আশ্রয়ণে বদলে গেছে জীবন

সালাহ উদ্দিন জসিম
সালাহ উদ্দিন জসিম সালাহ উদ্দিন জসিম , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক গোয়াইনঘাট (সিলেট) থেকে
প্রকাশিত: ০২:৫৯ পিএম, ২২ মার্চ ২০২৩
আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার

সিলেট শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে গোয়াইনঘাট উপজেলার বাগবাড়ি গ্রাম। এলাকার বেশিরভাগ ঘরই মাটির। সেগুলোতে একপাশে মানুষ থাকে, অন্য পাশে গরু-ছাগল। মাঝে মধ্যে দু-একটা আধাপাকা ঘরও চোখে পড়বে। সেগুলো আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় দেওয়া।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এলাকার বেশিরভাগ মানুষই নিম্ন আয়ের। অনেকের নিজের জমি নেই। সরকারি খাসজমিতে মাটির ঘর করে থাকেন। সম্প্রতি অনেককে সরকারিভাবে আধাপাকা ঘরসহ দুই শতক জমি দেওয়া হয়েছে। এখানে পাকা ঘরের মানুষেরাই তুলনামূলক ধনী।

তাদের একজন আব্দুল জলিল। পায়ের বুড়ো আঙুলে রোগ হওয়ায় পুরো পা কেটে ফেলতে হয়েছে। বছর চারেক হলো তিনি পঙ্গু। এক সময়ের দক্ষ কৃষক এখন স্ট্রেচারে চলেন। কিন্তু তারপরও কষ্ট নেই তার।

তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আল্লাহ একদিক দিয়ে নিয়েছেন, আরেকদিক দিয়ে দিয়েছেন। অসুস্থতার কারণে একটি পা ফেলে দিলেও এলাকার মানুষ টাকা তুলে চিকিৎসা করিয়েছে। সবাই মিলে আমাকে টমটম কিনে দিয়েছে, ওটা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করি। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে দুই শতক জমিসহ পাকা একটি ঘর দিয়েছেন। এই ঘরে চার ছেলে-মেয়ে নিয়ে ভালোই আছি।

আরও পড়ুন: আশ্রয়ণ প্রকল্প খুরুশকুলের চেহারা বদলে দেবে: প্রধানমন্ত্রী

আগের ঘর কেমন ছিল? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওই যে ছনের ঘর। বৃষ্টি এলে ভিজতাম, আবার রোদে শুকাইতাম। এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো আছি। ছেলে-মেয়েদেরও পড়াচ্ছি। তারা আরও ভালো থাকবে।’

আপনার আশপাশের লোকদের মাটির ঘর, সেখানেই গরু-ছাগল নিয়েই থাকে, আপনি তো মনে হয় এখানে বেশি ধনী? মুচকি হেসে আব্দুল জলিল বলেন, এখানে সবার ঘরই হয় ছনের না হয় মাটির। এক ঘরেই মানুষ ও পশু নিয়ে থাকে। ছনের ঘরে গরু রাখি, পাকা ঘরে আমরা থাকি। সে তুলনায় আমিই এখন ভালো আছি।

একই চিত্র প্রতিবেশী আইয়ুব আলীর। তিনি কৃষি কাজ করেন। আশ্রয়ণের ঘরে থেকে নিজের তিন মেয়েকে পড়াচ্ছেন। বড় মেয়েকে একটি বেসরকারি ব্যাংকের অফিসারের কাছে বিয়ে দিয়েছেন। হয়তো শুনেও চোখ কপালে ওঠার অবস্থা হবে। হ্যাঁ, এটাই বাস্তব। আশ্রয়ণের ঘর বদলে দিয়েছে জীবন। তেমনটাই জানিয়েছেন খোদ সেখানকার বাসিন্দারা। অনেকে ঘরের পাশে আগের ছনের বা মাটির ঘর ঠাঁয় দাঁড়িয়ে। সেটিও স্বাক্ষী দিচ্ছে তাদের দু-এক বছর আগের চিত্রও।

আরও পড়ুন: ‘পাড়াগাছি গুচ্ছগ্রাম’ একটি আদর্শ আশ্রয়ণ প্রকল্প

পাশের গ্রামের বিন্নাকান্দির বাসিন্দাদের একই চিত্র। মাত্র দুই বছর আগেও এখানকার শাহানা বেগম (৩৫) ও শরিফ উদ্দিন আর দশটা হতদরিদ্র পরিবারের মতোই ছিল। আজ তাদের রয়েছে ছয়টি গরু, একটি ছাগল, সঙ্গে একটি মিশুক। দুই ছেলে এখন স্কুলে যায়। স্বামীর পরিশ্রমের অর্ধেক টাকা সঞ্চয় হয় তাদের পরিবারে। তিন সন্তান ও স্বামী নিয়ে আগের থেকে অনেক ভালোই আছেন শাহানা বেগম।

শাহানা বেগম জাগো নিউজকে বলেন, বছর দুয়েক আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে দুই ঘরের এই বাড়িটি পাওয়ার আগে তাদের জীবন এমন ছিল না। আমরা আগে মাটির ঘরে থাকতাম, খুব কষ্ট করে থাকতে হতো। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ঘর পাওয়ার পর এখন অনেক ভালো আছি। এখন আমাদের ছয়টা গরু, একটা ছাগল। আমার স্বামী শরিফ উদ্দিন একটি মিশুক কিনেছেন। প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা আয় করে। দেড়শ থেকে ২০০ টাকা জমাতে পারি। আমার দুই ছেলে স্কুলে পড়ে। বড় ছেলে আশরাফ উদ্দিন ক্লাস সিক্সে পড়ে আর ছোট ছেলে ক্লাস ফোরে। খুব ভালো আছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য আমাদের জীবনে এখন কোনো দুঃখ নেই।

একই গ্রামে এক বছর আগে আশ্রয়ণের ঘর পেয়েছেন হোসেন আহমেদ। তার স্ত্রী স্বপ্না বেগম বলেন, আমার স্বামী একজন সাধারণ দিনমজুর। আমি বাসাবাড়িতে কাজ করি। বাড়িতে হাঁস-মুরগি পালন করি। এক বছর আগে ঘর পেয়েছি। আগে এখানে ছোট একটা ঘর ছিল। ঝুপড়ির মতো। বৃষ্টি হলে ঘরে পানি পড়তো। জীবনে অনেক কষ্ট করেছি। অসহায় দেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘর দিয়েছে। আমরা আগে থেকেই এই খাস জায়গায় থাকতাম। স্বামী মাসে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা আয় করে। সে টাকা দিয়ে পরিবার চলে। পাশাপাশি বাচ্চাদের লেখাপড়া করাই। বাচ্চাদের শিক্ষিত করে মানুষের মতো মানুষ করার ইচ্ছা।

আরও পড়ুন: নজর কেড়েছে জাতীয় পতাকার আদলে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর

একই গ্রামে ঘর পাওয়া রুকিয়া বেগম বলেন, স্বামী আবদুল্লাহ পাথরের কাজ করেন। আগে বাসাভাড়া দিয়ে থাকতাম। বাসাভাড়া ছিল ৫০০ টাকা। কাজ করে বাসাভাড়া দিতাম। কখনো ভাবিনি নিজের বাড়ি হবে। বাড়ি পেয়ে আমরা খুব খুশি।

তিন সন্তানের জননী রুকিয়া আরও বলেন, হাঁস-মুরগি আছে। সেগুলো পালন করি। স্বামী যে টাকা পায় তা দিয়েই সংসার চালিয়ে নিচ্ছি। ছেলেমেয়ে তিনজন। ছেলেমেয়েকে মাস্টার বানানোর ইচ্ছে আছে। নতুনবা তাদের সরকারি চাকরি করাতে চাই।

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমরা সঞ্চয় করে মোটরসাইকেল কিনেছি। স্বামী দিনে পাথরের কাজ করে বাসায় ফিরে রাতে ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালায়। এতে আমাদের ভালোই আয় হয়। এক বছরের মধ্যে আমরা টেলিভিশনও কিনেছি, ঘরের অনেক জিনিস করেছি।

গোয়াইনঘাটে এমন হাজার পরিবারের দুঃখ ঘুচিয়েছে আশ্রয়ণের এই ঘর। হতদরিদ্র ও সংকটাপন্ন মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি জুগিয়েছে। নতুন স্বপ্ন ও জীবন গড়ার পথ বাঁতলে দিয়েছে। গত মঙ্গলবার (২১ মার্চ) সকালে সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার কয়েকটি আশ্রয়ণ প্রকল্প ঘুরে এক সময়ের গৃহহীন কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।

গোয়াইনঘাট উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা তাহমিলুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, এই উপজেলায় আমরা ১ হাজার ১০১টি ঘর করে দিয়েছি। এরই মধ্যে ৮৯৫টি ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে। আর ১২৪টি ঘর বিভিন্ন পর্যায়ে নির্মাণাধীন। দ্রুত এগুলো হস্তান্তর হবে।

আরও পড়ুন: মধুমতির ভাঙনে বিলীন অস্থায়ী রক্ষা বাঁধ, হুমকিতে আশ্রয়ণ প্রকল্প

তিনি বলেন, যারা এক বা দুই বছর আগে ঘর পেয়েছেন, তাদের জীবন মানে বেশ ভালো পরিবর্তন হয়েছে। আশা করি, দারিদ্র্য দূরীকরণে বা অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে এটি মাইলফলক হবে।

এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সহকারী প্রেস সচিব এম এম ইমরুল কায়েস রানা জাগো নিউজকে বলেন, আশ্রয়ণের এই ঘর মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য। এটি সমাজের সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার একটি প্রক্রিয়া। আজ যিনি ভূমিহীন-গৃহহীন, হতদরিদ্র বা অসহায়। এই ঘরের মাধ্যমে তার মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়।

তিনি বলেন, নিজের আয় সঞ্চয় করে আর জমি কেনা বা বাড়ি করার কথা ভাবা লাগছে না তার। এখন তারা শুধু সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করবে, আর সেই সন্তানরা তাদের আরও এক-দুই স্তর এগিয়ে নিয়ে যাবে। আজ তাদের আধাপাকা ঘরে আছে, সন্তানরা তার চেয়ে ভালো কিছু করবে। প্রধানমন্ত্রী কিন্তু এটিই চান। আশ্রয়ণের মাধ্যমে সমাজের পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠীকে সমাজের উন্নয়নের মূলস্রোতে তুলে আনতে চান।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে দেশে প্রথম ভূমিহীনদের পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু করেন। বর্তমান লক্ষ্মীপুর রামগতি উপজেলার চরপোড়াগাছা গ্রামে একই বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের মাধ্যমে শুরু করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৭ সালে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে দেশে ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষকে পুনরায় জমি ও গৃহের মালিকানা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

আরও পড়ুন: মিরসরাইয়ে কেনা জমিতে হচ্ছে দেশের প্রথম আশ্রয়ণ প্রকল্প

এই প্রকল্পের আওতায় ১৯৯৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মোট ৭ লাখ ৭১ হাজার ৩০১টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। পরিবারপ্রতি ৫ জন হিসেবে এই কার্যক্রমের উপকারভোগীর সংখ্যা ৩৮ লাখ ৫৬ হাজার ৫০৫ জন।

এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ প্রকল্প সরাসরি পুনর্বাসন করেছে ৫ লাখ ৫৪ হাজার ৫৯৭টি পরিবারকে। ভূমি মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরের সমান কার্যক্রমের আওতায় পুনর্বাসিত হয়েছে আরও ২ লাখ ১৬ হাজার ৭০৪টি পরিবার।

সারাদেশের ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষের হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহ করে প্রতিটি গৃহহীন-ভূমিহীন মানুষকে বিনামূল্যে পরিবারভিত্তিক স্বামী-স্ত্রীর যৌথ নামে ২ শতাংশ জমির মালিকানার দলিল ও নামজারি সম্পাদন করে দেওয়া হয়। এই জমিতে সম্পূর্ণ সরকারি খরচে ২ কক্ষ, প্রশস্ত বারান্দা, একটি স্যানিটারি টয়লেট ও একটি রান্নাঘর সংবলিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজস্ব ডিজাইনের একটি অনন্য সাধারণ গৃহ নির্মাণ করে দেওয়া হয়।

এসইউজে/এমআরএম/এমএস/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।