যেখানে করোনা নেই, সেখানে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক করার দাবি
যে গ্রাম বা ইউনিয়নে করোনাভাইরাসের সংক্রম নেই, সেখানকার জীবনযাত্রা স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন দেশের অন্যতম সেরা শিল্পপ্রতিষ্ঠান প্রাণ-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. ইলিয়াস মৃধা। এতে দেশের অর্থনীতি এবং কৃষক লাভবান হবেন বলে দাবি করেন তিনি।
বৃহস্পতিবার (৪ জুন) ব্র্যাক আয়োজিত ‘ইমপ্যাক্ট অফ কোভিড-১৯ প্যান্ডেমিক অন এগ্রিকালচার অ্যান্ড ইমপ্লিকেশনস ফর ফুড সিকিউরিটি’ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি এ দাবি জানান।
ইলিয়াস মৃধা বলেন, ‘করোনায় আমাদের দেশ এফেক্টেড (ক্ষতিগ্রস্ত)। কিন্তু সারাদেশ সমানভাবে এফেক্টেড না। ফলে যে এলাকা এফেক্টেড নয়, ওই এলাকার জীবনযাত্রাকে স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। ওই এলাকার জন্য লোকাল অথরিটিকে লোকলাইজড ল ইমপোজ করতে হবে। যেই গ্রামে, যেই ইউনিয়নে কোনো করোনা নেই, ওই জায়গার হাট-বাজার, জীবনযাত্রা যদি স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসে, তাহলে ওখানে কৃষক কিছুটা বেনিফিটেড (লাভবান) হবে।’
যারা ভ্যালু চেইনের সঙ্গে যুক্ত, তাদের পাশ দিয়ে হলেও মুভমেন্ট স্বাভাবিক করে দিতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এটা করা হলে দেশের অর্থনীতি বেনিফিটেড হবে। সরকার প্রণোদনা দিয়েছে, কিন্তু প্রণোদনা চাহিদার তুলনায় ওই পরিমাণ নয়। আমরা যদি জীবনযাত্রাকে স্বাভাবিক করে দেয়, প্রণোদনায় যতটুকু বেনিফিটেড তার থেকে বেশি বেনিফিটেড হবে কৃষক।’
করোনাভাইরাসের শুরুর দিকে চাল ও ডালের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘সরকার ছুটি ঘোষণার আগে মানুষের মধ্যে একটা ভয় ছিল, দেশে হয় তো একটা ফুড ক্রাইসিস (খাদ্য সংকট) হবে। এ জন্য যা দরকার তার থেকে বেশি মজুত করে। যার ফলে আমাদের সাপ্লাই চেন খুবই টাইট ছিল। মার্কেটে মাল দিয়ে কুলানো যাচ্ছিল না। কিন্তু যখন তার ঘরে স্টক (মজুত) হয়ে গেছে, পরবর্তী মাসে গিয়ে যখন লাগেনি, তখন বাজারে সাপ্লাই (সরবরাহ) বেড়ে গেলে এবং প্রাইস ফল (দাম কমে যাওয়া) করল।’
প্রাণ-এর এ শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি (প্রাণ) প্রতিদিন ৬ লাখ ডিম কনজাম করি কেক ও বিস্কুট তৈরি করার জন্য। আমরা একটা সময় ডিম কিনতাম। হঠাৎ ডিমের দাম ফল (কমে) করে গেল। যখন বাজারে দোকান খোলার জন্য সময় বেঁধে দেয়া হলো, তখন কিন্তু সাপ্লাই চেইন, এক জেলা থেকে আরেক জেলা পরিবহন বন্ধ হয়ে গেল। যারা ফড়িয়া, পাইকার তাদের মুভমেন্ট রেস্ট্রিক্টেড হয়ে গেল। ফলে ওখানে একটা গ্যাপ হয়।’
ইলিয়াস মৃধা বলেন, ‘শুরুতে পুলিশ, প্রশাসনিক লোকজন যেকোনোভাবে, যেকোনো কিছু বন্ধ করে দিয়েছিল। এটা স্টাবিলাইজ হওয়ার জন্য কিছু সময় লেগেছে এবং সরকার লেভেলে অনেক কথা বলতে হয়েছে- এগ্রিকালচার সাপ্লাই চেইন যদি ঠিক না থাকে, ফুড প্রসেসিং ঠিক না থাকে তাহলে ফুড ক্রাইসিসি হবেই।’
কৃষকের পণ্য বাজারজাত করার ক্ষেত্রে মধ্যস্বত্বভোগীর প্রয়োজন রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘একজন প্রান্তিক চাষি যে পরিমাণ কৃষিপণ্য উৎপাদন করেন, সেটা নিয়ে সে কিন্তু ঢাকা পর্যন্ত আসতে পারবে না। তাকে কিন্তু মাঝখানে মধ্যস্বত্বভোগী লাগবে। যে ১০টি কৃষকের পণ্য একুমুলেট (সংগ্রহ) করবে এবং তারপর বাজারে নিয়ে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘দুধের ক্ষেত্রে আপনারা দেখেছেন কৃষকরা বিপাকে পড়েছেন। বাংলাদেশে ২০ লাখ লিটার দুধ উৎপাদন হয়। আমরা যারা প্রসেসর আছি, তারা ১০ শতাংশের মতো দুধ সংগ্রহ করি। বাকি দুধ ট্র্যাডিশনাল ওয়েতে মার্কেটিং হয়। ঢাকার যত মিষ্টির দোকান আছে অথবা বেকারি আছে অথবা টি স্টল (চায়ের দোকান) আছে ওখানে কিন্তু প্রচুর দুধের কনজামশন হয়। আমাদের সব টি স্টল বন্ধ। সব মিষ্টির দোকান বন্ধ। তাহলে কৃষকের দুধটা কোথায় যাবে? আমরা যারা প্রসেসর তারা চাহিদার থেকে ১০-২০ শতাংশ বাড়াতে পারি। আমার কাছে পাউডার মিল্ক মেকিং ফ্যাসিলিটি ছিল, আমি আমার কালেকশন ৫০ হাজার লিটার পর্যন্ত বাড়াতে পেরেছি। তার বেশি আমি পারিনি।’
পোল্ট্রি মুরগির দাম কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমাদের ছোটখাটো হোটেল, রেস্টুরেন্ট বন্ধ। হোটেল-রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকলে পোল্ট্রি যেটুকু কনজাম হচ্ছে তা হাউজহোল্ড লেভেলে হচ্ছে। হোটেলে মানুষ ডিম ভাজি খেত, চিকেন খেত, গ্রিল চিকেন খেত ওটা কিন্তু বন্ধ। যে কারণে পোল্ট্রির দামটা পাচ্ছেন না।’
তিনি বলেন, ‘পোল্ট্রি ৪৫-৫০ দিনের একটা প্রোডাক্ট। যখন ফার্ম মালিক ডে ওয়ান চিকেন কিনছে না, তাহলে আগামী ৪৫ দিন পর পোল্ট্রির ক্রইসিস হবে। এটা নিয়ে আমাদের খাদ্যমন্ত্রী কিন্তু একটা থ্রেটের মধ্যে পড়বেন। আজকে কৃষক প্রকৃত মূল্য পাচ্ছেন না, সে সেল করতে পারছে না, সে লস করছে। সে যখন প্রোডাকশনে যাচ্ছে না, তখন কিন্তু আগামী দিনে দেশ একটা ক্রাইসিসের মধ্যে পড়ে যাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যাদের ব্যাংকের এক্সেস নেই তাদের প্রণোদনা পৌঁছে দেয়ার জন্য এনজিওগুলো কাজ করতে পারে। পাশাপাশি আমরা যারা কৃষকদের সঙ্গে ডিল করি, এখানে যদি থার্ড পার্টি এগ্রিমেন্টের মাধ্যমে ব্যাংক-প্রসেসর-ফার্মার, তাহলে ফার্মার একটা বেনিফিট পেয়ে যাবে। হয় তো ব্যাংক সরাসরি ফার্মারকে দিতে পারছে না। ফার্মারও ব্যাংকে এক্সেস পাচ্ছেন না। তাহলে প্রসেসরা ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের জন্য ঋণ নিতে পারবেন এবং বেশি ঋণ পেলে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি স্টক করে ফার্মারকে সহায়তা করতে পারব।’
এমএএস/এফআর/পিআর