেজ বা করিডরের প্রস্তাবে নীতিগত সম্মতি দিয়েছে বলে রোববার জানান পররাষ্ট্র উপদেষ্টা।
বিশ্লেষকরা অবশ্য বলছেন, প্রভাবশালী পশ্চিমা কয়েকটি দেশ দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের কাছে এমন একটি করিডোরের পরামর্শ বা প্রস্তাব দিলেও রাজনৈতিক সরকারগুলো ভূ-রাজনৈতিক দিক বিবেচনায় তাতে কখনো সায় দেয়নি।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের উদ্বেগ:
বাংলাদেশের করিডোর স্থাপিত হলে তা দিয়ে যাওয়া সহায়তা আরাকান আর্মির হাতেই থাকে কি না তা নিয়ে কৌতূহল থাকবে। আবার আরাকান আর্মির হাতেও রোহিঙ্গারা নির্যাতিত হচ্ছে এবং সম্প্রতি আরও এক লাখের বেশি রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। এ কারণেই নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ এখন রাখাইনে মানবিক সহায়তার জন্য করিডোর দিলেও তাতে আদৌ রাখাইনের বেসামরিক নাগরিকদের লাভ হবে কি না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ আরাকান আর্মির রসদ সরবরাহের অন্য পথ বন্ধ করে রেখেছে জান্তা সরকার।
মিয়ানমার বিষয়ক গবেষক আলতাফ পারভেজ বলেন, মানবিক করিডোরের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এমন সিদ্ধান্ত হচ্ছে অথচ দেশের মানুষ, রাজনীতিবিদ ও প্রশাসনের কেউ কিছু জানে না বলেই তারা তথ্য পাচ্ছেন।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, এসব সিদ্ধান্ত কোথায় হচ্ছে, শর্ত কী কী হবে কেউ জানে না। সবাইকে অন্ধকারে রেখে এত বড় সিদ্ধান্তে ঝুঁকি থেকেই যাবে। কারণ এটি জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত। মিয়ানমার, বাংলাদেশ ও আঞ্চলিক সব পক্ষ একমত হলেও এই করিডোরে বাংলাদেশের স্বার্থ কোথায়?
তার মতে, এ সংক্রান্ত চুক্তিতে সব রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর সুযোগ না থাকলে বাংলাদেশে এমন চুক্তির প্রয়োজনই নেই। বাংলাদেশ এরমধ্যেই মানবিক করিডোর হয়ে আছে বলেই ১৩ লাখ রোহিঙ্গা এখানে আসতে পেরেছে। এখন করিডোর হলে সেখানে তাদের ফেরত পাঠানোর নিশ্চয়তার কথা সরকারকেই আগে নিশ্চিত করতে হবে।
এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশে মানবিক করিডোর হলে এবং সেখানে কোনো পক্ষ থেকে আঘাত এলে সামরিক ঝুঁকি তৈরি হবে বলে মনে করেন মিয়ানমারের সিতওয়েতে বাংলাদেশ মিশনের সাবেক প্রধান মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) এমদাদুল ইসলাম।
তিনি বলেন, অতীতে মিয়ানমারের শান রাজ্যে এমনটি হয়েছে। আর এমন প্যাসেজের জন্য বঙ্গোপসাগর, সিতওয়ে, মংডুর ওপরের দিকে রুট তো খোলাই হচ্ছে। এতে তাহলে বাংলাদেশকে জড়ানো হচ্ছে কেন?
আবার জাতিসংঘ বা পশ্চিমাদের চাপের কারণে বাংলাদেশ কোনো করিডোর চালু করলে শেষ পর্যন্ত সেটি অস্ত্র ও মাদক পাচারের রুট হয়ে দাঁড়ায় কি না অনেকের মধ্যে এমন উদ্বেগও আছে। সেক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে আরাকান আর্মির ভূমিকা কী হবে তা নিয়েও উদ্বেগ আছে। কারণ এখন তাদের হাত থেকে বাঁচতেও অনেকে বাংলাদেশে আসছে।
এ বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) মো. বায়েজিদ সরোয়ার বলছেন, মার্চে মানবিক করিডোরের বিষয়টি আলোচনায় এসেছিল। কারণ সেখানে খাদ্য, ওষুধ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের তীব্র সংকট তৈরি হয়েছিল।
এই বিশ্লেষকের মতে, করিডোরের প্রস্তাবে বাংলাদেশ রাজি হলে আপাতত যে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ সেটা কমতে পারে। একই সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলো ও জাতিসংঘের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এবং রোহিঙ্গা সহায়তা বাড়বে। বাংলাদেশের বিষয়টি আরাকান আর্মিও ইতিবাচক ভাবে দেখবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে- যেসব অঞ্চলে যুদ্ধ চলে, সেখানে মানবিক করিডোর বা সহায়তা খুবই স্পর্শকাতর। কারণ এর সঙ্গে সামরিক বিষয় চলে আসে। কুর্দিস্তানে, বসনিয়াতে ও ইউক্রেনে মানবিক করিডোর নিরাপত্তা সংকট তৈরি করেছে।
তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা
এএমএ/জিকেএস