‘বিমানের শব্দ শুনলেই মনে হয় আবার মাটিতে পড়বে’
তখন স্কুল ছুটির সময়। হঠাৎ বিকট শব্দ। আমার কান বন্ধ হয়ে যায়। পেছনে ফিরে দেখি দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে আর কালো ধোঁয়া। হায়দার আলী ভবন পুড়ছে। আগুনে ঝলসে যাওয়ায় স্কুলের মাসুরা মিসের চেহারা দূর থেকে বোঝা যাচ্ছিল না।
তখন যা দেখেছি, সবকিছুই এখনো প্রায় সময় চোখে ভেসে উঠছে। এখনো অনেক ভয় লাগে। বিমানের শব্দ কিংবা বিমান উড়ে যাওয়া দেখলেই মনে হয় আবারও মাটিতে পড়বে।
কথাগুলো বলছিল মাইলস্টোন স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী রিয়ানা। রিয়ানা ও মুশফিকা তাবাসসুম খুব ভালো বান্ধবী। ঘটনার আট দিন পর দুজন একসঙ্গে স্কুলে এসেছে।

রিয়ানা জাগো নিউজকে বলে, ‘আজ স্কুলে এসেছি স্কুলব্যাগ ছাড়া। কাউন্সেলিংয়ের জন্য আসা। ডাক্তার দেখিয়েছি। ডাক্তার কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাস করেছেন। সাহস দিয়ে বলেছেন ঠিক হয়ে যাবে।’
আমার মেয়ে তানিসা ইসলামের গত আট রাত ঘুম হয় না। ওপর দিয়ে বিমান গেলে শব্দে ভয় পায়। আমাদের বাসা উত্তরা হওয়ায় দিন-রাত অনবরত বিমান যায়। এ কারণে বাসায় থেকেও ভয় পায় মেয়েটা।–অভিভাবক বাপ্পী ইসলাম
রিয়ানার সঙ্গে আলাপের একপর্যায়ে কথা হয় মুশফিকার সঙ্গে। মাইলস্টোন ট্র্যাজেডিতে কতটা আতঙ্কগ্রস্ত, সেটাও অনুধাবন করা যায় তার কথা শুনে। মুশফিকার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল ঠিক সে সময় মাথার ওপর খুব নিচ দিয়ে একটি বিমান উড়ে যাচ্ছিল। সেটি দেখেই কিছুটা আতঙ্ক ভর করে তার মনে। মুশফিকার কাছে জানতে চাইলে বলে, ‘এখন প্লেনের শব্দ শুনলে মনে হয় আবার মাটিতে পড়বে। অনেক ভয় লাগে।’
গত ২১ জুলাই দুপুরে রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে হঠাৎ বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়। এ ঘটনায় হতাহতদের বাইরে রিয়ানা-মুশফিকার মতো অনেক শিক্ষার্থী এখনো মানসিক ট্রমায় ভুগছে। বিশেষ করে যারা সেদিন সরাসরি সেই বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সাক্ষী হয়েছিল। তাদের মনে সেই আতঙ্ক এখনো কাটেনি।
- আরও পড়ুন
ভয়-আতঙ্কে থাকা মাইলস্টোনের শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের কাউন্সেলিং
মাইলস্টোনে বিমান দুর্ঘটনার সময় ভবনটিতে ছিল ৫৯০ শিক্ষার্থী
মাইলস্টোন দুর্ঘটনার পর অনেক বাচ্চা অস্বাভাবিক আচরণ করছে
শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক কার্যক্রম করতে সমস্যা হচ্ছে। খাওয়ায় অরুচি থেকে শুরু করে ঘুমের সমস্যাও হচ্ছে তাদের। শুধু শিক্ষার্থী নয়, অনেক অভিভাবকও ট্রমায় ভুগছেন। সরাসরি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আগুনে পুড়ে যাওয়ার দৃশ্য শিক্ষার্থী-অভিভাবক কেউই ভুলতে পারছে না।

তাদের এই ভয়াবহ ট্রমা কাটাতে মাইলস্টোন স্কুলে অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্প করেছে বিমানবাহিনী এবং বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক। সপ্তাহব্যাপী মেডিকেল ক্যাম্পে বিনামূল্যে সেবা দেওয়া হচ্ছে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক ও স্কুলে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীকে। মূলত সবাইকে কাউন্সেলিং করা হচ্ছে।
শিশুদের মনে তাৎক্ষণিক বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় শিশুদের মানসিক চাপ, হতাশা, ভীতি ও আতঙ্ক তৈরি হয়। এছাড়া ঘুমের সমস্যা হয়। দীর্ঘ যে প্রতিক্রিয়া তা হলো পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজ-অর্ডার (পিটিএসডি)। দীর্ঘমেয়াদি বিষণ্নতা একজন শিশুকে নিরাপত্তাহীনতার দিকে ধাবিত করে।- শিশু-কিশোর ও পারিবারিক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ
স্কুল ক্যাম্পাসের মাঠে আলাপকালে শিক্ষার্থী মুশফিকা তাবাসসুম বলে, ‘আমার বন্ধুরা শারীরিকভাবে আহত হয়নি, এমনি ঠিক আছি। তবে মানসিক অবস্থা আমাদের কারোরই ভালো নেই। আমাদের অনেক বন্ধু, বড় ভাইয়া-আপু ও মিসরা আগুনে পুড়েছেন। এগুলো মনে হলে অনেক ভয় লাগে। ঘুমের মধ্যেও চোখের সামনে ভাসে। আমি দুদিন কাউন্সেলিংয়ে অংশ নিয়েছি। মা নিয়ে এসেছিলেন।’
কাউন্সেলিংয়ে কী জিজ্ঞাসা করে জানতে চাইলে মুশফিকা ও রিয়ানা জানায়, সেদিন আমরা কী দেখেছি, কী করছিলাম? এরপর আমাদের ড্রয়িং (ছবি আঁকা) করতে দেয়। কোনো কিছুতে সমস্যা হলে তাদের জানাতে বলেন। খুব সুন্দর করে ম্যামরা আমাদের সঙ্গে কথা বলে বিষয়গুলো মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন।
নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া তানিসা ইসলাম ও প্লেতে পড়ুয়া মো. মাসনুম ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে তাদের মা মোছা. বাপ্পী ইসলাম এসেছেন স্কুলে। উদ্দেশ্য মেয়ে এবং নিজে কাউন্সেলিং সেবা নেবেন। কারণ তার মেয়ের গত আট রাত ঘুম হয় না। সারারাত জেগে থাকে আর বিমান বিধ্বস্তের কথা পড়ে।

বাপ্পী ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার মেয়ে তানিসা ইসলামের গত আট রাত ঘুম হয় না। ওপর দিয়ে বিমান গেলে শব্দে ভয় পায়। আমাদের বাসা উত্তরা হওয়ায় দিন-রাত অনবরত বিমান যায়। এ কারণে বাসায় থেকেও ভয় পায় মেয়েটা।’
তিনি বলেন, ‘চোখের সামনে এতগুলো বাচ্চা, শিক্ষক মারা গেলো খারাপ লাগে। এসব বাচ্চাকে দেখে আরও আতঙ্কে রয়েছে আমার দুই ছেলে-মেয়ে। আমাদের বাসার পাশে রানা নামে একজন শিক্ষকের মেয়ে মারা গেছে। বাসা থেকে আমার মেয়ে আর ওই শিক্ষকের মেয়ে একসঙ্গে স্কুলে আসা-যাওয়া করতো। এখন আমার মেয়ে একা কীভাবে স্কুলে আসবে?’
মাইলস্টোনে স্থাপিত অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্প পরিচালনা করছে বিমানবাহিনী। বিমানবাহিনীর স্কোয়াড্রন লিডার ওয়ালিউল্লাহ খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্কুলের শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের কাউন্সেলিং করা হচ্ছে। সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত চলা এ ক্যাম্পে চিকিৎসা, পরামর্শ ও বিনামূল্যে ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। ২৮ জুলাই থেকে শুরু হওয়া এ মেডিকেল ক্যাম্প চলবে আগামী ৩ আগস্ট পর্যন্ত। মেডিকেল টিমের সাইকোলজিস্ট ও চিকিৎসকসহ ১৭ জন সদস্য রয়েছেন স্কুলে। প্রয়োজনে সদস্য সংখ্যা আরও বাড়ানো হবে। প্রথম দিন সেবা দেওয়া হয় ১১৮ জনকে, দ্বিতীয় দিন সেবা নেন ১৮০ জন।’

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের শিশু-কিশোর ও পারিবারিক মনোরোগবিদ্যা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিশুদের মনে তাৎক্ষণিক বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় শিশুদের মানসিক চাপ, হতাশা, ভীতি ও আতঙ্ক তৈরি হয়। এছাড়া ঘুমের সমস্যা হয়। দীর্ঘ যে প্রতিক্রিয়া তা হলো পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজ-অর্ডার (পিটিএসডি)। এটি ব্যক্তিত্বের বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে, দীর্ঘমেয়াদি বিষণ্নতা একজন শিশুকে নিরাপত্তাহীনতার দিকে ধাবিত করে।’
তিনি বলেন, ‘এই সময়ের মধ্যে কোনো শিশুর ট্রমা রিলেটেড লক্ষণ দেখা দিলে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া উচিত। পারিবারিকভাবে, স্কুলভিত্তিক ও সমাজভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে এখন পরিস্থিতি নিরাপদ, স্বাভাবিক কাজ করো। অর্থাৎ, বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে।’
আতঙ্ক আতঙ্ক বাড়ায়, সাহস সাহস বাড়ায়। অভিভাবকরা আতঙ্কিত হওয়ায় সেটা শিশুদের মধ্যে প্রবাহিত হয়েছে উল্লেখ করে ডা. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘শিশুরা অভিভাবকদের আতঙ্কের মাধ্যমে সংক্রমিত হতে পারে। শিশুকে তার আগের জায়গা ফিরিয়ে দিতে হবে। দীর্ঘসময় আতঙ্ক নিয়ে ঘরে বসে থাকায় শিশুর ভয় বাড়তে পারে। এখন সময়-সুযোগ হলেই তাদের বাইরের পরিবেশে নিয়ে স্বাভাবিক করতে হবে।’
টিটি/এএসএ/এমএফএ/জেআইএম