বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড

ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আশরাফ-মুঈনুদ্দীন এখন কোথায়?

মুহাম্মদ ফজলুল হক
মুহাম্মদ ফজলুল হক মুহাম্মদ ফজলুল হক , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:২৯ পিএম, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৩
চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান

১৯৭১ সালের ১৫ নভেম্বর সকালে হাতিরপুলের ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের বাসার সামনে থেকে আলবদর বাহিনী তুলে নিয়ে যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী শল্যচিকিৎসক ডা. আজহারুল হককে। একই সঙ্গে শিক্ষানবিশ চিকিৎসক ডা. হুমায়ুন কবীরকেও তুলে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনী। পরদিন ১৬ নভেম্বর সকালে তাদের মরদেহ পাওয়া যায় নটর ডেম কলেজের দক্ষিণ-পূর্ব কোণায় কালভার্টের নিচে। উদ্ধারের সময় তাদের হাত, পা ও চোখ বাঁধা ছিল। শরীরে ছিল আঘাতের চিহ্ন।

এই দুই চিকিৎসককে হত্যার মধ্য দিয়েই মূলত সূচিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে সুপরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশার বাস্তবায়ন। ১৯৭১ সালের ১৫ নভেম্বর শুরু হওয়া বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড একাধারে চলে ১৬ ডিসেম্বর সকাল পর্যন্ত। সুপরিকল্পিত এ হত্যাকাণ্ডের অন্যতম দুই হোতা আলবদর বাহিনীর নেতা চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান। স্বাধীনতার চার দশকের বেশি সময় পর ২০১৩ সালে এই হত্যাকাণ্ডের বিচারে মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের ফাঁসির রায় দেন আদালত। তবে তারা পলাতক থাকায় রায় ঘোষণার ১০ বছর পরও তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।

আরও পড়ুন: কেন বুদ্ধিজীবী হত্যা

মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে যখন বাঙালির বিজয় প্রায় নিশ্চিত, সেসময় এদেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যার নীলনকশা করে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা। বুদ্ধিজীবীদের হত্যার একমাত্র কারণ ছিল দেশকে পুরোপুরি জ্ঞান-বিজ্ঞান, বুদ্ধিবৃত্তিক ও চিন্তার প্রসারতা শূন্য করা। কারণ বুদ্ধিজীবীরা তাদের জ্ঞান, মেধা, চিন্তার প্রসারতা ও সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যান।

পাকিস্তানি বাহিনীর জানা ছিল, যদি কোনো দেশ বা জাতিকে অন্তঃসারশূন্য করতে হয়, তার জন্য সে জাতিকে বুদ্ধিজীবীশূন্য করাটাই যথেষ্ট। এজন্যই পরিকল্পিতভাবে ঠান্ডা মাথায় চালানো হয় এই চরম পৈশাচিক ও নৃশংস হত্যাকাণ্ড।

মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে যখন বাঙালিদের বিজয় প্রায় নিশ্চিত, সেসময় এদেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যার নীলনকশা করে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা। বুদ্ধিজীবীদের হত্যার একমাত্র কারণ ছিল দেশকে পুরোপুরি জ্ঞান-বিজ্ঞান, বুদ্ধিবৃত্তিক ও চিন্তার প্রসারতা শূন্য করা।

একাত্তরে বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের যে বর্বরভাবে হত্যা করা হয়েছে, এক্ষেত্রে অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তিই পারে গোটা জাতি এবং শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের সদস্যদের ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষা মেটাতে। একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের অন্যতম দুই হোতা, গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনীর নেতা চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় ঘোষণাকালে এ কথা বলেছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

আরও পড়ুন: বাংলাদেশ মেধাশূন্য করতে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে হানাদারবাহিনী

১৯৭১ সালের ১০ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে ১৮ বুদ্ধিজীবীকে অপহরণের পর হত্যার দায়ে মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের ফাঁসির রায় দেন ট্রাইব্যুনাল। এ সংক্রান্ত মামলায় তাদের বিরুদ্ধে ১১টি অভিযোগ আনা হয়। সেসব অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছে রাষ্ট্রপক্ষ।

২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর এ রায় ঘোষণা করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। স্বাধীনতার চার দশকের বেশি সময় পর বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিচার হলেও রায় ঘোষণার সময় এজলাসে আসামির কাঠগড়া ছিল শূন্য। কারণ, স্বাধীনতার পরপরই মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান বিদেশে পালিয়ে যান। এজন্য পলাতক ঘোষণা করে তাদের অনুপস্থিতিতেই শেষ হয় বিচারকাজ। স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও এসব আসামিকে ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকর করা যায়নি।

ট্রাইব্যুনালের তৎকালীন চেয়ারম্যান (বর্তমানে প্রধান বিচারপতি) বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ রায় দেন। তখন ট্রাইব্যুনালের সদস্য ছিলেন বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম। এ সময় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের কয়েকজন সদস্য ও মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের কয়েকজন সাক্ষী এজলাসে উপস্থিত ছিলেন।

রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, জামায়াতে ইসলামীর মস্তিষ্কপ্রসূত ঘাতক বাহিনী আলবদর একাত্তরে বুদ্ধিজীবী নিধনের যে নীলনকশা বাস্তবায়ন করেছে, তা গোটা জাতির বুকে ক্ষত হয়ে আজও রক্ত ঝরাচ্ছে। আমরা আরও বিশ্বাস করি, গত চার দশকে বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যাকারীদের বিচার করতে না পারায় জাতি হিসেবে আমরা লজ্জিত। এ লজ্জা আমাদের ক্ষতকে দিন দিন বাড়িয়ে তুলেছে। বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞ বাঙালি জাতিকে চিরদিন নিদারুণ যন্ত্রণা দিয়ে যাবে।’

আরও পড়ুন: শহীদ বুদ্ধিজীবী সন্তানদের কাছে বিজয় এখনো ‘অসম্পূর্ণ’

ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেন, ‘আশরাফুজ্জামান ছিলেন বুদ্ধিজীবী নিধন পরিকল্পনার চিফ এক্সিকিউটর, মুঈনুদ্দীন ছিলেন অপারেশন ইনচার্জ। তাদের অংশগ্রহণে যেমন বন্দুকের নলের মুখে বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ করে হত্যা করা হয়েছে, তেমনি পুরো হত্যাযজ্ঞের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের বিষয়ে তারা সবকিছু জানতেন। এজন্য বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের জন্য তাদের ব্যক্তিগত অংশগ্রহণের দায় ও ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায় রয়েছে।’

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর আশরাফুজ্জামানের একটি ডায়েরি পাওয়া যায়, যা তাদের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অন্যতম প্রমাণ। ডায়েরিতে ১৯ জন বুদ্ধিজীবীর নাম ও ঠিকানা লেখা ছিল। পাকিস্তানি গবেষক সেলিম মনসুর খালিদের লেখা আলবদর বইয়ের লেখকের কাছে আশরাফুজ্জামান ডায়েরি লেখার বিষয়টি স্বীকারও করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী যেসব অপরাধ হয়েছে সেগুলোর বিচারে গঠিত দুটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এটি ছিল নবম মামলার রায়। মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রথম মামলার রায় হয়েছিল জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সদস্য (রুকন) আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে। তিনিও পালিয়ে যাওয়ায় তার অনুপস্থিতিতে বিচার হয়েছিল।

মুঈনুদ্দীন-আশরাফের হত্যার শিকার ১৮ বুদ্ধিজীবী

মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে মামলায় একাত্তরে ১৮ বুদ্ধিজীবীকে হত্যাসহ ১১টি অভিযোগ আনা হয়েছিল, যার সবকয়টি প্রমাণিত হয়েছে। যেসব বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের শিকার হন তারা হলেন দৈনিক ইত্তেফাকের কার্যনির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন, পিপিআইয়ের (পাকিস্তান প্রেস ইন্টারন্যাশনাল) প্রধান প্রতিবেদক সৈয়দ নাজমুল হক, দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার প্রধান প্রতিবেদক এ এন এম গোলাম মোস্তফা, বিবিসির সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন আহমেদ, শিলালিপির সম্পাদক সেলিনা পারভীন, দৈনিক সংবাদের যুগ্ম সম্পাদক শহীদুল্লা কায়সার, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক সিরাজুল হক খান, ড. মো. মুর্তজা, ড. আবুল খায়ের, ড. ফয়জুল মহিউদ্দিন, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, ক্লিনিক্যাল মেডিসিন ও কার্ডিওলজির অধ্যাপক ফজলে রাব্বী ও চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. আলীম চৌধুরী। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর দিবাগত রাত থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত এসব বুদ্ধিজীবীকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়। তাদের মধ্যে কয়েকজনের মরদেহ পরে পাওয়া যায় রায়েরবাজার ও মিরপুর বধ্যভূমিতে। এছাড়া কয়েকজনের মরদেহের খোঁজ মেলেনি এখনো।

রায়ে বুদ্ধিজীবী হত্যার বিবরণ

ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, চূড়ান্ত বিজয়ের আগমুহূর্তে সুপরিকল্পিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বুদ্ধিজীবীদের তাদের বাসা থেকে অপহরণ করে আলবদর বাহিনী। বুদ্ধিজীবী নিধনের নেতৃত্ব দেওয়া মুঈনুদ্দীন একাত্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র ছিলেন। এজন্যই অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে অপহরণের সময় তিনি মুঈনুদ্দীনকে চিনতে পেরেছিলেন।

আরও পড়ুন: রাষ্ট্র কী সম্মান দিচ্ছে প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী শামসুজ্জোহাকে?

বুদ্ধিজীবী নিধনের ‘অপারেশন ইনচার্জ’ হিসেবে মুঈনুদ্দীন শুধু নিধনে নেতৃত্বই দেননি, নিজেও অংশ নিয়েছেন। বন্দুকের নলের মুখে বাসা থেকে অপহরণ করে বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে যাওয়া হতো মোহাম্মদপুরে শারীরিক শিক্ষা কলেজে স্থাপিত আলবদরের সদর দপ্তরে। সেখানে তাদের চরম নির্যাতনের পর হত্যা করা হতো রায়েরবাজার বা মিরপুর বধ্যভূমিতে নিয়ে।

রায়ে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর আশরাফুজ্জামানের একটি ডায়েরি পাওয়া যায়, যা তাদের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অন্যতম প্রমাণ। ডায়েরিতে ১৯ জন বুদ্ধিজীবীর নাম ও ঠিকানা লেখা ছিল। পাকিস্তানি গবেষক সেলিম মনসুর খালিদের লেখা আলবদর গ্রন্থ অনুসারে, ওই বইয়ের লেখকের কাছে আশরাফুজ্জামান ডায়েরি লেখার বিষয়টি স্বীকারও করেছেন।

ডা. আলীম চৌধুরী হত্যাকাণ্ড নিয়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, আলীম চৌধুরীকে অপহরণের সঙ্গে মাওলানা আবদুল মান্নান জড়িত ছিলেন। একাত্তরের ১৭ ডিসেম্বর মান্নানকে রমনা থানায় সোপর্দ করা হলেও পরে অজ্ঞাত কারণে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। জাতির জন্য লজ্জা, মাওলানা মান্নান পরে স্বৈরশাসক এরশাদ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য হন।

বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের নিয়ে এখন আর কোনো কথা বলতে চাই না। আসামিদের ফিরিয়ে আনতে সরকার কোনো ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে না। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আসামিদের মতো তাদেরও ফিরিয়ে আনতে পারছে না। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে।

রায়ে বলা হয়, কেন বিজয়ের অব্যাবহিত পরে মুঈনুদ্দীন পালিয়ে গেলেন এবং আজও বিদেশে রয়েছেন? রায়ের বছর আল-জাজিরা টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মুঈনুদ্দীন মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে চরম ধৃষ্টতাপূর্ণ ও অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন। একজন অপরাধী সাধারণত তার অপরাধ স্বীকার করেন না। স্বাধীনতার পরপরই পালিয়ে যাওয়াটা তার অপরাধী মানসিকতার স্পষ্ট উদাহরণ। রায়ের সময় মুঈনুদ্দীন যুক্তরাজ্যের লন্ডনের টটেনহামে বসবাস করতেন। আশরাফুজ্জামান বসবাস করতেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের জ্যামাইকায়। তারা দুজনই কানাডায় যাওয়া-আসা করেন, কারণ সেখানে মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ। এমনটি জানিয়েছেন ট্রাইব্যুনালের অন্যতম প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট রানা দাসগুপ্ত।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতকদের ফেরানো নিয়ে যা জানা গেলো

সাবেক আইনমন্ত্রী ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই পালিয়ে যান। তারা যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। বিদেশ থেকে তাদের ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করতে হবে সরকারকেই। যদিও সে চেষ্টা হচ্ছে কি না আমার জানা নেই। তারাও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আসামির মতো। আশা করবো পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় তাদের ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করা হবে।’

ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের চিফ প্রসিকিউটর সিনিয়র অ্যাডভোকেট সৈয়দ হায়দার আলী জাগো নিউজকে বলেন, ‘আলবদর নেতা চৌধুরী মুঈনুদ্দীন আছেন যুক্তরাজ্যের লন্ডনে, আশরাফুজ্জামান খান অবস্থান করছেন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়াতে। এসব দেশের নাগরিকত্ব থাকায় তারা সেখানে আছেন বহাল তবিয়তে, নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্থানীয় মুসলিম সংগঠনের। সেখানে মৃত্যুদণ্ড বিধান না থাকায় ২০১৩ সালে রায় ঘোষণার এত বছর পরও তাদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। তবে তাদের ফিরিয়ে আনতে আমাদের পক্ষ থেকে ইন্টারপোলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।’

আরও পড়ুন: ৭ মার্চের ভাষণ প্রচারের জন্য মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় শেখ আবদুস সালামকে

তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালে বিজয়ের প্রাক্কালে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার নীলনকশা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ওই নীলনকশা বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেয় তৎকালীন কুখ্যাত আলবদর বাহিনী। আলবদরের শীর্ষ নেতা ছিলেন আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়জন শিক্ষক, ছয়জন সাংবাদিক ও তিনজন চিকিৎসকসহ অন্তত ১৮ বুদ্ধিজীবীকে অপহরণের পর হত্যা করেন এই দুজন।’

এসব বিষয়ে কথা হয় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুনের সঙ্গে। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যায় মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনকে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সরকারের অসহযোগিতার কারণে দেশে ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আসামিদের মতো তাদেরকেও ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না। বুদ্ধিজীবীদের হত্যার এসব আসামি ফিরিয়ে আনতে আমাদের দেশ থেকেই উদ্যোগ নিতে হবে।’

ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন আরও বলেন, ‘খুনিরা কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে যাওয়া-আসা করেন, কারণ সেখানে মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ।’

ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন জাগো নিউজকে বলেন, ‘বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৩ সালে ৩ নভেম্বর দুই আলবদর নেতার ফাঁসির রায় দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তবে দেশের বাইরে থাকায় সে রায় এখনো বাস্তবায়ন করা যায়নি। বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের নিয়ে এখন আর কোনো কথা বলতে চাই না। আসামিদের ফিরিয়ে আনতে সরকার কোনো ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে না। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আসামিদের মতো তাদেরকেও ফিরিয়ে আনতে পারছে না।’ এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সিনিয়র অ্যাডভোকেট মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির জাগো নিউজকে বলেন, ‘১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় দুই আলবদর নেতাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তবে দেশের বাইরে থাকায় সে রায় এখনো বাস্তবায়ন করা যায়নি। আশা করবো এসব আসামিকে দেশে ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকর করা হবে। তা না হলে শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে না।’

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অন্যতম প্রসিকিউটর রানা দাসগুপ্ত জাগো নিউজকে বলেন, ‘কিছুদিন আগে কানাডার একটি টেলিভিশন দেখিয়েছে তারা সেখানে অবস্থান করছেন। এ দুই আসামির বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের চূড়ান্ত রায় হয়ে গেছে। বিদেশে পালিয়ে থাকায় এখন উদ্যোগ নিয়ে আসামিদের দেশে ফেরাতে হবে।’

‘ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলমান। তাদের ফেরাতে অনেক আগেই ইন্টারপোলের সহায়তা চাওয়া হয়েছে। ইন্টারপোল রেড নোটিশও জারি করেছিল। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে দুজনকে ফেরত আনার প্রক্রিয়া চালাবে।’

রানা দাসগুপ্ত আরও বলেন, ‘আমরা সব পলাতক খুনিকে বিচারের মুখোমুখি করতে চাই। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে পালিয়ে সে দেশের নাগরিকত্ব নিয়েছেন আসামিরা। আর এ কারণে ওইসব দেশ তাদের ফেরত পাঠাচ্ছে না।’

তিনি বলেন, ‘বুদ্ধিজীবী হত্যায় আশরাফুজ্জামান খানকে চিফ এক্সিকিউটর হিসেবে উল্লেখ করা হয়। আর চৌধুরী মুঈনুদ্দীনকে বলা হয়েছে পরিকল্পনার অপারেশন ইনচার্জ।’

আশরাফুজ্জামান খান ১৯৪৮ সালে গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের চিলেরপাড় গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৭ সালে সিদ্ধেশ্বরী ডিগ্রি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট (এইচএসসি) পাসের পর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে। ওই বিভাগ থেকেই ১৯৭০ সালে স্নাতক শেষ করেন সেসময়ের ইসলামি ছাত্র সংঘের কেন্দ্রীয় নেতা আশরাফুজ্জামান।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকায় আলবদর বাহিনীর নেতৃত্ব দেন আশরাফুজ্জামান। বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী এবং বাস্তবায়নকারী নেতা হিসেবেও তাকে অভিযুক্ত করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পালিয়ে পাকিস্তানে চলে যান তিনি। সেখানে কিছুদিন রেডিও পাকিস্তানে কাজ করার পর চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে।

চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ১৯৪৮ সালের নভেম্বরে ফেনীর দাগনভূঞা থানার চাঁনপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে মুঈনুদ্দীন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী। দৈনিক পূর্বদেশের নিজস্ব প্রতিবেদক হিসেবেও তিনি কাজ করেছেন। বুদ্ধিজীবী হত্যায় সরাসরি নেতৃত্ব দেওয়া মুঈনুদ্দীন বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পালিয়ে পাকিস্তানে চলে যান। পরে সেখান থেকে যান যুক্তরাজ্যে।

এফএইচ/কেএসআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।