শাহজালাল বিমানবন্দরে তবু সেই ‘মাছ বাজারের ভিড়’

মুসা আহমেদ
মুসা আহমেদ মুসা আহমেদ
প্রকাশিত: ০৫:১৩ পিএম, ৩০ জুলাই ২০২৫
শাহজালাল বিমানবন্দরের বহির্গমন টার্মিনালে মানুষের জটলা/জাগো নিউজ

• নতুন নিয়ম জানেন না যাত্রীরা
• নিয়ম মানাতে কোনো উদ্যোগ নেই বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের
• এখনো গাড়ি ভরে বিদায় জানাতে আসছেন স্বজনরা

মঙ্গলবার সকাল। ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনাল-১ ও টার্মিনাল-২। দুই টার্মিনালের ছয় ফটক দিয়ে ঢুকছেন বিদেশগামী যাত্রীরা। একটু দূর থেকে কোনোভাবে ফটকই দেখা যাচ্ছে না। শুধু মানুষ আর মানুষ।

প্রতিটি ফটকের সামনেই স্বজনের জটলা। অনেকে ফটক থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে ফ্লোরে আসন পেতে বসে আছেন। কেউ ধূমপান করছেন। আয়েশ করে পান চিবাতেও দেখা গেলো কাউকে। সঙ্গে হৈচৈ, কান্নাকাটি, উচ্চস্বরে ফোনালাপ তো আছেই। দূর থেকে লেখা না দেখলে বোঝার উপায় নেই এটা দেশের প্রধান বিমানবন্দর, না ভিড়বহুল কোনো মাছের বাজার!

শাহজালাল বিমানবন্দরে তবু সেই ‘মাছ বাজারের ভিড়’

টার্মিনাল-১ ও টার্মিনাল-২ এর নিচতলায় আগমনী ফটক দুটি। এর মধ্যে অধিকাংশ যাত্রী টার্মিনাল-২ এর ফটক দিয়ে বের হন। এজন্য এ ফটকের সামনে স্বজনদের ভিড় সব সময় বেশি থাকে। তাদের অনেককে একেবারেই ফটকের সামনে অবস্থান নিতে দেখা যায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাদের বারবার পিছনে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করছেন। একজন যাত্রী বের হলেই তাকে ঘিরে স্বজন ছুটে যান দৌড়ে।

ব্যবসায়িক কাজ ও পর্যটনে বিশ্বের অনেক দেশে গিয়েছি। সেসব দেশের বিমানবন্দর খুবই আধুনিক। সেখানে কোনো যাত্রীকে বিদায় বা স্বাগত জানাতে পরিবারের লোকজন বিমানবন্দরে যায় না। অথচ ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আগমন ও বহির্গমন টার্মিনালের সামনের পরিবেশ যেন মাছ বাজার।–বিদেশগামী যাত্রী মাহমুদুল হাসান

মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) সরেজমিনে এ চিত্র দেখা যায় ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। ডিপারচার ড্রাইভওয়ে ও অ্যারাইভাল ক্যানোপিতে (বহির্গমন ও আগমনী এলাকা) যাত্রীর সঙ্গে দুজনের বেশি যেতে পারবে না- এমন নির্দেশনা দিয়েই যেন দায় সেরেছে শাহজালাল বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত উপস্থিত থেকেও নির্দেশনা বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। ছিল না কোনো প্রচার-প্রচারণা।

যাত্রীদের যাতায়াত স্বাভাবিক রাখা, যানজট ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গত শুক্রবার (২৫ জুলাই) ওই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, গত রোববার (২৭ জুলাই) থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রীদের বিদায় বা স্বাগত জানাতে বিমানবন্দর এলাকার ডিপারচার ড্রাইভওয়ে ও অ্যারাইভাল ক্যানোপিতে যাত্রীর সঙ্গে সর্বোচ্চ দুজন ব্যক্তি প্রবেশ করতে পারবেন। এছাড়া বিমানবন্দর এলাকায় আগত সবাইকে সুশৃঙ্খলভাবে চলাচল ও সহযোগিতার জন্য অনুরোধ জানায় বেবিচক।

শাহজালাল বিমানবন্দরে তবু সেই ‘মাছ বাজারের ভিড়’

সূত্র জানায়, এখন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দিনে ৩০টির বেশি উড়োজাহাজ সংস্থার ১২০-১৩০টি প্লেন উড্ডয়ন ও অবতরণ করে। প্রতিদিন এসব প্লেনে প্রায় ২০ হাজার যাত্রী বিমানবন্দরের ডিপারচার ড্রাইভওয়ে ও অ্যারাইভাল ক্যানোপি ব্যবহার করেন। শাহজালাল বিমানবন্দরের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হিসাবে, একজন যাত্রীকে বিদায় বা স্বাগত জানাতে সঙ্গে গড়ে চারজন স্বজন বিমানবন্দরে যান। এ হিসাবে দিনে প্রায় ৮০ হাজার অতিরিক্ত মানুষের সমাগম হয়। একটি দেশের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এ ধরনের জটলা বিদেশিদের কাছে অনভিপ্রেত। তারা একটি নেতিবাচক ধারণা নিয়ে যান।

ব্যবসার কাজে মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) বেলা ১১টায় শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই যান মাহমুদুল হাসান। বিমানবন্দরে ঢোকার আগে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিমানবন্দর শুধু একটি দেশের প্রবেশপথ নয়, বরং এটি দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিমানবন্দর একটি দেশের ভাবমূর্তি তুলে ধরে, পর্যটকদের আকৃষ্ট করে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সাহায্য করে। কিন্তু বিদেশিরা যখন শাহজালাল বিমানবন্দরে আসেন, এ চিত্র দেখে আঁতকে ওঠেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের মনে নেতিবাচক ধারণা জন্মায়।’

আমরা ওই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর পজিটিভ সাড়া পেয়েছি। তবে যাত্রী ও তাদের স্বজনদের অনেকেই বিষয়টি জানতেন না। তাই শুরুর দিক থেকে কিছুটা ছাড় দেওয়া হচ্ছে। আগামী সপ্তাহ থেকে এ বিষয়ে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ আরও কঠোর হবে।- শাহজালাল বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এস এম রাগীব সামাদ

তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়িক কাজ ও পর্যটনে বিশ্বের অনেক দেশে গিয়েছি। সেসব দেশের বিমানবন্দর খুবই আধুনিক। পরিবেশও দেখার মতো। সেখানে কোনো যাত্রীকে বিদায় বা স্বাগত জানাতে পরিবারের লোকজন বিমানবন্দরে যায় না। অথচ ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আগমন ও বহির্গমন টার্মিনালের সামনের পরিবেশ যেন মাছ বাজার।’

টাঙ্গাইলের রিয়াদ হোসেন মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) দুপুর ১২টার ফ্লাইটে সৌদি আরবের জেদ্দা যাবেন। এজন্য সকালে একটি মাইক্রোবাস ভাড়া করে এসেছেন। তাকে বিদায় দিতে এসেছেন বাবা, বড় বোন, বোনজামাই ও ভাতিজা। রিয়াদ টার্মিনাল-২ এর চার নম্বর ফটক দিয়ে ভেতরে ঢোকার পরও পরিবারের সদস্যরা বাইরের ফ্লোরে বসে ছিলেন।

শাহজালাল বিমানবন্দরে তবু সেই ‘মাছ বাজারের ভিড়’

আপনারা ফ্লোরে বসে আছেন কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে রিয়াদের বাবা মকবুল হোসাইন বলেন, ‘দুপুর ১২টায় রিয়াদের ফ্লাইট ছাড়বে। ফ্লাইট ছাড়লে আমরা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবো।’

ছেলেকে বিদায় জানাতে এতজন এসেছেন কেন জানতে চাইলে মকবুল হোসাইন বলেন, ‘আমার একটাই ছেলে। জেদ্দায় একটা কোম্পানির চাকরিতে যাচ্ছে। এটাই তার প্রথম বিদেশ সফর। তাই সবাই মিলে তাকে বিদায় জানাতে এসেছি।’

দীর্ঘ পাঁচ বছর ওমানে প্রবাস জীবন কাটিয়ে সকাল ১০টায় দেশে ফেরেন চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণের আরিফ খন্দকার। তাকে স্বাগত জানাতে সকাল ৯টায় তার পরিবারের ছয়জন সদস্য শাহজালাল বিমানবন্দরে আসেন। তারা সকাল ৯টা থেকে টার্মিনাল-২ এর আগমনী ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। বেলা পৌনে ১১টায় আরিফ ফটক দিয়ে বের হলে তাকে জড়িয়ে ধরেন তার পরিবারের সদস্যরা।

আলাপকালে আরিফ বলেন, ‘আসলে দেশে আসবো শুনে পরিবারের লোকজন বিমানবন্দরে আসছেন। তাদের দেখতে পেয়ে ভালো লাগছে।’

ওমানের যে বিমানবন্দর থেকে আপনি ফ্লাইটে উঠেছেন, সেখানে যাত্রীকে বিদায় বা স্বাগত জানাতে পরিবারের লোকজন যায় কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে আরিফ বলেন, ‘বিদেশের পরিবেশ ভিন্ন। ওখানে যাত্রীর সঙ্গে বিমানবন্দরে কেউ যায় না। যাত্রী লাগেজ নিয়ে নিজেই যাতায়াত করেন। আর বিমানবন্দরের পরিবেশও অনেক উন্নত।’

শাহজালাল বিমানবন্দরের আগমনী ও বহির্গমন ফটকে যাত্রীদের শৃঙ্খলায় প্রায় একবছর ধরে কাজ করছেন বিমানবাহিনীর এক সদস্য। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই সদস্য বলেন, ‘যাত্রীদের আগমনী ও বহির্গমনে দায়িত্ব পালনে সবচেয়ে কষ্ট হয় যাত্রীদের সঙ্গে আসা লোকজনকে শৃঙ্খলায় রাখতে। টার্মিনাল দুটিতে প্রতিদিন এত মানুষ আসেন, যেন বিমানবন্দরে কোনো রাজনৈতিক দলের সমাবেশ হচ্ছে। তারা কেউ কথা শুনতে চায় না। আবার তাদের সরিয়ে দিতে বলপ্রয়োগ করা যায় না। ফলে বিমানবন্দরের পরিবেশ বাস টার্মিনালের মতো হয়ে গেছে।’

শাহজালাল বিমানবন্দরে তবু সেই ‘মাছ বাজারের ভিড়’

পরিবার নিয়ে থাইল্যান্ড থেকে ঘুরে দেশে ফিরেছেন কাফরুলের বাসিন্দা আবু তৈয়ব। তিনি উত্তরার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। টার্মিনাল-২ দিয়ে বের হওয়ার সময় বলেন, ‘বছরে এক-দুবার বিদেশে ঘুরতে যাই। এখন পর্যন্ত যে কয়েকটা বিমানবন্দর দেখেছি, সবগুলোর ব্যবস্থাপনা ভালো ছিল। কিন্তু নিজেদের বিমানবন্দরের অব্যবস্থাপনা দেখলে হতাশ লাগে। বিশেষ করে বিমানবন্দর যাত্রীকে বিদায় বা স্বাগত জানাতে যাওয়া লোকজনের কারণে পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। এটি দেশের মানুষের বোঝা উচিত। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষেরও এ বিষয়ে কঠোর হওয়া দরকার।’

জানতে চাইলে শাহজালাল বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এস এম রাগীব সামাদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা ওই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর পজিটিভ সাড়া পেয়েছি। তবে যাত্রী ও তাদের স্বজনদের অনেকেই বিষয়টি জানতেন না। তাই শুরুর দিক থেকে কিছুটা ছাড় দেওয়া হচ্ছে। আগামী সপ্তাহ থেকে এ বিষয়ে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ আরও কঠোর হবে।’

তিনি বলেন, ‘বিমানবন্দর একটি দেশের ভাবমূর্তি তুলে ধরে এবং বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। এর মধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সাহায্য করে। তাই আমরা আহ্বান জানাবো, যাত্রীকে বিদায় বা স্বাগত জানাতে দুজনের বেশি যাতে বিমানবন্দরে না যান।

এমএমএ/এএসএ/এমএফএ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।