পর্যটন বাঁচাতে হলে কক্সবাজারকে বাঁচাতে হবে
![পর্যটন বাঁচাতে হলে কক্সবাজারকে বাঁচাতে হবে](https://cdn.jagonews24.com/media/imgAllNew/BG/2019November/coxbazar-1-20200225211413.jpg)
দেশের পর্যটন শিল্প আজ হুমকির মুখে। মারাত্মক দূষণের কারণে পর্যটন রাজধানী হিসেবে পরিচিত কক্সবাজারের পরিবেশ এখন আর পর্যটকদের অনুকূলে নয়। অথচ বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম সৈকত কক্সবাজারকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশের পর্যটন বিশ্বের বুকে অন্যতম একটি স্থান দখল করে নিতে পারত। তাই পর্যটন বাঁচাতে হলে কক্সবাজারকে বাঁচাতে হবে।
‘মুজিববর্ষের অঙ্গীকার, সাগর রাখব পরিষ্কার’ স্লোগানকে সামনে রেখে মঙ্গলবার কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের লাবণী পয়েন্টে সমুদ্রবিষয়ক পরিবেশবাদী সংগঠন সেভ আওয়ার সি এবং বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ন্যাশনাল ক্লিনআপ-২০২০ অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকী। সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রীর সাবেক তথ্য উপদেষ্টা, ডিবিসি নিউজ চ্যানেলের চেয়ারম্যান ইকবাল সোবহান চৌধুরী।
আ আ স ম আরিফিন সিদ্দিকী বলেন,‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শীতায় বিশাল সমুদ্র বিজয় আমাদের অনেক বড় অর্জন। এ সমুদ্র বিজয়কে অর্থবহ করতে হবে। এটাকে অর্থবহ করতে সমুদ্রবিষয়ক গবেষকদের ভূমিকা রাখতে হবে। আমাদের সমুদ্র সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন, আর এ জন্যই সেভ আওয়ার সি ও মেরিন জার্নালিস্ট নেটওয়ার্ক নামের সংগঠন এই সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।
তিনি বলেন, ফ্লোরিডার মিয়ামি বিচ বিশ্বের অন্যতম একটি বিচ। সেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটকরা যাচ্ছে, সিনেমার শুটিং চলছে। হাজার হাজার পর্যটক সেখানে যাচ্ছে। অথচ সেই বিচ আমাদের কক্সবাজারের বিচের তুলনায় কিছুই নয়। শুধু আমাদের সমুদ্র ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনাগত সমস্যার কারণে এটা হচ্ছে। এবার একটি সুযোগ এসেছে। আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী আসছে। এটাকে সামনে রেখে আমাদের নতুন করে চিন্তা করতে হবে। বঙ্গবন্ধু কীভাবে বাংলাদেশকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে নিয়ে তিনি সমুদ্র উন্নয়নে কী ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন? সে সময়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে তিনি বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন গঠন করেছিলেন। মানতে কষ্ট হয়, আজ যেসব স্থাপনা কক্সবাজার বিচের কাছাকাছি চলে এসেছে, তা যে কতটা অস্বস্তিকর অবস্থা তৈরি করেছে। স্থাপনা থাকতে পারে সেটার একটা লিমিট থাকা উচিত। মুজিববর্ষের অঙ্গীকার নিয়ে কক্সবাজারকে সুন্দর ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিয়ে এসে সমুদ্রকে দেশের কল্যাণে, জনকল্যাণে কাজে লাগাতে হবে।
‘পৃথিবীতে আমরা দেশগুলো ভাগ করলেও প্রকৃতি কিন্তু বিভাজন মানে না। ভৌগোলিক সীমারেখা এটি মানে না। পাকিস্তান ও ভারতে বায়ু দূষণ ও সমুদ্র দূষণ বেড়ে গেলে বাংলাদেশেও তার প্রভাব পড়ে। শিল্পোন্নত দেশগুলোর বায়ু দূষণের ফলে আমাদের দেশে এর প্রভাব পড়ছে। ফলে তাদের যেমন সচেতন থাকতে হবে তেমনি এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী ক্লাইমেট চেঞ্জ নিয়ে অনেক উদ্বিগ্ন থাকেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেসব জলবায়ু সংক্রান্ত সম্মেলন হয়, সেখানে তিনি এসব নিয়ে কথা বলেন। সারা পৃথিবী সম্মিলিতভাবে ক্লাইমেট চেঞ্জ নিয়ে কাজ করতে হবে’,- যোগ করেন তিনি।
অনুষ্ঠানের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী তার বক্তব্যে বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হয়ে সমুদ্রবিজয় করে এনেছেন। একইভাবে তিনি সমুদ্রের দায়িত্বও গ্রহণ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ সংক্রান্ত মেরিন বিভাগ খোলা হয়েছে। এ ছাড়া কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন করেছেন তিনি। আমি এই উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে বলব, প্রধানমন্ত্রী আপনাদের হাতে এই উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ তুলে দিয়েছেন। এখানে আপনাদের কার্যক্রম পরিচালনায় কারা বাধা, সেটা দেখার বিষয় নয়, এ ক্ষেত্রে আপনাদের পরিকল্পিতভাবে এই সমুদ্র সৈকতটিকে কক্সবাজার পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। ২০১৬ সালে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত মাস্টারপ্লান হয়নি, এই কথাটি আমরা শুনতে চাই না। আমরা চাই আগামীকাল থেকে আপনারা এখানে কাজ শুরু করবেন। করপোরেশন গঠন হওয়ার পর বিচ ম্যানেজমেন্টের জন্য আলাদা কোনো কমিটি থাকার কথা নয়। সবকিছু উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের আন্ডারে চলে আসার কথা। সমুদ্র উন্নয়নে করপোরেশনের সঙ্গে জড়িতদের যোগ্যতা কাজে লাগিয়ে এমন কিছু করে দিয়ে যাবেন এলাকার জন্য, যাতে এলাকার মানুষ স্মরণ করে যে, তাদের জন্য কিছু একটা করে দিয়ে গেছেন।
তিনি আরও বলেন, সাংবাদিকদের যে সংগঠনটি আজকের এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে, আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে একটা সচেতনতামূলক পরিস্থিতি তৈরি করা এবং যেসব কর্তৃপক্ষ আছে তাদের যেসব গাফিলতি আছে তা মানুষের সামনে তুলে ধরা। আমি সাংবাদিক বন্ধুদের বলব, প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজার উন্নয়নের তিন লাখ কোটি টাকার বাজেট পাস করেছেন। এয়ারপোর্ট থেকে শুরু করে সবধরনের স্থাপনার উন্নয়নে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সারা বাংলাদেশের সঙ্গে কক্সবাজারের যদি উন্নয়ন করা না যায়, তাহলে সারা বাংলাদেশের উন্নয়ন পূর্ণ হবে না। এখানে যেসব সামুদ্রিক এবং পাহাড়ি সম্পদ রয়েছে, এটা আমাদের পরিকল্পনার অভাবে যদি কাজে লাগাতে না পারে, তাহলে এটি আমাদের বড় ব্যর্থতা।
কক্সবাজার জেলা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সচিব আবু জাফর রশিদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজারকে শ্রেষ্ঠ পর্যটক কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করেছেন। ২৪০ জন জনবল নিয়োগের অনুমতিও দিয়েছেন তিনি। বর্তমানে আমাদের প্রত্যক্ষ লোকবলেন সংখ্যা খুবই কম, অ্যাটাচমেন্ট জনবল দিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। খুব শিগগিরই আমাদের প্রত্যক্ষ জনবল নিয়োগ হবে এবং প্রধানমন্ত্রী যে উদ্দেশ্যে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করেছেন তার বাস্তবায়ন হবে।
সেভ আওয়ার সি’র পৃষ্ঠপোষক আতিকুর রহমান বলেন, পর্যটকদের ফেলে রাখা বর্জ্য সমুদ্রে চলে যায়। ফলে সমুদ্রের প্রাণিগুলোর সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটায়। ফলে সমুদ্রের সম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে।
সভায় পর্যটন বিশেষজ্ঞ ট্যুরিজম ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মোখলেছুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের প্রতিটি বিচ বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশের সম্পদ। কারণ, কোনো জায়গাকে পর্যটনকেন্দ্র ঘোষণার পর সে জায়গায় এককভাবে কোন দেশের মালিকানায় থাকে না। ফলে এই বিচ যাতে কোনোরকম ক্ষতি না হয়, সে বিষয়ে আমাদের সচেতন হতে হবে। এই বিচের জীবনচক্র যত দীর্ঘ সময় ধরে রাখতে পারব ততদিন এর সুবিধা পাব। বিজ্ঞানীরা বলছে, মাটির যাইতে সমুদ্রের তলদেশে সম্পদের পরিমাণ বেশি, ফলে সমুদ্রের সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।
সমুদ্র অর্থনীতি গবেষক ডক্টর দিলরুবা চৌধুরী তার বক্তব্যে বলেন, পৃথিবীতে ব্লু ইকোনমি থেকে অর্থনীতি আসছে পাঁচ থেকে ছয় ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। আমরা যদি ব্লু ইকোনমি কে আরও বেশি এগিয়ে নিতে চাই, তাহলে এটা বেড়ে ১০ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার পর্যন্ত হতে পারে। পর্যটন থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি আয় করছে আমেরিকা। আমাদের দেশেও ট্যুরিজমের সঙ্গে অনেক সেক্টর সম্পৃক্ত হয়েছে। ট্যুরিজম দিয়ে আমাদের জিডিপিতে কন্ট্রিবিউশন আরও বাড়াতে পারি। শুধু গার্মেন্ট সেক্টরের ওপর আমাদের আর নির্ভর করতে হবে না, আপনারা জেনেছেন ইতোমধ্যে গার্মেন্ট সেক্টর জিটিভিতে অংশগ্রহণে তৃতীয় স্থানে নেমে এসেছে। ফলে গার্মেন্ট শিল্পের প্রতি বেশি ঝুঁকে না গিয়ে সমুদ্র সম্পদের ওপর গুরুত্ব দিলে জিডিপিতে এর অংশগ্রহণ অনেক গুণে বেড়ে যাবে।
তিনি বলেন, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পর্যটক স্পেনে। সেখানে পর্যটকদের জন্য নানা ধরনের এন্টারটেনমেন্টের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আমরা বলব না যে, এন্টারটেইনমেন্ট মানে হচ্ছে ক্যাসিনো। আমাদের পার্শ্ববর্তী মুসলিম কান্ট্রি মালয়েশিয়ায় যেভাবে পর্যটকদের জন্য এন্টারটেইনমেন্টের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে তার আলোকে আমাদের দেশেও এন্টারটেনমেন্টের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। মালয়েশিয়ায় নাইট লং মার্কেট খোলা রাখা হয়, ফলে পর্যটকরা রাতভর কেনাকাটার সুযোগ পায়। এই সুবিধাগুলো আমাদের এখানেও চালু করতে হবে।
ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের হেড অব নিউজ মামুন আব্দুল্লাহ বলেন, আমাদের পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের আছে সেটা কি আমরা কাজে লাগাতে পেরেছি? এটা আমার প্রশ্ন। ২০ বছর আগে যে কক্সবাজারকে দেখেছি সেই কক্সবাজারকে আর এখন পাই না। আমরা জানি, গড়ে প্রতিদিন কক্সবাজারে এক লাখ পর্যটক আসে। তাদের আনা বর্জ্য কতটা আমরা সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে পারি? এজন্য এই বর্জ্যগুলো গরিয়ে গরিয়ে সমুদ্রে যাচ্ছে। ফলে আগের মতো সেই নীল রঙের পানি এখানে পাওয়া যায় না। পুকুরের পানির মতো হয়ে গেছে সমুদ্রের পানি।
তিনি বলেন, আমি একটি প্রস্তাব রাখতে চাই। আমরা যদি প্রতিদিন একজন পর্যটক থেকে এক টাকা করে নেই, তাহলে মাসে আমরা তিন লাখ টাকা পেতে পারি। বছরে ৩৬ লাখ টাকা হয়। এই টাকা দিয়ে আমরা বিচ ম্যানেজমেন্টে কাজে লাগাতে পারি।
অনুষ্ঠানে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক তারিখ সাঈদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী সমুদ্র নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন দেখেন। আপনাদেরও এমন স্বপ্ন দেখতে হবে, দেশকে এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখতে হবে।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন সেভ আওয়ার সি’র মহাসচিব মো. আনোয়ারুল হক। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন মেরিন জার্নালিস্ট নেটওয়ার্কের সভাপতি মাহমুদ সোহেল।
অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সচিব আবু জাফর রশিদ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও বাপার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান মজুমদার, বন্যপ্রাণী ক্রাইম কন্ট্রোল ইউনিটের পরিচালক এ এস এম জহির আকন্দ, বাংলাদেশ ট্যুরিজম এক্সপ্লোর অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম সাগর প্রমুখ।
আইএইচএস/জেডএ/জেআইএম