রমজানে প্রতিবেশীর খোঁজ কতটা রাখছি

মাহমুদ আহমদ
মাহমুদ আহমদ মাহমুদ আহমদ , ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০৯:২৭ এএম, ১৪ মার্চ ২০২৫

 

পবিত্র মাহে রমজানে আল্লাহপাকের মুমিন বান্দারা বিভিন্ন ধরনের নেক আমল করে থাকেন। আল্লাহপাকের সন্তুষ্টির লক্ষ্যে এ দিনগুলোতে অনেক বেশি দানখয়রাত করে থাকেন। অনেকে প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের খোঁজ-খবর রাখছেন আবার অনেকে রাখছেন না।

রমজান আমাদেরকে প্রতিবেশীর সাথে উত্তম আচরণ, ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসার শিক্ষা দেয়। এই শিক্ষা শুধু রমজানেই সীমাবদ্ধ নয় বরং বছর জুড়ে তা অব্যাহত রাখার নির্দেশ রয়েছে।

আমরা ক’জন এমন আছি যারা রমজান বা অন্য সময় আমাদের প্রতিবেশীর খোঁজ রাখি? নিজের পরিবারের জন্য অপ্রয়োজনীয় খরচ করছি ঠিকই কিন্তু আমার প্রতিবেশী যিনি কষ্টে সেহরি ও ইফতার করছেন তার খেয়াল কি আমি রাখছি?

ঈদ উপলক্ষ্যে সবাই যখন সন্তানদের নতুন জামা কাপড় কেনা নিয়ে ব্যস্ত সেখানে হয়ত এমন অনেক প্রতিবেশী আছে যাদের শিশুরা কাঁদছে দু’মুঠো খাবারের জন্য। এমনই হয়ত অনেক পরিবার আপনার আমার আশপাশে থেকে থাকবে। তাদেরকে সাহায্য করা একজন রোজাদারের জন্য অনেক বড় সওয়াবের কাজ।

রাসুল (সা.) তো সাধারণ দিনগুলোতে অনেক বেশি দান খয়রাত করতেনই আর রমজানে তিনি ঝড়ো গতিতে দান করতেন। ফিতরানা, ফিদিয়া প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন। এই শিক্ষা তিনি (সা.) কেন দিয়েছেন? এজন্যই যে গরীব অসহায়দের কষ্ট যেন আমরা দূর করতে পারি। আল্লাহতায়ালার নির্দেশ অনুসারে আমরা নামাজ, রোজা, হজ সবই করছি কিন্তু প্রতিবেশীর হক সঠিকভাবে আদায় করছি কি? রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ওই ব্যক্তি মুমিন নয়, যে পেট পুরে খায় অথচ তার পাশের প্রতিবেশী না খেয়ে থাকে।

আমাদের এই নামাজ, রোজা, হজ কোনো কিছুই কাজে আসবে না যদি আমরা আমাদের প্রতিবেশীর কষ্ট দূর না করি আর তাদের সুখে-দুঃখে পাশে দাঁড়াই। খাবার না খেয়ে ক্ষুধার জ্বালায় যারা দিনরাত কষ্ট করে কাটায় সেই কষ্ট কেমন তা যেন একজন রোজাদার সারাদিন না খেয়ে উপলব্ধি করতে পারে এজন্য রোজার শিক্ষা আর রোজা রাখার মূল উদ্দেশ্যর মাঝে আত্মিক উন্নতির পাশাপাশি গরিবের প্রতি সহানুভূতির শিক্ষা জাগ্রত করাও উদ্দেশ্য। আত্মীয় এবং প্রতিবেশীর সাথে উত্তম আচরণে ইসলাম অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে।

ভ্রাতৃত্বের বন্ধন দৃঢ় করণ, আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখা এবং প্রতিবেশীদের সাথে ভাল ব্যবহার সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন, ‘এবং তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তার সাথে কোন কিছুকে শরিক করো না, এবং সদয় ব্যবহার কর পিতা মাতার সাথে, আত্মীয় স্বজন এবং এতিম এবং মিসকিন এবং আত্মীয় প্রতিবেশী এবং অনাত্মীয় প্রতিবেশীগণের সাথে এবং সঙ্গী সহচর এবং পথচারীগণের সাথে এবং তোমাদের ডান হাত যাদের মালিক হয়েছে, তাদের সাথে। আল্লাহ তাদেরকে আদৌ ভালোবাসেন না যারা অহংকারী দাম্ভিক।’ (সুরা নিসা: আয়াত ৩৬)।

আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার অনেক ফজিলতও রয়েছে, কেননা, আত্মীয়তার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করা, তাদের খোঁজখবর নেয়া, তাদের কাছে আসা-যাওয়া করা ইবাদতেরই অংশ। যেমন মহানবি (সা.) বলেন: ‘যে ব্যক্তি তার রিজিক প্রশস্ত হওয়া এবং মৃত্যুর সময় পিছিয়ে দেয়া কামনা করে, তার উচিত আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা।’ (বুখারি)

হজরত আবু আইয়ুব আনসারি (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি মহানবিকে (সা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমাকে এমন আমল বলে দিন যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে, তখন তিনি (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর ইবাদত কর, তার সাথে কোন কিছু শরিক করো না। নামাজ ভাল করে আদায় কর এবং জাকাত দাও আর আত্মীয়তার সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রাখ।’ (বুখারি)

অপর দিকে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীদের সম্পর্কে মহানবির (সা.) ভয়াবহ সতর্ক বাণীও রয়েছে। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (বুখারি) ইসলামে যে-সকল অধিকারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্যে আত্মীয় এবং প্রতিবেশীর অধিকার সম্পর্কে অধিক মাত্রায় তাগিদ করা হয়েছে।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক প্রতিবেশীর সাথে সদ্ভাব বজায় রাখার জন্য ঘোষণা করেছেন আর এ ব্যাপারে হাদিসেও ব্যাপক আলোচিত হয়েছে। মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘জিবরাইল এসে আমাকে প্রতিবেশীর ব্যাপারে অবিরত উপদেশ দিতে থাকেন। আমার মনে হল হয়ত তিনি প্রতিবেশীকে সম্পদের ওয়ারিশ বানিয়ে দেবেন।’ (মুসলিম) ইসলাম ধর্মে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার প্রতি এত বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে যে, কাফেরদের সঙ্গেও সম্পর্ক রাখতে আর আত্মীয় অমুসলিম হলেও তার সঙ্গে সম্পর্ক অমলিন রাখতে উৎসাহিত করা হয়েছে।

হজরত আসমা বিনতে বিনতে আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশায় আমার আম্মা মুশরিক থাকতে একবার আমার কাছে আগমন করলেন। আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি আমার সাথে সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী, আমি কি আমার আম্মার সাথে সম্পর্ক রাখবো? মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তর দিলেন, হ্যাঁ, তুমি স্বীয় মাতার সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক রাখবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)

ইসলামের অসংখ্য অনুশাসন মেনে চলা সত্ত্বেও কোনো লোক মুমিনের কাফেলার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না, যদি সে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী হয় এবং প্রতিবেশীদের সাথে সদাচারী না হয়। ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে, কোন মুমিন কোনোভাবেই ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ছিন্ন করতে পারবে না এবং সেই সাথে তার প্রতিবেশীরও অনিষ্ট সাধন করতে পারে না। এ শিক্ষা উপেক্ষা করে কারো পক্ষে পূর্ণ মুমিন হওয়া সম্ভব নয়।

এছাড়া পবিত্র এ মাহে রমজানে দানের গুরুত্ব অনেক। হাদিসে এসেছে, হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুল (সা.) দানশীলতায় সবচেয়ে অগ্রগামী হয়েছিলেন। আর অন্য সময়ের চেয়ে রমজান মাসে তার দানশীলতা অত্যধিক হতো। কেননা জিবরাইল (আ.) প্রতি বছর রমজান মাসে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। রমজান শেষ হওয়া পর্যন্ত রাসুল (সা.) তার সামনে কুরআন পাঠ করে শোনাতেন। যখন জিবরাইল (আ.) মহানবির (সা.) সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন তখন তিনি কল্যাণ প্রবাহের বাতাসের চেয়েও বেশি দানশীল হতেন। (বুখারি ও মুসলিম)

তাই আমাদের আশেপাশে অনেক প্রতিবেশী এমন পাওয়া যাবে যারা অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। আমরা আমাদের সাধ্য অনুযায়ী তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াই। নেক আমলগুলো শুধু রমজানের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে তা বছর জুড়ে অব্যাহত রাখার চেষ্টা করি।

আল্লাহতায়ালা সকলকে পবিত্র মাহে রমজানে অধিকহারে দানখয়রাত ও প্রতিবেশী এবং অসহায়দের পাশে দাঁড়ানোর তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক: প্রাবন্ধিক, ইসলামি চিন্তাবিদ।
[email protected]

এইচআর/এমএস

আমাদের আশেপাশে অনেক প্রতিবেশী এমন পাওয়া যাবে যারা অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। আমরা আমাদের সাধ্য অনুযায়ী তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াই। নেক আমলগুলো শুধু রমজানের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে তা বছর জুড়ে অব্যাহত রাখার চেষ্টা করি।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।