বিদ্যুৎস্পৃষ্টে চারজনের মৃত্যু

‘বাপের কান্ধে পোলার লাশ দুনিয়ার সবচেয়ে ভারী’

তৌহিদুজ্জামান তন্ময়
তৌহিদুজ্জামান তন্ময় তৌহিদুজ্জামান তন্ময় , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:৪১ এএম, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩
মিজান, মিজানের ছেলে হোসাইন, মিজানের স্ত্রী মুক্তা এবং অনিক

ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় ১০ বছর আগে স্ত্রী মুক্তা বেগমকে নিয়ে ঢাকায় আসেন মো. মিজান হাওলাদার (৩০)। এসে ওঠেন রাজধানীর মিরপুরের ঝিলপাড় বস্তিতে। ঢাকায় এসে জীবিকার তাগিদে প্রথমে রিকশা চালাতেন। তবে এতে কষ্ট বেশি হওয়ায় পরে লেবুর শরবত বিক্রি শুরু করেন মিজান। সাত বছর আগে মিজান-মুক্তা দম্পতির ঘর আলোকিত করে আসে মেয়ে সন্তান লিমা আক্তার। ছয় মাস আগে জন্ম হয় ছেলে সন্তান হোসাইনের। কিন্তু এক অজানা ঝড়ে তছনছ হয়ে যায় মিজান-মুক্তা দম্পতির তিল তিল করে গড়ে তোলা সংসার।

গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে তুমুল বৃষ্টির মধ্যে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বাসায় ফিরছিলেন মিজান। ভারী বৃষ্টির কারণে সড়কে জমে যায় পানি। হাঁটু সমান পানি ঠেলেই এগোচ্ছিলেন তারা। রাত সাড়ে ৯টার দিকে কমার্স কলেজ সংলগ্ন ঝিলপাড় বস্তির বিপরীত পাশে রাস্তায় মিজান, তার স্ত্রী মুক্তা ও মেয়ে লিমা বিদ্যুতায়িত হন। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান তারা।

একই ঘটনায় আহত হয় মিজান-মুক্তা দম্পতির ছয় মাসের শিশু সন্তান হোসাইন। বলা যায় অনেকটা অলৌকিকভাবে বেঁচে ফেরে হোসাইন। বাবা-মা হারা শিশু সন্তানের এ পৃথিবীতে আপন বলে আর কেউ রইলো না। মিজানের পরিবারের সদস্যদের উদ্ধার করতে গিয়ে বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা গেছেন একই এলাকার এক তরুণ। মোহাম্মদ অনিক নামের ওই তরুণ অটোরিকশার চালক ছিলেন।

নানির কোলে বেঁচে ফেরা শিশু হোসাইন

এরই মধ্যে এ ঘটনায় নিহত চারজনের মরদেহের ময়নাতদন্ত শেষ হয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে চার মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করেছে কর্তৃপক্ষ।

আরও পড়ুন: মিরপুরে বৃষ্টির পানিতে বিদ্যুতায়িত হয়ে ৪ জনের মৃত্যু

নিহতদের স্বজন ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে নিহত মিজান, তার স্ত্রী ও মেয়ে লিমার দাফন হবে ঝালকাঠিতে। এছাড়া অনিকের মরদেহ নিয়ে গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার খালিয়াজুড়ি গেছেন তার বাবা বাবুল মিয়া।

শুক্রবার (২২ সেপ্টেম্বর) রাতে কথা হয় মিজানের বাবা নাসির হাওলাদারের সঙ্গে। জাগো নিউজকে নাসির বলেন, ঘটনার দিন বৃহস্পতিবার সকালেই মিজান পরিবারসহ বরিশাল থেকে লঞ্চে করে ঢাকায় ফেরেন। এরপর তিনি যান শ্বশুরবাড়িতে। সেখানে থেকে সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরছিলেন। পথে বৃষ্টির কারণে জমে থাকা পানিতে বিদ্যুতায়িত হয়ে স্ত্রী-কন্যাসহ মারা যান। তার শিশু সন্তান হোসাইন হাতে ও পিঠে আঘাত পেয়েছিল। সে এখন তার নানির কাছে আছে।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে নাসির বলেন, ‘বাপের কান্ধে পোলার লাশ দুনিয়ার সব থেইক্কা ভারী। আমার পোলার সাজানো-গোছানো সংসার, ঘরে আসবাবপত্রসহ সবকিছু পড়ে আছে। শুধু আমার পোলা-পোলার বউ আর নাতি লিমা নাই। ছয় মাসের নাতি হোসাইন কীভাবে বড় হবে বাপ-মা ছাড়া?’

মিজানের বাবা আরও বলেন, শুক্রবার বিকেল সাড়ে ৫টায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসাওপাতালের মর্গ থেকে ছেলে, ছেলের বউ ও নাতির মরদেহ বুঝে পাই। পরে সেখান থেকে মরদেহ ঝিলপাড় বস্তিতে নেওয়া হয়। বস্তি থেকে মরদেহ নিয়ে মিরপুর ২ নম্বরে মসজিদ মার্কেটের ঢালে এনে গোসল করানো হয়। গোসল শেষে তাদের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠিতে তিনজনের দাফন হবে।

ঝিলপাড় বস্তি সংলগ্ন দুর্ঘটনাস্থল

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মিজান যখন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন, তখন তার কাঁধে ছিল শিশু হোসাইন। শিশু সন্তান হোসাইনকে বাঁচানোর জন্য তাকে একদিকে ছুড়ে মারেন মিজান। এসময় পানিতে ভাসতে থাকা শিশু হোসাইনকে উদ্ধার করতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান অনিক।

আরও পড়ুন: অলৌকিকভাবে বেঁচে আছে মিরপুরে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট শিশু হোসাইন

অনিকের মামাতো ভাই আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। জাগো নিউজকে আনোয়ার হোসেন জানান, অনিক নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুড়ি উপজেলার মেন্দিপুর ইউনিয়নের সাতগাঁও গ্রামের বাবুল মিয়ার ছেলে। তারা ছয় ভাই ও দুই বোন। অনিক ভাইদের মধ্যে ষষ্ঠ। মিরপুর এলাকায় অটোরিকশা চালাতেন তিনি।

অনিকের মৃত্যুর খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে আসেন তার মামাতো-ফুপাতো ভাইসহ আরও কয়েকজন স্বজন। তারা জানান, পড়াশোনা ছেড়ে ছয়-সাত বছর আগে ঢাকায় আসেন অনিক। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাজ করেছেন। দুই বছর আগে বিয়ে করেন। কিন্তু সম্প্রতি স্ত্রীর সঙ্গে অনিকের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না। কিছুদিন আগে অনিকের স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে গেছেন। শুক্রবার বাড়ি ফেরার কথা ছিল অনিকের। বাড়ি ঠিকই ফিরছেন, তবে লাশ হয়ে।

নিহত মুক্তা

বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগেই কি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা?
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ঝিলপাড় বস্তিকে কেন্দ্র করে বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগের রমরমা ব্যবসা চলে আসছে দীর্ঘদিন। বৃহস্পতিবারের মর্মান্তিক ঘটনাও অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের কারণে ঘটেছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।

স্থানীয়রা জানান, বৃহস্পতিবার ঘটনাটি ঘটে ঝিলপাড় বস্তির বিপরীত পাশের রাস্তায়। রাস্তার বিদ্যুতের খুঁটি থেকে অনেক অবৈধ সংযোগ গেছে বস্তিতে। রাস্তার ভেতর দিয়েও অনেক সরু তারের মাধ্যমে বিদ্যুতের সংযোগ গেছে। বৃহস্পতিবার রাতে বৃষ্টি ও বাতাসের কারণে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের একটি তার রাস্তায় পড়ে যায়। রাস্তায় যখন জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় তখন আর ওই তারটি দেখা যায়নি। এসময় ওই ছেঁড়া তারে বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা যান চারজন।

ছেঁড়া তার খুঁজে পায়নি বিদ্যুৎ বিভাগ
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় দাবি করেছে, তাৎক্ষণিকভাবে ওই এলাকা পরিদর্শন করে কোনো এলটি/এইচটি লাইন ছেঁড়া বা ছেঁড়া বিদ্যুতের তার পায়নি বিদ্যুৎ বিভাগ। ভালোভাবে অনুসনন্ধান করেও ঘটনাস্থলে বা এর আশপাশে বিদ্যুতের কোনো ছেঁড়া তার পায়নি তারা।

আরও পড়ুন: অন্যদের বাঁচাতে গিয়ে পরপারে অনিক

নিহত মোহাম্মদ অনিক

বিদ্যুৎ বিভাগের দাবি, ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো) বৃহস্পতিবার রাত ১০টা ২৫ মিনিটে ফায়ার সার্ভিসের কাছ থেকে মিরপুরের হাজী রোড এলাকায় দুর্ঘটনার খবর পায়। সঙ্গে সঙ্গে রূপনগর বি ও বি (ডেসকো) বিভাগের আওতাধীন রুপালী হাউজিং ও রূপনগর ফিডার বন্ধ করে দেয়। বৃষ্টির মধ্যেই দ্রুত পরিদর্শন টিম পাঠালে দেখা যায় ওই এলাকার রাস্তা পানিতে ডুবে আছে। পরিদর্শন টিম পুরো এলাকা পরিদর্শন করে কোনো এলটি/এইচটি লাইন ছেঁড়া বা ছেঁড়া বিদ্যুতের তার পায়নি। পরে রাত ১১টা ২৭ মিনিটে বন্ধ ফিডার লাইন চালু করা হয়।

বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মৃত্যুর ঘটনায় মামলা
মিরপুর মডেল থানা সূত্রে জানা যায়, এ ঘটনায় অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ এনে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। নিহত অনিকের বাবা বাবুল মিয়া বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।

জানতে চাইলে মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন জাগো নিউজকে বলেন, বৃহস্পতিবার বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে চারজন মারা যাওয়ার ঘটনায় একটি মামলা দায়ের হয়েছে। নিহত অনিকের বাবা অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ এনে মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় আসামি অজ্ঞাতপরিচয়। ওই চারজনের মৃত্যুর পেছনে কারও অবহেলা আছে কি না এবং অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের যে বিষয়টি শোনা যাচ্ছে সেসব বিষয় সামনে এনে তদন্ত চলছে।

টিটি/কেএসআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।