খরতাপে বন্দি বৃষ্টি, পানিশূন্য বীজতলায় দিশেহারা কৃষক
চলতি বছরের জুলাই মাসে বৃষ্টিপাত হয়েছে স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ৫০ শতাংশ কম। তাপমাত্রায় বিশ্বব্যাপী গড়েছে রেকর্ড। আগস্ট মাসেও তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা। এসময় ফসলের মাঠ পানিতে টইটম্বুর থাকার কথা থাকলেও উল্টো ফেটে চৌচির। কোথাও কোথাও সেচে চলছে চাষাবাদ। এ অবস্থায় আমন ও আউশ চাষ নিয়ে দিশেহারা কৃষক।
দেশে মোট ধান উৎপাদনের প্রায় অর্ধেক আসে বোরো মৌসুমে। বাকি আমন জাতের উৎপাদনে অবদান ৩৮ শতাংশ এবং আউশ ৭ থেকে ৮ শতাংশ। তিন মৌসুমে ধান আবাদের মধ্যে বৃষ্টির সময় মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত আউশ ধানের মৌসুম ধরা হয়। আর বোনা ও রোপা আমন চাষ করা হয় জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।
চাষিরা বলছেন, এসময় মূলত জমিতে আমন চারা রোপণ করা হয়। অথচ শ্রাবণ মাসের অর্ধেকের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও জমিতে পানি নেই। ভরা বর্ষায়ও হয়নি বৃষ্টি। পানির অভাবে ব্যাহত হচ্ছে আমন চাষ।
আরও পড়ুন>> কম বৃষ্টি-গরমে নাকাল অস্বাভাবিক এক বর্ষাকাল
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত এপ্রিল-মে মাসে খরা ও বন্যার কারণে আউশের চাষও কম হয়েছে। গত মৌসুমে আউশ ধান চাষ হয়েছিল ১১ লাখ হেক্টরে, যা এবছর কমে হয়েছে ১০ লাখ ৪৫ হাজার হেক্টর।
এবার আমনের বীজতলার লক্ষ্যমাত্রা ছিল তিন লাখ চার হাজার হেক্টরের। যেখানে বীজতলা হয়েছে দুই লাখ ৮৫ হাজার হেক্টর। গত জুলাই পর্যন্ত চারা রোপণ সম্পূর্ণ হয়েছে মাত্র ১৬ শতাংশ, যা গত বছরের এই সময়ের চেয়ে বেশ কম। এবছর ৫৬ লাখ হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস সার্বিক উৎপাদনে খরার প্রভাব কাটাতে বেশ কিছু উদ্যোগের কথা বলছেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, বৃষ্টি কম হওয়ার কারণে সেচকাজে বিদ্যুৎ জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে আমরা বৈঠক করেছি। গত বছরও খরাপ্রবণতা দেখা দিলে সব সরকারি কর্তৃপক্ষ সমন্বিতভাবে কাজ করার সিদ্ধান্ত হয়। সে মোতাবেক এবারও গতকাল বৈঠক হয়েছে। আগেও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ জ্বালানির জন্য চিঠি দিয়েছি। কাল আবার দেবো।
তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করছি যেন কৃষকদের চারা রোপণে কোনো ধরনের সমস্যা না হয়। এবার প্রথম দিকে একটু বৃষ্টি হয়েছে, তখন আমন কিছুটা লাগানো গেছে। সে সময় অর্জন গত বছরের থেকে ভালো ছিল। এখনো সময় রয়েছে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় রয়েছে। মনে হয় কোনো সমস্যা হবে না।
আরও পড়ুন>> শ্রাবণের ‘খরায়’ পুড়ছে কৃষকের কপাল
আউশ উৎপাদন নিয়ে তিনি বলেন, আউশের এবার যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল, তাতে সিলেটে আগাম বৃষ্টির কারণে অনেকে চাষ করতে পারেননি। সেজন্য টার্গেট পূরণ হয়নি। তবে অল্প কম হয়েছে।

খরা ও অসময়ে বন্যার কারণে গত অর্ধ দশক ধরে আউশের আবাদ ও উৎপাদন ক্রমান্বয়ে কমছে। তথ্য বলছে, পাঁচ বছর আগেও ১৩ লাখ হেক্টর জমিতে আউশ চাষ হতো। এখন সেটা ১০ লাখের ঘরে নেমেছে। আর গত বছরের তুলনায় এবছর ন্যূনতম ২ শতাংশ কম হবে উৎপাদন। সব মিলিয়ে বছর ব্যবধানে ৬ থেকে ৭ লাখ টন উৎপাদন কমতে পারে।
চলতি আমন নিয়ে কথা হয় কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে। জয়পুরহাট সদরের জামালপুর এলাকার কৃষক মিজান চৌধুরী জানান, তিনি তার সাড়ে ১৫ বিঘা জমিতে আমন আবাদ করেছেন। বৃষ্টি না থাকায় সেচ খরচ বাবদ এরই মধ্যে তার খরচ হয়েছে ৯ হাজার টাকার বেশি। পানি দেওয়ার জন্য বিঘাপ্রতি তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকায় সেচ নিচ্ছেন তিনি।
আরও পড়ুন>> বর্ষায় পানির অভাবে হাওরবাসীর বোবা কান্না
মিজান চৌধুরী বলেন, একদিকে সেচের খরচ, অন্যদিকে এবছর সারের দাম বাড়ার কারণে অনেকে আমন ধান চাষ করছেন না। কারণ পরিবহন ও শ্রমিকের সব মিলে খরচ ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বাড়বে। তাতে লোকসানের আশঙ্কা রয়েছে।
কৃষকরা বলছেন, আমন মৌসুমের শুরুতে বৃষ্টি হলেও চারা রোপণের সময় তীব্র পানির সংকট দেখা দিয়েছে। যেখানে সেচ দেওয়া সম্ভব তারা পানি দিচ্ছেন। আর যাদের সেচ দিয়ে পানি দেওয়ার সুযোগ নেই তারা এখনো বৃষ্টির জন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। অনেকের বীজতলা পানির অভাবে নষ্ট হচ্ছে। ঠিক সময়ে রোপণ সম্পূর্ণ না করতে পারলে ফলন কমার আশঙ্কা রয়েছে।
আরও পড়ুন>> বর্ষায় বৃষ্টি নেই, পাট জাগ দেওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় কৃষক
নওগাঁর বদলগাছি উপজেলার কোলা গ্রামের কৃষক সায়দুর রহমান বলেন, আউশ ধানের ভালো ফলন হয়নি খরার কারণে। আমন ধান চাষের জন্য আগাম টাকা ধার করেছি। কিন্তু পানির অভাবে আমনের চারাও নষ্ট হচ্ছে। লাগাতে পারছি না। মাঠ ফেটে চৌচির।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান জাগো নিউজকে বলেন, এবছর আবাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। তার চেয়েও বড় কথা হলো দীর্ঘ খরায় সেচ ব্যাহত হয়েছে। সার ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় চাষাবাদ খরচ বেড়ে সংকট তৈরি করেছে, যা আমনের সার্বিক উৎপাদন ব্যাহত করবে।
এ কৃষি অর্থনীতিবিদ বলেন, উৎপাদন খরচ যখন বাড়ে তখন কৃষক উপকরণ সঠিকভাবে দিতে পারেন না। এ কারণে ফলন কমে। দ্বিতীয়ত, এবার আমন রোপণ বিলম্ব হয়েছে, সেটাও ফলন কমার বড় কারণ।
আরেক কৃষি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক গাজী এম জলিল বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খরা তীব্র আকার ধারণ করেছে। এতে যেসব ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সেগুলোর জন্য সরকারকে পরিবর্তিত জলবায়ু মোকাবিলায় নীতি প্রণয়ন করা উচিত। কারণ খরা ও বন্যা উভয়ই বাড়বে দিন দিন, যা গ্রীষ্মকালীন ফসলকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করবে।
এনএইচ/এএসএ/এএসএম