পুলিশের সহযোগিতায় বাড়ে সোর্সের দৌরাত্ম্য


প্রকাশিত: ০৪:৩৭ এএম, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

বিভিন্ন সময় পুলিশের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, ইভটিজিং, ভিকটিমকে হয়রানি, হত্যাকাণ্ডসহ নানা অপকর্মের ঘটনা ঘটেছে। এর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নেতৃত্বে থাকে সোর্স আর পেছনে পুলিশ। সাধারণত অপরাধী সনাক্ত ও তদন্ত সংশ্লিষ্ট কাজেই সোর্সের সহযোগিতা নিয়ে থাকে পুলিশ। তবে বেশ কিছু ঘটনায় পেশাগত কাজের বাইরে সোর্সদের সহযোগিতায় ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের ঘটনায় ফেঁসে গেছে কয়েক পুলিশ সদস্য। সম্প্রতি পুলিশ-সোর্সের সম্পর্ক বেশ দূরত্ব। সোর্সরাও গা ঢাকা দিয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর প্রতিটি থানা এলাকায় অর্ধশত খাত থেকে সোর্সরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাম ভাঙিয়ে নিয়মিত চাঁদাবাজি করে আসছে। মামলা পাল্টা-মামলা, চার্জশিট ইত্যাদির নামেও তদবির করে সোর্সরা বিশাল অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। অথচ পুলিশের সোর্স রাখার কোনও বিধান আইনের কোথাও নেই। ফৌজদারি কার্যবিধি কিংবা পুলিশের পিআরবি’র (পুলিশ রেগুলেশন অব বাংলাদেশ) কোথাও পুলিশের সোর্স রাখা বা পালনের বিষয়টিও উল্লেখ করা নেই।

পুলিশ সূত্র জানায়, আসামি ধরা ও অপরাধীদের স্পট খুঁজতে ব্যক্তিগতভাবে সোর্সের সহযোগিতা নিতে পারে। তবে থানায় সোর্সের আনাগোনাও রাখা যাবে না এমনটাই নির্দেশনা ছিল পুলিশ সদর দফতর থেকে।

বর্তমান পুলিশ মহাপরিদর্শক দায়িত্ব নেয়ার পরেই বলেছিলেন যে থানার সামনে সোর্সের আনাগোনা দেখা যাবে সেই থানা ওসির বিরুদ্ধে নেয়া হবে ব্যবস্থা। তবে সে কথার হাল আমলে ব্যত্যয় ঘটেছে। বেশ কয়েকটি ঘটনায় সোর্সের সহযোগিতায় পুলিশ সদস্যরা অপকর্মে জড়িয়েছেন। এজন্য কয়েকটি থানার এসআই, এএসআই ও কনস্টেলকে প্রত্যহার ও সাসপেন্ড করা হয়েছে। বদলি করা হয়েছে ৫ থানার ওসিকেও। সম্প্রতি সোর্সের সহযোগিতায় পুলিশ সদস্যদের অপরাধের খবর চাউর হওয়ায় চলাফেরায় সোর্সের সঙ্গ ত্যাগের নির্দেশনা দিয়েছে ডিএমপি সদর দফতর।

ডিএমপি, থানা পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত সপ্তাহে রাজধানীর শাহ আলী থানা এলাকায় চাঁদা না দেয়ায় পুলিশের সামনেই কয়েকজন সোর্স চা-দোকানি বাবুল মাতব্বরকে (৫০) কেরোসিনের আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে। ঘটনার তদন্তে পুলিশের দায়িত্ব অবহেলা ও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। পুলিশের সামনেই সোর্স দেলোয়ার, আয়ুব আলী ও রবিনসহ আরো কয়েকজন বাবুলকে আগুনে পোড়ালেও বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি কোনো পুলিশ সদস্য। এ ঘটনায় বরখাস্ত করা হয়েছে  তিন এসআইসহ ৫ পুলিশ সদস্যকে। প্রত্যাহার হয়েছে থানার ওসি একেএম শাহীন মণ্ডলকেও।

গত ১৭ জানুয়ারি কাফরুল এলাকায় সাবেক এক সিনিয়র সহকারী সচিবের ছেলের পকেটে হাত দিয়ে ইয়াবা দিয়ে দেয় পুলিশের দুই সোর্স। পরবর্তীতে পুলিশ ওই ছেলেকে আটক করে মিরপুরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরায়। এক লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। যদিও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।

২৪ জানুয়ারি উত্তরায় কথিত সোর্সের মাধ্যমে এক তরুণ ব্যবসায়ীকে আটক করে আড়াই লাখ টাকা দাবি করে পুলিশ। এর সঙ্গেও সোর্সের যোগসাজশের অভিযোগ রয়েছে।

২০১৪ সালে সোর্স খোকন, নাসিম, ফয়সাল ও পলাশের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ঝুট ব্যবসায়ী মাহবুবুর রহমান সুজনকে ধানমন্ডি থেকে আটক করে মিরপুর থানার এসআই জাহিদুর রহমান। পুলিশের আতঙ্কে তিনি মিরপুর ছেড়ে ধানমন্ডিতে পালিয়ে ছিলেন। তবে এসআই জাহিদুর রহমান, এএসআই রাজকুমার, ও দুই কনস্টেবল মিলে থানা হাজতে ওই ব্যবসায়ীকে ধরে এনে নির্যাতন চালালে মারা যান তিনি। ওই ঘটনায় এসআই জাহিদুর ও সোর্স নাসিম কারাগারে রয়েছেন।

বনানী থানা পুলিশের সোর্স শহীদের বিরুদ্ধে অবৈধ অস্ত্রবহন-ব্যবহার, হুমকি-ধামকি দিয়ে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। ওই এলাকায় নকল এবং আসল হিজড়াদের মধ্যে বিরোধ আছে। যার সুযোগ নিয়েছে পুলিশ ও কথিত সোর্স শহীদ। তিনি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।

গত বছরের মার্চে পুলিশের সোর্স শিমু আক্তার ওরফে সুমিকে (২৩) হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। তদন্তে মতিঝিলে সুমি খুনের ঘটনার পেছনে মাদক ব্যবসা ও পুলিশের সোর্স হয়ে কাজ করার কারণ খুঁজে পায় ডিবি পুলিশ।

২০১৩ সালের জানুয়ারিতে মিরপুরের মধ্য পীরেরবাগে ব্যবসায়ী জিয়া হায়দার হত্যায় মনির হোসেন নামে এক সোর্সের সংশ্লিষ্টতা পায় পুলিশ। তাকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেয়া হয়েছে।

গত বছরের জুলাইয়ে দক্ষিণ খিলগাঁওয়ের এক নারী বাসিন্দা ডিএমপি সদর দফতরে জলিল ও খাদেম নামে দুই সোর্সের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ করেন। এর কিছু সময় পরেই খিলগাঁও থানার সিভিল টিম এসে তার স্বামীকে ধরে নিয়ে যায়। পরে সোর্সদের কাছে ২০ হাজার টাকা দেয়ার পর ছাড়া পান তিনি।

ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের কারণে ২০১৪ সালের ২৪ নভেম্বর সবুজবাগে মিজানুর রহমান ও আমানুল্লাহ নামে পুলিশের দুই সোর্সকে পিটিয়ে ও ছুরিকাঘাত করে আহত করে প্রতিপক্ষ মাদক ব্যবসায়ীরা। গাবতলীতে পুলিশের ছত্রছায়ায় এই সোর্সরাই দাপট ও ক্ষমতার চর্চা বেশি করেন। চাঁদাবাজিতে যেন সোর্স-পুলিশ মাসতুতো ভাই!

রাজধানীর প্রতিটি থানা এলাকায় এই সোর্স দৌরাত্ম্য রয়েছে। গোয়েন্দাদের কাছে এই অপরাধী কথিত সোর্সদের তালিকাও রয়েছে। এরকম রাজধানীর প্রায় সব থানাতেই সোর্সের  দৌরাত্ম্য রয়েছে।

এ ব্যাপারে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান সম্প্রতি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, ‘পুলিশের স্পর্ধা ও বেআইনি কর্মকাণ্ড সীমা ছাড়িয়েছে। পুলিশ আজ প্রজাতন্ত্রের জন্যও লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষের অধিকার রক্ষায় পুলিশ নিয়োজিত, মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়ার জন্য নয়।’

ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মারুফ হোসেন সরদার বলেন, পুলিশের সোর্স পরিচয়ে কেউ যদি চাঁদাবাজি করে, বিষয়টি কারো দৃষ্টিগোচর হলে তাৎক্ষণিক পুলিশের কাছে অভিযোগ করবেন। পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। আমাদের অবস্থান জিরো টলারেন্স, কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।

জেইউ/জেএইচ/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।