করোনাকালে ৪ হাজারের বেশি মরদেহ দাফন আল-মারকাজুলের
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া সাড়ে চার হাজারের বেশি মরদেহ দাফন-কাফন ও সৎকার করে অনন্য ভূমিকা রাখছে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের আল-মারকাজুল ইসলামী হাসপাতাল। গত বছরের ২৯ মার্চ থেকে চলতি বছরের ২০ এপ্রিল পর্যন্ত ৪ হাজার ৩৪৫টি মরদেহের গোসল, দাফন বা সৎকার করেছেন এ হাসপাতালের নিবেদিতকর্মীরা। এরমধ্যে ৭৭ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী, ছয়জন খ্রিষ্টান, চারজন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এবং দুইজন বিদেশি নাগরিক (চীন ও নাইজেরিয়া) রয়েছেন। বাকিরা সবাই মুসলিম ধর্মের অনুসারী।
গত বছরে নভেম্বরের শেষ দিক থেকে করোনায় মৃত্যুহার কমে। ফলে আল-মারকাজুলকর্মীদের কাজের চাপ কমেছিল। তবে চলতি বছরের মার্চের শেষ দিক থেকে দেশে ফের করোনায় মৃত্যু বেড়েছে। রাজধানীর কোনো হাসপাতালে মৃত্যু হলেই এখনও প্রথমেই তাদের ডাক পড়ে। বর্তমানে দিনে ১৫-৪০টি করোনায় আক্রান্ত মরদেহের গোসল ও তাদের দাফন-কাফন করছেন আল-মারকাজুল হাসপাতালের কর্মীরা।
করোনায় মারা যাওয়ার ব্যক্তির স্বজনরা কখনো নিজেদের ভাড়ার মাইক্রোবাসে বা আল-মারকাজুল ইসলামী হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সে মরদেহ মোহাম্মদপুর বাবর রোডের হাসপাতালে নিয়ে আসেন। এখানে মৃত্যুসনদ দেখিয়ে অপেক্ষাকৃত কম খরচে গোসল করানোসহ দাফন-কাফনেরও ব্যবস্থা রয়েছে।
স্বজনরা চাইলে মরদেহ গোসল করিয়ে কাফন পরানোসহ সার্বিক কাজ সম্পন্ন করে নিজেরা দাফন করার জন্য নিয়ে যেতে পারেন। আবার আল মারকাজুলের মাধ্যমেও মরদেহ দাফন করতে পারেন। সেক্ষেত্রে কিছু হাদিয়া দিতে হয়। মরদেহ পুরুষের হলে গোসল, কাফন ও অন্যান্য খরচ কম। তবে নারীদের ক্ষেত্রে কিছুটা বেশি।
বৃহস্পতিবার (২২ এপ্রিল ) দুপুর সাড়ে ১২টায় সরেজমিন হাসপাতালে দেখা গেছে, সেখানে একটি মরদেহও নেই। তবে কর্মকর্তারা জানান, সকাল থেকে ১৫টি মরদেহের গোসল করানো হয়ে গেছে।
প্রায় ২৫-৩০ মিনিট পরই সাইরেন বাজিয়ে হাসপাতালের সামনে আসে মরদেহবাহী তিনটি অ্যাম্বুলেন্স। সিরিয়াল অনুযায়ী ডেথ সার্টিফিকেট নিয়ে তারা প্রথমে স্বজনদের কাছ থেকে চাহিদা জিজ্ঞাসা করে নেন। যেমন- কাপনের কাপড় কেমন হবে, কর্পূর, আতর, চা পাতা কতখানি লাগবে ইত্যাদি বিষয়। পরে তারা মরদেহ গোসল করানোর কক্ষে পাঠান। সেখানে নারী মরদেহের গোসল নারীরা এবং পুরুষ হলে পুরুষরা গোসল করানোর দায়িত্ব পালন করেন।
হাসপাতালের একজন কর্মী জানান, শুধুমাত্র মরদেহের গোসল করাতে চাইলে তারা বিনামূল্যে করিয়ে থাকেন। গোসল ও কাফনের কাপড় নিলে পুরুষের ক্ষেত্রে এক হাজার ৮৫০ টাকা ও নারীদের ক্ষেত্রে দুই হাজার ৫৫০ টাকা হাদিয়া নেন। তবে কেউ কফিন বক্স, ১০ কেজি চা পাতা, কর্পূর, সুগন্ধি ও মরদেহ মোড়ানোর প্লাস্টিকসহ নিতে চাইলে পুরুষের ক্ষেত্রে হাদিয়া চার হাজার ৫৫০ টাকা ও নারীদের ক্ষেত্রে পাঁচ হাজার ২০০ টাকা নিয়ে থাকেন।
আল-মারকাজুল ইসলামী হাসপাতালের ভাইস চেয়ারম্যান হামজা শহীদুল ইসলাম জাগো নিউজকে জানান, ১৯৯৪ সাল থেকে মরদেহ গোসল করানো ও দাফনের কাজ করে আসছেন তারা। বৃহস্পতিবার (২২ এপ্রিল) দুপুর পর্যন্ত এক লাখ ৫৬ হাজারের বেশি মরদেহের গোসল, দাফন বা সৎকার করেছেন।
তিনি আরও জানান, তবে করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃতদের গোসল করানো ও দাফন-কাফনের কাজটি খুব সহজ ছিল না। শুরুর দিকে করোনায় মৃতদের গোসল করাতে রাজি হতো না কর্মীরা। অনেকে ভয়ে চাকরি ছেড়ে চলেও গেছেন
হামজা শহীদুল বলেন, ‘কর্মীদের ভয় দূর করতে প্রথম দিকে অন্তত ৪০টি মরদেহের গোসল ও দাফন-কাফনে আমি অংশ নিয়েছি। এরপর ধীরে ধীরে সবার মধ্যে ভয় কেটে গেছে। এখন অর্ধশতাধিক কর্মী এ কাজে এগিয়ে এসেছেন। তারা সবাই আমাদের অধীনে পরিচালিত কিন্ডারগার্টেন মাদরাসা, হেফজখানায় কর্মরত। বাইরের কেউ কেউও আছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘করোনায় মারা যাওয়া অনেক মরদেহের দাফন আমরাই করেছি। প্রথমে স্বজনরা মরদেহ নিতে চাইতেন না। তারা গোসল এবং দাফন আমাদের দিয়ে করাতেন। তবে এখন ৪০ শতাংশেরও বেশি মরদেহ স্বজনরা নিয়ে যান। আমরা গোসল করিয়ে কাফন পরিয়ে দেয়। তারা নিজ দায়িত্বে নিয়ে যান এবং নিজেদের কবরস্থান বা এলাকার কবরস্থানে দাফন করেন।’
শহীদুল হামজা বলেন, ‘করোনায় মারা যাওয়া এতো মরদেহের ফরজ গোসল করালেও আমার এখানে কোনো কর্মী এখনও করোনা আক্রান্ত হয়নি। আল্লাহর রহমতে সবাই সুস্থ এবং ভাল আছেন।’
এমইউ/এএএইচ/জেআইএম