বিমানে পরিচালক নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে পরিচালক (অর্থ) নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ তদন্তে এরই মধ্যে বিমানকে নির্দেশনা দিয়েছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। কিন্তু তদন্তকাজ শেষ করার আগেই ওই পদে নিয়োগ সম্পন্ন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে বিমান।
অভিযোগ রয়েছে, বিমানের পরিচালক (অর্থ) নিয়ে যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দেওয়া হচ্ছে। অযোগ্য প্রার্থীদের থেকে তিনজনের নাম নিয়োগে শর্টলিস্ট করা হয়েছে। অর্থাৎ, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে প্রার্থীদের যে যোগ্যতা চাওয়া হয়েছিল, প্রস্তাবিত তালিকায় জায়গা পাওয়া তিন প্রার্থীর সে যোগ্যতা নেই। তারপরও ওই নিয়োগ দ্রুত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করার চেষ্টা করছে বিমান। অথচ এই নিয়োগের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত এখনো চলমান।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত ১২ নভেম্বর ‘বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পরিচালক (অর্থ) নিয়োগে সীমাহীন দুর্নীতি’ সংক্রান্ত একটি অভিযোগ পায় মন্ত্রণালয়। ১ ডিসেম্বর ওই অভিযোগ তদন্ত করে বিস্তারিত জানাতে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর একটি চিঠি দেয় মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করা ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পরিচালক (অর্থ) নিয়োগে অপতৎপরতা শুরু হয়েছে। যার নেতৃত্বে রয়েছেন বিমানের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য আলী আশফাক। তার খায়েশ অর্থ পরিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া। তাই তার কথায় চলবে এমন ব্যক্তিকে ওই পদে বসানোর জন্য তৎপর হয়েছেন। তার উদ্দেশ্য বিমানের সম্পদ ও বিভিন্ন ক্রয় প্রক্রিয়া কুক্ষিগত করে দীর্ঘমেয়াদি লুটপাট এবং নিজের ব্যবসা সম্প্রসারণ করা।’
ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘বিমান পরিচালক (অর্থ) পদটি একটি বিশেষায়িত পদ। বিমানের প্রশাসনিক আদেশ অনুযায়ী এ পদে নিয়োগ সাধারণত তিনভাবে হয়। এর মধ্যে মহাব্যবস্থাপক (রাজস্ব/অর্থ) পদ থেকে পদোন্নতির মাধ্যমে ও সরাসরি নিয়োগের মধ্যমে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (প্রশাসন) থেকে প্রেষণে নিয়োগ।
বিমানে যদি যোগ্য লোক থাকে, বিমানের ফাইন্যান্স ডিপার্টমেন্টে এই দুরবস্থা হতো না। আমার দেশ-বিদেশে যে অভিজ্ঞতা আছে সেটিতে বলে না যে পরিচালক-অর্থ পদের জন্য এয়ারলাইন্স সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞতা বা ব্যাকগ্রাউন্ড দরকার।- আলী আশফাক
২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে, হিসাব নিয়ন্ত্রক (বর্তমানে মহাব্যবস্থাপক পদমর্যাদা) পদে দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি দক্ষতার সঙ্গে পরিচালক (অর্থ) পদটির অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেছেন। এয়ারলাইন্স শিল্পে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা এবং হিসাব বিষয়ে প্রফেশনাল ডিগ্রিধারী এই ব্যক্তি পদের জন্য উপযুক্ত হলেও, তখন তাকে ওই পদের স্থায়ী নিয়োগ না দিয়ে সরাসরি নিয়োগের মাধ্যমে ওই পদ পূর্ণ করা হয়। এছাড়া বর্তমানে বিমানে পরিচালক (অর্থ) পদে পদোন্নতিযোগ্য মহাব্যবস্থাপক পদমর্যাদার তিনজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি রয়েছেন।’
আরও পড়ুন
বিমানের লয়্যালটি ক্লাবে সদস্য হলে ফ্রি টিকিট-লাউঞ্জ সুবিধা
ম্যাজিস্ট্রেট নওশাদের স্পর্শে বদলে গেছে শাহজালাল বিমানবন্দর
‘বডি কন্ট্রাক্টে’ মানবপাচার, গোয়েন্দা তথ্যে দুই কর্মকর্তার নাম
ওই চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘২০১৫ সালে পরিচালক (অর্থ) পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছিল, যেখানে ১০-১৫ বছরের এয়ারলাইন্স অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়। তখন একজন বিদেশি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট নিয়োগ দেওয়া হয়, যিনি বিপুল বেতন-ভাতা এবং বোনাস নিলেও বিমানের উন্নতিতে তেমন কোনো অবদান রাখতে পারেননি। বরং নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে তাকে বিমান থেকে বিদায় নিতে হয়। বর্তমানে বিমানের বোর্ড সদস্য আলী আশফাকের নেতৃত্বে আবারও পরিচালক (অর্থ) পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। যেখানে স্নেহধন্য নিম্নোক্ত ব্যক্তিদের নিয়োগের জন্য শর্টলিস্ট করা হয়েছে।
এই শর্টলিস্টে এক নম্বরে আছেন হাবিবুল্লাহ মঞ্জু, দুই নম্বরে আছেন মো. মেহেদী মাসুদ ও তিন নম্বরে মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন। তাদের তিনজনই এফসিএ এবং কেপিএমজির ফেলো। তাদের এয়ারলাইন্স সংশ্লিষ্ট কোনো অভিজ্ঞতা নেই।
অর্থাৎ যাদের নাম শর্টলিস্টে রাখা হয়েছে, তাদের অধিকাংশেরই এয়ারলাইন্স সংশ্লিষ্ট কোনো অভিজ্ঞতা নেই। এমনকি গত ১০ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে শুধু এফসিএ বা সিপিএ যোগ্যতার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল, যা বিমানের পরিচালক (অর্থ) নিয়োগ সংক্রান্ত সংগঠন ও পদ্ধতি নীতিমালার পরিপন্থি। এরপর, সংশোধিত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে নিয়োগ সংক্রান্ত বোর্ড সাব-কমিটির (যার প্রধান আলী আশফাক) মাধ্যমে তাড়াহুড়া করে শর্টলিস্ট প্রস্তুত করা হয় (যেখানে সরকারি নিয়োগ নীতিমালার কোনো কিছুই মানা হয়নি, যা বাংলাদেশের সংবিধানবিরোধী) এবং নিয়োগ কমিটির প্রধানের কাছে পাঠানো হয়।
বিমান সূত্র জানায়, ওই শর্টলিস্টের অধিকাংশ প্রার্থী কেপিএমজি নামে চার্টার অ্যাকাউন্টিং ফার্মের ফেলো। যে ফার্মের অংশীজন ছিলেন আলী আশফাক, যিনি এই নিয়োগ কমিটিতে আগে ছিলেন না, তাকে পরবর্তীসময়ে কো-অপটেড সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় শুধু প্রভাব বিস্তারের উদ্দেশ্যে। এছাড়া ২০১৮ সালে বিমানে ব্যবস্থাপক (হিসাব) পদে তিনজন প্রফেশনাল ডিগ্রিধারী ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, যাদের মধ্যে দুজন এখনো বিমানে কর্মরত। তাদের একজন এফসিএ এবং অন্যজন এফসিএমএ ডিগ্রিধারী, যার বিদেশি এয়ারলাইন্সে সিএফও (পরিচালক অর্থ, সমমর্যাদা) হিসেবে কাজ করার ১০ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে। একই বা কম যোগ্যতায় যদি একজন নতুন পরিচালক (অর্থ) নিয়োগ দেওয়া হয়, তবে তা শুধু আর্থিক ক্ষতি নয়, বরং তাদের অপদস্থ করার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। বিমানের যোগ্য প্রার্থীদের পরিচালক অর্থ পদে নিয়োগ দেওয়া জরুরি।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিমানের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, পরিচালক-অর্থ পদে প্রায় ১৫০ জন প্রার্থী আবেদন করেছিলেন। তাদের মধ্যে থেকে পাঁচজন প্রার্থীর সাক্ষাৎকার নিয়েছে বিমান। ওই পাঁচজন থেকে আবার ‘অযোগ্য’ তিন ব্যক্তিকে শর্টলিস্ট করেছেন বিমানের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ও নিয়োগ বোর্ড সাব-কমিটির প্রধান আলী আশফাক।
দু-একদিনের মধ্যে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। প্রার্থীদের যোগ্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। আমাদের নিয়োগ বোর্ড কমিটির সদস্যরাই প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। তারাই সিদ্ধান্ত নিয়ে একজনকে সিলেক্ট করছেন। এ বিষয়ে আমাদের উপদেষ্টা ও বিমানের চেয়ারম্যান কথা বলেছেন। যার কারণে এ নিয়োগ নিয়ে আর কোনো সমস্যা নেই। -বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সিইও মো. সাফিকুর রহমান
জানতে চাইলে আলী আশফাক বলেন, ‘এ তালিকা আমি একা করিনি। বিমানের নিয়োগ বোর্ড থেকে একটা সাব-কমিটি করা আছে। এই কমিটির আমি একজন সদস্য। কমিটিই নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করছে।’
যাদের নাম শর্টলিস্ট করা হয়েছে, অভিযোগে বলা হয়েছে তাদের কারওই এয়ারলাইন্স সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞতা নেই। আবার বিমানের যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়টি আপনাদের দৃষ্টিতে পড়েছে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে আলী আশফাক বলেন, ‘বিমানে যদি যোগ্য লোক থাকে, বিমানের ফাইন্যান্স ডিপার্টমেন্টে এই দুরবস্থা হতো না। আমার দেশ-বিদেশে যে অভিজ্ঞতা আছে সেটিতে বলে না যে পরিচালক-অর্থ পদের জন্য এয়ারলাইন্স সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞতা বা ব্যাকগ্রাউন্ড দরকার। শুধু এয়ারলাইন্স এক্সপেরিয়েন্স হলে কী হবে, এখানে যে মডার্ন অ্যাকাউন্টিং জানে না, তারা কীভাবে এই পদে যোগ্য হন।’
ওই নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে আছেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. সাফিকুর রহমান। জানতে চাইলে সাফিকুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘দু-একদিনের মধ্যে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। প্রার্থীদের যোগ্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। আমাদের নিয়োগ বোর্ড কমিটির সদস্যরাই প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। তারাই সিদ্ধান্ত নিয়ে একজনকে সিলেক্ট করছে। এ বিষয়ে আমাদের উপদেষ্টা ও বিমানের চেয়ারম্যান কথা বলেছেন। যার কারণে এ নিয়োগ নিয়ে আর কোনো সমস্যা নেই।’
এমএমএ/এএসএ/এমএফএ/এমএস