ঢাকার ওপর চাপ কমাবে নবনির্মিত শীতলক্ষ্যা-৩ সেতু

সালাহ উদ্দিন জসিম
সালাহ উদ্দিন জসিম সালাহ উদ্দিন জসিম , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক নারায়ণগঞ্জ থেকে
প্রকাশিত: ০৯:৪৫ পিএম, ০৯ অক্টোবর ২০২২

আগামীকাল (সোমবার) উদ্বোধন হতে যাচ্ছে নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর নির্মিত তৃতীয় সেতু। বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম নাসিম ওসমান নামের এই সেতুটি নারায়ণগঞ্জ সদর ও বন্দর, দুই উপজেলাকে সংযুক্ত করছে। পাশাপাশি পদ্মা সেতুর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করছে। এর ফলে নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ এবং পদ্মা সেতু হয়ে খুলনা, যশোর, মাগুরা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া থেকে আসা মানুষ ঢাকা শহরে প্রবেশ না করেই সরাসরি চট্টগ্রাম যেতে পারবেন। এর ফলে যেমন দূরত্ব কমে যাবে তেমনি ঢাকার ওপর যানবাহনের চাপও কমবে।

এই সেতুর ফলে নারায়ণগঞ্জের পাশাপাশি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

রোববার (৯ অক্টোবর) সেতু এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে চলছে শেষ পর্যায়ের কাজ। টোল প্লাজায় নাম অঙ্কন, সেতুতে রোড মার্কিংসহ নানান কাজ হচ্ছে। পাশাপাশি সোমবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য তৈরি হচ্ছে বিশাল প্যান্ডেল। এই কর্মযজ্ঞ দেখতে ভিড় করছেন স্থানীয়রা। তাদের একজন স্থানীয় ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম।

এই সেতুতে তার লাভ কী? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের যোগাযোগ সহজ হচ্ছে। এটাই বড় সুবিধা।

ঢাকার উপর চাপ কমাবে নবনির্মিত শীতলক্ষ্যা-৩ সেতু

চা দোকানি আবদুল মান্নান বলেন, এটি আমাদের দীর্ঘদিনের চাওয়া। এই নদী পার হতে হতো নৌকায়, লাগতো দীর্ঘ সময়। সড়কপথে ঘুরে আসতে হতো প্রায় ৩০ কিলোমিটার রাস্তা। এখন আর সেই সমস্যা থাকলো না৷ সহজেই পার হতে পারবো।

ফরাজীকান্দা এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ লুৎফর বলেন, আগে এখানে সেতু ছিল না, নদী পার হতে হতো নৌকায়। দুর্ঘটনায় অনেকের জীবন গেছে। আমরা এই সেতু পেয়ে খুশি।

আরেক স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, আগে নৌকায় নদী পার হতে অনেক সময় লেগে যেতো। এজন্য দূরত্ব অনুযায়ী গুণতে হতো টাকাও। এছাড়া সড়কপথে গেলে প্রায় ৩০ কিলোমিটার ঘুরতে হতো। এখন নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জের মানুষ শীতলক্ষ্যার এই সেতু দিয়ে অল্প সময়ে যাতায়াত করতে পারবে।

একই এলাকার আরেক বাসিন্দা ইসমাইল হোসেন বলেন, শীতলক্ষ্যা সেতুটি নারায়ণগঞ্জ শহর ও বন্দর উপজেলাকে সংযুক্ত করায় যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে। আমরা নতুন করে, নতুন স্বপ্ন নিয়ে বাঁচার কথা ভাবছি।

১.২৯ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু ব্যবহার করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে চট্টগ্রাম অঞ্চলগামী যানবাহন এবং একইভাবে চট্টগ্রাম থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলগামী যানবাহন যানজট এড়িয়ে, সময় বাঁচাতে নারায়ণগঞ্জ শহরকে বাইপাস করতে সক্ষম হবে। এতে দেশের অর্থনীতি উল্লেখযোগ্যভাবে চাঙা হবে।

এছাড়া সেতুটি চালু হলে পঞ্চবটি বিসিক শিল্প এলাকা, পঞ্চবটি মোড়, চাষাঢ়া মোড়, সাইনবোর্ড, নারায়ণগঞ্জের চট্টগ্রাম সড়ক বা ঢাকার পোস্তগোলা ও শনির আখড়া রুটে যানবাহনকে তীব্র যানজটে পড়তে হবে না। দুই পারের মানুষকে আর নৌকাতেও চড়তে হবে না পারাপারের জন্য।

প্রকল্পটি ২০১০ সালে একনেকে অনুমোদন পেলেও ২০১৮ সালের ২৮ জানুয়ারি নির্মাণকাজ শুরু হয়। সেতু নির্মাণে ৬০৮.৫৬ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়। এর মধ্যে ২৬৩.৩৬ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকারের তহবিল থেকে এবং ৩৪৫.২০ কোটি টাকা সৌদি ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্ট (এসএফডি) থেকে এসেছে।

ওয়াকওয়েসহ সেতুটিতে ৩৮টি স্প্যান রয়েছে। এগুলোর পাঁচটি নদীতে এবং ৩৩টি পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে। হাঁটার পথসহ সেতুটির প্রস্থ ২২.১৫ মিটার। এছাড়া ছয়লেনের টোল প্লাজা এবং দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ অ্যাপ্রোচ রোডও নির্মাণ করা হচ্ছে।

শীতলক্ষ্যা নদী বন্দর উপজেলা ও সোনারগাঁ উপজেলাকে জেলা সদর থেকে পৃথক করেছে। এ দুটি উপজেলা সরাসরি সড়কপথে জেলা সদরের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল না। দুই উপজেলা থেকে জেলা সদরে যেতে কাঁচপুর ব্রিজ (শীতলক্ষ্যা-১ সেতু) ব্যবহার করতে হতো। নৌকায় নদীপথে যেতে না চাইলে সড়কপথে ৩০ কিলোমিটার ঘুরে যেতে হতো।

রোববার সেতুটি পরিদর্শনে এসে নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল হাফিজ বলেন, প্রথমত এই সেতুটি নারায়ণগঞ্জ সদর ও বন্দর দুটো উপজেলাকে সংযুক্ত করবে। শীতলক্ষ্যা নদীর কারণে এই সংযোগটা কখনো ছিল না। আগে প্রতিদিন এই অঞ্চলের মানুষকে নৌকায় চলাফেরা করতে হতো, ফেরীতে চলাচল করতে হতো।

নৌকায় নদী পার হতে গিয়ে অনেক মানুষের প্রাণ গিয়েছে উল্লেখ করে জেলা প্রশাসক বলেন, প্রথমত, ওই জায়গাটায় একটা নিরাপত্তা নিশ্চিত হলো। আর দ্বিতীয়ত, এই সেতুর মধ্যে দিয়ে পদ্মা সেতুর সঙ্গে সংযোগ হচ্ছে নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জের। পদ্মা সেতু হয়ে যারা খুলনা, যশোর, মাগুরা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া এই এলাকার মানুষ ঢাকা শহরে প্রবেশ না করেই পদ্মা সেতু শীতলক্ষ্যা সেতু হয়ে সরাসরি চট্টগ্রাম যেতে পারবে। সেক্ষেত্রে একটা বড় দূরত্ব কমে যাবে।

ঢাকার উপর চাপ কমাবে নবনির্মিত শীতলক্ষ্যা-৩ সেতু

ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে বা অন্যান্য ক্ষেত্রে বড় ধরনের ব্যয় কমে যাবে উল্লেখ করে তিনি জানান, এই ছোট জেলায় অন্তত প্রায় ৮০ লাখের বেশি মানুষ বাস করে এবং অধিকাংশ শ্রমজীবী মানুষ। তারা এক মিনিটে ওপারে যেতে পারবেন। নৌকার জন্য তাদের অপেক্ষা যে করতে হতো বা খরচ হতো, সেটা আর করতে হবে না।

মঞ্জুরুল হাফিজ আরও বলেন, উদ্বোধনের পর আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে প্রাথমিকভাবে মানুষ একটু হেঁটে দেখবে। এপার ওপার হাঁটতে কেমন লাগে সেটা একটা বিষয় তো রয়েছেই। রাত ১২টার পর থেকে, সেতু উদ্বোধন করে দেওয়ায় আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে যে গাড়ি চলতে পারবে।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে গিয়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ও সেতুর প্রকল্প পরিচালক শোয়েব আহমেদ জানান, এই সেতুর দৈর্ঘ্য ১২৩৪ মিটার। তার সঙ্গে দুই পাশে অ্যাপ্রোচ সড়ক থাকছে প্রায় দেড় কিলোমিটার। সেতুটা ছয়লেন বিশিষ্ট। এর মধ্যে চারলেনে দ্রুতগতির যানবাহন চলতে পারবে। আর দুইলেনে ধীরগতির যানবাহন চলবে। ফুটপাতও আছে।

এই সেতু বন্দর ও মূল নারায়ণগঞ্জের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী সেতু। সেখানে অনেকেই হেঁটে পারাপার হতে পারে, সেই সুবিধাটাও রাখা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

শোয়েব আহমেদ জানান, এই সেতুর নির্মাণ কাজের জন্য ২০১৭ সালে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল। এই অক্টোবর মাসে পুরো কাজটা শেষ হয়ে যাচ্ছে। এবং যান চলাচলের জন্য টোলহার সর্বনিম্ন ৫ টাকা ও সর্বোচ্চ ৬২৫ টাকা রাখা হয়েছে।

সেতু পরিদর্শনকালে অন্যান্যের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব হাসান জাহিদ তুষার, সহকারী প্রেস সচিব এম এম ইমরুল কায়েস রানা উপস্থিত ছিলেন।

এসইউজে/এমএইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।