বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের মা

‘আমার ছেলে মুক্তিযুদ্ধে যাবে, আমি বাধা দেই কেমনে?’

আবদুল্লাহ আল মিরাজ
আবদুল্লাহ আল মিরাজ আবদুল্লাহ আল মিরাজ , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৩:০৭ পিএম, ২৬ মার্চ ২০২৩
বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের ‘মোবারক লজ’

বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগকারী এক বীর সেনানী। কর্মরত ছিলেন পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে। ১৯৭১ সালের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে দুই মাসের ছুটিতে সপরিবারে এসেছিলেন ঢাকায়। ২৫ মার্চের নির্মমতা প্রত্যক্ষ করার পর আর থেমে থাকতে পারেননি। সিদ্ধান্ত নেন মাতৃভূমির পক্ষে কাজ করার। তার সেই সিদ্ধান্ত জানতে পারেন সহোদর আতাউর রহমান। ভাইয়ের জীবন ঝুঁকিতে পড়তে পারে তাই মায়ের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করেন তিনি।

মাকে এ বিষয়টি জানালে তিনি যে জবাব দেন তা শুনে বিস্মিত হন আতাউর। জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি মায়ের কাছে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে মুক্তিযুদ্ধে যাবে আমি বাধা দেই কেমনে? প্রয়োজনে সাথে তুইও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নে।’

পরিবার সূত্রে জানা যায়, ১৯৪১ সালের ২৯ অক্টোবর পুরান ঢাকার ১০৯, আগা সাদেক রোডের ‘মোবারক লজ’-এ বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের জন্ম। মতিউরের পৈতৃক বাড়ি ছিল নরসিংদীর রায়পুরা থানার রামনগর গ্রামে। বাবা মৌলভী আবদুস সামাদ, মা সৈয়দা মোবারকুন্নেসা খাতুনের ১১ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন ষষ্ঠ।

আরও পড়ুন: পৈতৃক ভিটা জরাজীর্ণ, আর্থিক টানাটানিতে স্বজনরা

বর্তমানে ‘মোবারক লজ’ হয়েছে বহুতল ভবন। ১০তলা এই ভবনের নামকরণ হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের নামে। ভবনটি একটি বিল্ডার্স কোম্পানির অধীনে বহুতল ভবনে রূপান্তরিত হয়েছে। ভবনের অর্ধেকের মালিকানায় বিল্ডার্স ও বাকি অংশের মালিক মতিউর রহমানের স্ত্রী-সন্তানসহ ভাইয়েরা। বর্তমানে বাড়িটিতে তার ভাই আতাউর রহমান ও এক ভাতিজা অবস্থান করছেন। তবে মতিউর রহমানের স্ত্রী-সন্তানদের কেউই থাকেন না বাড়িটিতে।

মহান মুক্তিযুদ্ধে নিজের পরিবারের অবদানের কথা জাগো নিউজকে জানান আতাউর রহমান। তারসঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বীরশ্রেষ্ঠ’র দুই মেয়ে দুইজনই থাকেন সুদূর আমেরিকায়। তার সহধর্মিণী মিলি রহমান দেশে ও বিদেশে আসা-যাওয়া করে থাকেন।

আতাউর রহমান ও মতিউর রহমানের ছোটবেলা কেটেছে একইসঙ্গে। পড়েছেন ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে। আতাউর রহমান ছিলেন এক বছরের ছোট। কলেজিয়েট স্কুল থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পাস করার পর সারগোদায় পাকিস্তান বিমান বাহিনী পাবলিক স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন মতিউর রহমান। সেখান থেকে ডিসটিংকশনসহ মেট্রিক পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।

আরও পড়ুন: বারবার সামরিক শাসন স্বাধীনতাকে ম্লান করেছে

আতাউর রহমান জানান, ১৯৭১ সালের শুরুতে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান সপরিবারে ঢাকায় দুই মাসের ছুটিতে এসেছিলেন। এর মাঝে দেশে অস্থিরতা শুরু হলে তিনি নিয়মিত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যোগ দিতেন। আমিও সবসময় তার সাথে থাকতাম। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের দিনও আমরা অংশ নিয়েছিলাম। এরপর দুই মাস ছুটি পার হয়ে যাওয়ায় মতিউর রহমানের খোঁজে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর লোকজন বার বার আসতো। এসব এড়ানোর জন্য আমরা গ্রামের বাড়ি নরসিংদীর রায়পুরের রামনগর গ্রামে চলে আসি। ২৫ মার্চ রাতে আমরা গ্রামের বাড়িতেই ছিলাম।

jago

বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের ভাই আতাউর রহমান

২৫ মার্চ রাতের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, আমাদের বাড়ি রেললাইনের পাশে হওয়ায় সার্বক্ষণিক রেলের যাতায়াতের শব্দ শুনতে পেতাম। সে রাতে রেল চলাচল বন্ধ ছিল। এরপর মতিউর রহমানসহ আমরা রেলস্টেশনে গিয়ে দেখি সেখানে বিভিন্ন জেলাগামী ট্রেন আটকে আছে। অনুমতি না থাকায় রওনা দিচ্ছে না। খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পারি ঢাকায় গণ্ডগোল হচ্ছে। সেই রাতে হানাদারদের পৈশাচিক গণহত্যা দেখে আর তিনি (মতিউর রহমান) স্থির থাকতে পারলেন না। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একজন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হওয়া সত্ত্বেও অসীম ঝুঁকি ও সাহসিকতার সঙ্গে ভৈরবে একটি ট্রেনিং ক্যাম্প খুললেন। যুদ্ধ করতে আসা বাঙালি যুবকদের প্রশিক্ষণ দিতে থাকলেন। বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করা অস্ত্র নিয়ে গড়ে তুলেন একটি বাহিনী।

১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল ‘সেভর জেড’ বিমান থেকে তাদের ঘাঁটির ওপর বোমাবর্ষণ করেছিল পাকিস্তানি বিমান বাহিনী। তবে সেই যাত্রায় বড় ক্ষতি এড়ানো গিয়েছিল। মতিউর রহমান তখন জেট ফ্লাইং প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছিলেন। সেদিনের বিমান হামলায় আফসোস করে বলতে লাগলেন, ‘এরা আমারই ছাত্র। আমার প্রশিক্ষণ দেওয়া ছাত্ররাই আমার উপর বোমা মারছে।’

আরও পড়ুন: বিশ্বে গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতি আদায়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি

এরপর তিনি বিমান ঘাঁটিতে যাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসেন জানিয়ে আতাউর রহমান বলেন, আমি মায়ের কাছে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে মুক্তিযুদ্ধে যাবে আমি বাধা দেই কেমনে? প্রয়োজনে সাথে তুইও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নে।’এরপর আমি আমার ভাইকে ফলো করতে করতে ঢাকায় যাই। সেখানে তাকে বুঝানোর চেষ্টা করলেও সে ছিল অনড়। ৯ মে সপরিবারে করাচি ফিরে যান। যদিও দুই মাসের ছুটিতে এসে চার মাস পেরিয়ে গেছে ততদিনে। করাচি পৌঁছে লক্ষ্য করেন বাঙালি অফিসারদের সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে। তাকেও তার নিজের দায়িত্ব না দিয়ে দেওয়া হলো ফ্লাইট সেফটি অফিসারের দায়িত্ব। মতিউর রহমানের চিন্তা তখন কেবল একটি বিমানের। তিনি পরিকল্পনা শুরু করেন। সহকর্মীদের সঙ্গে স্বাভাবিক ব্যবহার করছেন আর খুঁজছেন সুযোগ।

২০ আগস্ট ১৯৭১, ফ্লাইট শিডিউল অনুযায়ী মতিউর রহমানের এক ছাত্র রশিদ মিনহাজের উড্ডয়ন দিন। রশিদ মিনহাজ বিমানের ‘ক্যানোপি’ খুলতেই তাকে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে বিমানের পেছনের সিটে লাফিয়ে উঠে বসলেন মতিউর রহমান। কিন্তু জ্ঞান হারাবার আগে মিনহাজ বলে ফেললেন, ‘আই হ্যাভ বিন হাইজ্যাকড’। তবুও বিমানটি যখন ভারতীয় সীমান্তের দিকে যাচ্ছে তখন রশিদ মিনহাজের জ্ঞান ফিরে আসে এবং তিনি বাধা দিতে চেষ্টা করেন। বিমান ছিনতাইয়ের স্বপ্ন সফল হলো না। সীমান্ত থেকে মাত্র দুই মিনিট দূরত্বে সিন্ধু প্রদেশের জিন্দা গ্রামে বালির ঢিবির ওপর আছড়ে পড়ে বিমানটি। বিধ্বস্ত হয় টি-৩৩ যুদ্ধবিমান। সঙ্গে প্যারাসুট না থাকায় মতিউর রহমান শহীদ হন। তার মরদেহ খুঁজে পাওয়া যায় ঘটনাস্থল থেকে প্রায় আধা মাইল দূরে। পাকিস্তান সরকার মতিউর রহমানের মরদেহ করাচির মাসরুর ঘাঁটির চতুর্থ শ্রেণির কবরস্থানে দাফন করে।

আরও পড়ুন: স্বাধীনতা দিবসে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর উপহার

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার দীর্ঘদিন পর ২০০৬ সালের ২৪ জুন মতিউর রহমানের দেহাবশেষ পাকিস্তান হতে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয়। তাকে পূর্ণ মর্যাদায় ২৫ জুন শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে পুনরায় দাফন করা হয়।

ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, ১৯৬১ সালে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন মতিউর রহমান। ১৯৬৩ সালে রিসালপুর পি. এ. এফ কলেজ থেকে পাইলট অফিসার হিসেবে কমিশন লাভ করার পর করাচির মৌরিপুর (বর্তমান যা মাসরুর নামে পরিচিত) এয়ার বেজের দুই নম্বর স্কোয়ার্ডনে জেনারেল ডিউটি পাইলট হিসেবে নিযুক্ত হন। বিমান বাহিনীর প্রতিটি পদে তিনি রেখেছিলেন তার যোগ্যতা ও মেধার ছাপ। মৌরিপুরে টি-৩৩ জেট বিমানের ওপর একটি বিশেষ কোর্সে তিনি পেয়েছিলেন শতকরা ৭৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ নম্বর। এরপর এফ-৮৬ স্যাবর জেটের ওপরও একটি বিশেষ কোর্সে ৮১ শতাংশ নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন তিনি। বৈমানিক কনভার্সন কোর্সে তার অসাধারণ মেধা দেখে তাকে পেশোয়ারের ১৯ নম্বর স্কোয়ার্ডনে পোস্টিং দেওয়া হয়।

১৯৬৭ সালে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্নতি লাভ করেন মতিউর রহমান। ইরানের রানী ফারাহ দিবার সম্মানে পেশোয়ারে অনুষ্ঠিত বিমান মহড়ায় তিনিই ছিলেন একমাত্র বাঙালি পাইলট। রিসালপুরে দুই বছর ফ্লাইং প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করার পর ১৯৭০ সালে তাকে বদলি করা হয় জেট ফ্লাইং প্রশিক্ষক হিসেবে।

এএএম/এসএইচএস/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।