স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে সুন্দরবনের আশেপাশের বাসিন্দারা


প্রকাশিত: ০২:৩৬ এএম, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৪

সুন্দরবনের শেলা নদীতে এখন তেলের ছড়াছড়ি, বাতাসে ভাসছে গন্ধ৷ গত মঙ্গলবার ভোরে শেলা নদীর বাদামতলা খালের মুখে ‘ওটি সাউদার্ন স্টার সেভেন’ নামে তেল বোঝাই ট্যাংকার ডুবে গিয়ে তাতে থাকা তেল নদীতে ভেসে এ অবস্থার সৃষ্টি করেছে৷

শুধু শেলা নদী নয়, বনের অভ্যন্তরের বিভিন্ন খাল ও পার্শ্ববর্তী পশুর নদীর বিস্তীর্ণ এলাকায় তেল আর পানি মিলে একাকার৷ সরকারের তরফ থেকে এলাকাবাসীকে তেল তুলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) কাছে বিক্রি করতে বলা হচ্ছে৷ ৩০ টাকা লিটার দরে এই তেল কিনতে নদীপাড়ে অবস্থান করছে পদ্মা ওয়েল কোম্পানির প্রতিনিধিরা৷ সরকারের এই ঘোষণার পর নারী-শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সের মানুষ তেল তুলতে পানিতে নেমে পড়েছে৷ আর এতে করেই চরম স্থাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হয়েছে সুন্দরবনের আশেপাশের এলাকার বাসিন্দাদের৷

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য ও বাংলাদেশ স্বাস্থ্য আন্দোলনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ ই মাহবুব বলেন, ‘‘পরিবেশ এবং প্রাণীকূলের বিপর্যয়ের পর আমরা নিজেরাই সুন্দরবনের আশেপাশের বাসিন্দাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছি৷ সরকারের তরফ থেকেই বলা হচ্ছে এলাকাবাসীকে তেল তুলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের কাছে বিক্রি করতে৷ এর ফলে গ্রামবাসীদের যাঁরা তেল তুলতে যাচ্ছেন, তাঁদের চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে৷ বিশেষ করে বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ হতে পারে৷ চুলে ও মুখে এই ফার্নেস অয়েল মিশ্রিত পানি লাগার ফলে চুলও পড়ে যেতে পারে৷’’

তিনি বলেন, ‘‘আসলে বিশ্বের বড় এই ম্যানগ্রোভ বনের সঙ্গে জাতিসংঘেরও সম্পৃক্ততা রয়েছে৷ যখন একটা বিপর্যয় হয়েই গেছে, তখন আমরা এই সব হাতুড়ে পদ্ধতিতে না গিয়ে জাতিসংঘের কাছে সাহায্য চাইতে পারতাম৷ কিন্তু সেদিকে আমরা গেলাম না৷ আর তেল তো পানিতে ভেসে থাকে৷ তাই পানির উপরে হালকা বাধা দিয়ে তেলগুলোকে একদিকে নিয়ে যাওয়া যেত৷ তারপর সেখান থেকে অপসারণ করলে কাজটা সহজ হতো৷ এখন গ্রামবাসীতে পানিতে নামিয়ে তেল তোলা হচ্ছে৷ এতে অর্ধেক তেলও তোলা যাবে না৷ কারণ ওই ভেসে থাকা তেলে কিছু দিয়ে স্পর্শ করতে গেলেই তা ভেঙে যাবে৷ ফলে যা হচ্ছে সবই অবাস্তব৷’’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) ও আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. নাসরীন আহমাদ বলেন, ‘‘সুন্দরবনের যে অঞ্চলে ট্যাংকারটি ডুবেছে ওই এলাকা বিপন্নপ্রায় শুশুকসহ বেশ কয়েকটি জলজ প্রাণীর অভয়াশ্রম৷ এ অঞ্চল দিয়ে জাহাজ চলাচলই নিষিদ্ধ রাখা উচিত৷ তেল ছড়িয়ে পড়ার কারণে জলজ প্রাণীর স্বাভাবিক জীবন বাধাগ্রস্ত হবে৷’’ তিনি বলেন, ‘‘শুশুক বা ডলফিন জাতীয় প্রাণীগুলো পানির উপরে উঠে শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করে৷ তেলের গন্ধের কারণে তাদের স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস বাধাগ্রস্থ হওয়ায় মৃত্যু ঝুঁকিও রয়েছে৷ ইতিমধ্যে সাপসহ কিছু জীবজন্তুর মৃত্যুর খবরও পাওয়া যাচ্ছে৷’’

নাসরীন আহমাদ বলেন, ‘‘সুন্দরবন একটি ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট৷ এর গাছের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মূল মাটির নীচে গিয়ে আবার উপরের দিকে উঠে৷ উপরের দিকে উঠে থাকা মূলের অংশটুকু দিয়ে বাতাস থেকে কার্বন ডাই অক্সাইডসহ বেঁচে থাকার উপাদান সংগ্রহ করে৷ এই মূলগুলোতে তেল আটকে থাকার কারণে গাছগুলোর বৃদ্ধি আটকে যাবে৷ এমনকি অনেক গাছ মারাও যেতে পারে৷ তবে সুন্দরবনে এই ধরনের ঘটনা এবারই প্রথম৷ তাই এখনই বলা যাচ্ছে না ক্ষতির পরিমাণ কী রকম হবে৷ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেই আসল চিত্র জানা যাবে৷’’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগের আরেকজন অধ্যাপক ড. এ কিউ এম মাহবুব বলেন, ‘‘সুন্দরবনের ভেতরের নদীগুলোতে যেহেতু জোয়ার-ভাটা হয়, তাই পানিতে ভেসে থাকা তেল বিস্তীর্ণ এলাকায় যাতে ছড়িয়ে পড়তে না পারে সে কারণে খালগুলোর মুখে কলাগাছ বা হালকা কিছু দিয়ে বাঁধ দেয়া যায়৷ বাতাসে তেলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ার কারণে পাখিসহ জীবজন্তুর শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ প্রক্রিয়া ভয়াবহভাবে বাধাগ্রস্ত হবে৷ তেলের গন্ধের তীব্রতার কারণে পাখির চোখ মুখ বা ডানার পালক পুড়ে যেতে পারে৷ হরিণসহ কিছু জীবজন্তু নদী বা খালের কিনারে এসে পানি গ্রহণ করে৷ তেল ছড়িয়ে পড়ার কারণে তারা আর এখন পানি খেতেই পারবে না৷ ফলে তাদের স্বাভাবিক জীবন চক্রই পাল্টে গেল৷’’- ডিডব্লিউ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।