নারী সম্পর্কের বিচিত্র রূপ ‘পারমিতাকে শুধু বাঁচাতে চেয়েছি’


প্রকাশিত: ০৪:২২ এএম, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

দেশের অন্যতম জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক মোস্তফা কামালের ‘পারমিতাকে শুধু বাঁচাতে চেয়েছি’ (২০১৬) একজন নারীর প্রত্যাশা, অচরিতার্থতা, যন্ত্রণা, সংগ্রামশীলতা তথা অস্তিত্বের সামগ্রিক আকাঙ্খার রূপায়ণে বিশিষ্ট। দুই বছর আগে প্রকাশিত ‘জননী’তে বড় ক্যানভাসে গ্রাম এবং শহরের ভূগোলকে কেন্দ্র করে মধ্যবিত্ত এক মমতাময়ী মা’র জীবনালেখ্য উপস্থাপিত হয়েছে। সানজিদা বেগম ওই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। ‘জননী’ বিপুল সংখ্যক পাঠককে বিমোহিত করেছে।

গত বছর মোস্তফা কামাল রচনা করেন ‘রুবীর কালো চশমা’। সেই উপন্যাসে রুবীর ব্যক্তিমানুষের অতল গহীনে ডুব দিয়ে একজন নারীর যন্ত্রণা, কষ্ট, ভয়, হতাশা, সংশয়, সাহসিকতাকে পরিস্ফুট করেছেন তিনি। অর্থাৎ নারী চরিত্র রূপায়ণে মোস্তফা কামালের সহানুভূতি, আন্তরিকতা অসামান্য এবং বাস্তবতার নিরিখে পিছিয়ে পড়াদের সক্ষমতার জায়গাটি তৈরি করার কৃতিত্বও রয়েছে তাঁর। তাঁর জীবন-অভিধানে হতাশা শব্দটি নেই। তিনি স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন দেখান এবং সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে অদম্য চেষ্টা করেন। এ কারণেই হয়তো তিনি সাফল্য পাচ্ছেন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। তাঁর পেশা সাংবাদিকতা আর নেশা লেখালেখি। ২৫ বছর ধরে তিনি নিয়মিত লিখছেন। সাংবাদিকতা ও লেখালেখি উভয় ক্ষেত্রেই তিনি সমান খ্যাতি অর্জন করেছেন।

‘পারমিতাকে শুধু বাঁচাতে চেয়েছি’ উপন্যাসের সমাপ্তিতে রয়েছে করুণ সুরের রাগিণী। ক্যান্সারে আক্রান্ত পারমিতাকে বাঁচানো গেল না। প্রথম স্বামী নাজমুলের দ্বিতীয় বিবাহ তার পিতার মৃত্যুর কারণ হয়েছিল। কিছুদিন পরে নাজমুলও প্রবাসী জীবনে ইহলোক ত্যাগ করে। পারমিতার দ্বিতীয় স্বামী সানাউল ভবঘুরে। যে ভালোবাসার কাঙাল হয়ে পারমিতা তার সুরের প্রেমে মগ্ন হলো সেখানে বিচ্ছেদ ঘটে গেল মানসিক দূরত্বে। নিষ্ক্রিয়, সন্দেহবাতিক, মদ্যপ একজন অপেশাদার গানের শিক্ষক সানাউল পারমিতাকে কোনো সুখরাজ্যের সন্ধান দিতে পারেনি। সানাউলের বিকারগ্রস্ততা, অসুস্থতা, অচরিতার্থতা পারমিতার স্বাভাবিক সুস্থ দাম্পত্য জীবনের জন্য প্রতিবন্ধক শক্তি। এই শক্তির নিকট সে পরাজিত। সমাজমূলের নানা অসঙ্গতির কেন্দ্রে এ দুজনকে প্রতিস্থাপন করেছেন মোস্তফা কামাল। কিন্তু তাদের অতৃপ্ত বাসনা চরিতার্থতার সুযোগ সমাজ দেয় না, তাই লেখক প্রতিটি নর-নারীর অন্তর্জাগতিক শূন্যতা ও যন্ত্রণাকে তুলে ধরেছেন দৈহিক শুচিতা রক্ষা করে। তিনি অবরুদ্ধ সমাজের সঙ্গে নর-নারীকে সামঞ্জস্য করলেও শিল্পের আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে তাঁর উপন্যাসের বিষয়ে নারীর সংগ্রামশীল মনোজগতের কথাই প্রাধান্য পায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী নিঃসঙ্গ সাগর পারমিতাকে সঙ্গ দিয়েছে। নিয়ে গেছে গ্রামের সবুজ পেলবতায়, চাঁদনী রাতের পসরায় মুগ্ধ হয়েছে দুজনে। কিন্তু দৈহিক শুচিতায় উভয়ে থেকেছে নিরুদ্ধ। পারমিতা অফিসের বসদের উপস্থিতির মধ্যে পার্টিতে মাতাল স্বামী সানাউলের আচরণে দুঃখ পেয়ে ভাল চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছে; সাময়িকভাবে হারিয়েছে আন্তরিক বস গিবসনকে। এরপর সে বেকার জীবনে মেয়ে পড়শিকে নিয়ে জীবন সাজানোর কথা ভেবেছে। সানাউলকে সময় দিতে চেয়েছে। কিন্তু সানাউলকে নিয়ে ক্রমাগত বিব্রত হতে হয়েছে তাকে। মদ্যপ সানাউলকে একাধিকবার হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়, পুলিশি জেরার মুখে পড়ে বিরক্ত হয়েছে পারমিতা। বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও পরিস্থিতি ঘোলাটে করেছে সানাউল। কিন্তু সুখের কোনো স্মৃতি তৈরি করতে পারেনি সে। বরং পারমিতাকে সান্ত¦না খুঁজতে হয়েছে সাগরের মাঝে।

আরেক বান্ধবী সোহেলি তার কাছে এগিয়ে এসেছে। দুর্দিনে মানসিক আশ্রয়ের অবলম্বনে পরিণত হয়েছে বন্ধুরা। বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের এক শিক্ষিত নারী পারমিতা। আঘাতে আঘাত ক্ষতবিক্ষত। দুঃখই তার জীবনসঙ্গী।  বারবারই ঘুরে দাঁড়াতে চেয়েছে পারমিতা। কিন্তু সাগরের সঙ্গে যখন রবীন্দ্র সংগীত শুনে আর ঘুরে বেড়ানোর আবেশী দিনগুলো মুখর হচ্ছে সে সময় পারমিতা জেনেছে তার শরীরে মরণব্যাধি ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে। পারমিতাকে কেন্দ্র করে উপন্যাসের কাহিনি আবর্তিত; এসেছে অন্যান্য চরিত্র। চরিত্র চিত্রণে লেখক কম বর্ণনায় নির্দিষ্ট লক্ষ্যে আলো ফেলেছেন। যেমন একটি বাক্য- ‘পারমিতার অপরূপ সৌন্দর্য, তার ব্যক্তিত্ব, তার চাল-চলন, তার কথাবার্তা যেকোনো মানুষের দৃষ্টি কাড়ে।’(পৃ ১৩০)

মূলত নর-নারী সম্পর্কের বিচিত্র রূপ ও স্বরূপ তার সমাজ কাঠামোর বিচিত্র মাত্রা মোস্তফা কামালের ‘পারমিতাকে শুধু বাঁচাতে চেয়েছি’ উপন্যাসের মৌল প্রতিপাদ্য। মধ্যবিত্ত সমাজের সামগ্রিক চিত্রটি পারমিতার জীবনকে কেন্দ্র করে উন্মোচিত হয়েছে। একজন নারী পারমিতার স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের যে বাস্তবতা তা যে কোনো স্তরের পাঠককে নাড়া দিবে। এদেশের মানুষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিন্যাস নারী-পুরুষের সম্পর্ককেও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে।  ‘পারমিতাকে শুধু বাঁচাতে চেয়েছি’ উপন্যাসটি পড়লে সে সত্য সম্যক উপলব্ধি করা সম্ভব। পার্ল পাবলিকেশন্স থেকে বইটি প্রকাশিত হয়েছে।  প্রচ্ছদ এঁকেছন ধ্রুব এষ। বইটির  মূল্য : ৪০০ টাকা। গ্রন্থটি পাঠকের সংগ্রহকে সমৃদ্ধ করবে এটি বলা যায় নিশ্চিত করেই।

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।