করোনা-কলেরা-ডেঙ্গুর হ্যাচারিতে বসবাস

মোস্তফা কামাল
মোস্তফা কামাল মোস্তফা কামাল , সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০৯:৫১ এএম, ১৭ জুন ২০২৫

সরকারের দিক থেকে সচেতনতা তৈরি, ডাক্তার-নার্সসহ হাসপাতাল প্রস্তুত রাখা কোনোদিকেই কমতি নেই। ঘাটতির প্রায় পুরোটাই নাগরিকদের। আমরা করোনার চেয়েও শক্তিশালী –এবার এ ধরনের কোনো আস্ফালন না থাকলেও গাফিলতি- খামখেয়ালির এক মচ্ছব চলছে। এর জেরে করোনা আচ্ছা মতো পেয়ে বসেছে আবার। বাড়ছে মৃত্যুর তালিকা। ডেঙ্গুতেও প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছে শত শত মানুষ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তথ্য জানাচ্ছে নিয়মিত। দিচ্ছে সাবধানতা। বারবার বলছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে। না শুনলে, না মানলে সরকারের সাধ্য কী?

করোনার নয়া ভ্যারিয়েন্টের কথা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে আরো বছর দেড়েক আগে। প্রতিবেশী ভারতসহ কয়েকটি দেশে সংক্রমণের তথ্যও লুকানো নয়। এরপরও সচেতনতা-সতর্কতা না মানার এক বাতিক আমাদের মাঝে। ভেতরে ভেতরে করোনা যে আবার খাবলে ধরেছে, কলেরায় কতোজন যে আধমরা হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে উদরাময় হাসপাতালে, ডেঙ্গুতে চোখেমুখে আন্ধার দেখছে, তা তাড়িত করছে না। ঈদের ছুটিতে অসচেতনভাবে ভোঁ দৌড়ে এখনও অনেকে। স্বাস্থ্য সচেতনতার বালাই নেই। স্টেশন, রাস্তাঘাট, হাটবাজারে মানুষের কিলবিলে কোথাও স্বাস্থ্যবিধি মানার গরজ নেই।

বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জানুয়ারির মাঝামাঝিতে করোনার ওমিক্রন ধরনের একটি উপধরন জেএন.১-এ আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। দ্রুত ছড়ানোর কারণে জেএন.১-কে ‘ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট’ হিসেবে অভিহিত করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কারও সতর্কতা-সাবধানতার পরামর্শের পরও খামখেয়ালি-হেঁয়ালি করাও আমাদের একটি রোগের মতো। মুখে বাধার একটা মাস্কের ওজন কতোটুকু? হয় মনে থাকে না, নইলে ভারি মনে হয়। মোবাইল ফোনের চেয়েও ওজন বেশি? সেটা বহন করতে তো অসুবিধা হয় না। ঘড়ি- চশমাটা নিতে ভুল হয় না। গাড়িতে বা হাঁটতে হাঁটতেও মোবাইল গুতাগুতিতে অস্বস্তি আসে না।

রাজনৈতিক ব্যতিব্যস্ততা ও নানান দফারফার তোড়ে মাঠ এখন করোনা-কলেরা-ডেঙ্গুর করদ রাজ্য। জন্মাতে, বেড়ে উঠতে, মানুষকে কামড়িয়ে রোগী বানাতে তেমন বাধা নেই। মানবদেহে ডেঙ্গুর সংক্রমণ পদ্ধতি অত্যন্ত জটিল। মশাকে প্রতিষেধক দিয়ে প্রি-প্রোগ্রামও করা যায় না বা ওষুধ দিয়ে রি-ফিক্সও করা যায় না। দেশে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হলেও এর বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করা এখনো বড় চ্যালেঞ্জ। আর করোনা রুখতে প্রধানত দরকার সতর্কতা-সচেতনতা। চিকিৎসকরা নিত্য মাথা পানি করে ফেলছেন-এ বার্তা দিতে দিতে।

মাস্কের বিষয়ে পুলিশ বা সেনাবাহিনী তো এখনো কিছু বলছে না। সেই পর্যন্ত না পরলেও চলবে-ভাবটা এমনই। একটা সময় লকডাউন বা নানা কড়া পদক্ষেপের মধ্যেও মহামারি করোনা তার সক্ষমতা হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে গোটা বিশ্বকে। আমাদেরকেও কম ভোগায়নি। করোনার রূপ আছে বলে তা বদলাচ্ছে। ভ্যারিয়েন্টে তেজি হচ্ছে, মাঝেমধ্যে তেজ কমিয়ে একটু রিলাক্স দিচ্ছে। আগে বিভিন্ন শতকে আসা কলেরা, ম্যালেরিয়া, প্লেগ ইত্যাদি মহামারি রূপ পাল্টে দুর্বল হয়েছে। আর করোনাসহ কয়েকটি ভাইরাস রূপপাল্টে হচ্ছে আরো শক্তিধর।

দৈনন্দিন জীবনে মানুষ চেতনে-অবচেতনে হাত দিয়ে কতো কাজ করে, হাত কতো জায়গায় নেয়- নিজেও জানে না। এসব কাজ করতে গিয়ে হাতে লাগে অসংখ্য জীবাণুর সংস্পর্শ। এতে প্রত্যেকের হাত প্রত্যেকের শত্রু হয়ে ওঠে। যার ফলে ছড়ায় নানা রোগবালাই। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক নিয়মে হাত ধোয়ার অভ্যাস একটি ভালো ভ্যাকসিনের চেয়েও বেশি কাজ করে। সেই বিবেচনায় হাত ধোয়া একটি সাশ্রয়ী স্বাস্থ্য অভ্যাস। নিয়মিত হাতমুখ ধোয়ার অভ্যাস গড়ে উঠলে পানি ও মলবাহিত রোগগুলো এতো দাপট দেখাতে পারতো না।

করোনা আপাতত আমাদের হাতমুখ ধোয়ার অভ্যাস গড়ে দিতে পেরেছে। আরো কিছু বদবৈশিষ্ট্যেও বাধ সাধতে পেরেছে। কোনো রাষ্ট্র তার নাগরিকদের অবিরাম বেত মেরে তাদের সভ্য বানাতে পারে না। নাগরিকদেরও সভ্য হওয়ার ইচ্ছা থাকতে হয়। সুস্থ থাকা ও রাখার চর্চাও করতে হয়। আমরা মরতে চাই না, কিন্তু স্বর্গে যেতে চাই। বিষ গিলতে চাই, মরতে নারাজ। নিয়ম মানতে চাই না । কিন্তু করোনা থেকে সুরক্ষা চাই। হাঁচিকাশি দিতে দিতে, দাঁত খোঁচাতে-খোঁচাতে সরকারের ভুলত্রুটি ধরে ফেলি।

হতে পারে বড় জনসংখ্যার ছোট দেশটিতে রাস্তাঘাটে শারীরিক দূরত্ব রক্ষা করা কঠিন। গণপরিবহনে অন্যের ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলা মুশকিল। বাসের হাতল, সিঁড়ির রেলিং, লিফটের বোতাম, রেস্টুরেন্টের চেয়ার-টেবিল-গ্লাস-প্লেট-তোয়ালে, দোকানির দেওয়া প্যাকেট না ছুঁয়ে থাকা সম্ভব নয়। এরপরও সাবধানতার কিছু বিষয়-আশয় থেকে যায়। যেখানে সরকারের বাইরে মানুষের নিজস্বার্থেই করণীয় অনেক কিছু রয়েছে।

ব্যক্তিপর্যায়ে মানুষকে সাফসতুর রাখার দায়িত্ব সরকারের নয়। সরকারের পক্ষে সেটা সম্ভবও নয়। নিজেরা ভাইরাস ছড়ালে, জন্ম দিলে সরকার কী করবে? যত্রতত্র থুতু ফেলা, পানের পিক ফেলা এবং নাক ঝাড়া বন্ধ করতে সরকারের আদেশ- অনুরোধ লাগছে। নিজেদের চারদিকসহ গোটা পরিবেশকে ভাইরাসের হ্যাচারি করে ফেলছেন কেউ কেউ। চিপসের প্যাকেট, প্লাস্টিকের বোতলসহ আবর্জনা ফেলে ভাইরাসের ভাগাড় তৈরি করলে সরকার বা রাষ্ট্র এখানে কী করবে?

রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় এই করোনার মাঝেও কফ-থুথু, পানের পিক তেমন কমেনি। কোনো কোনো অফিস-আদালতও একেকটি ডাস্টবিন। যার মধ্য দিয়ে করোনাসহ নানা ভাইরাসের বিস্তার ঘটাতে আমরাই যথেষ্ট। নানা সেক্টরের দাবি-দাওয়া, রাজনৈতিক যন্ত্রণা, সংস্কার, দ্রুততম সময়ে নির্বাচন ইত্যাদি আলোচনার মাঝে ডেঙ্গুর ভয়াবতা নিয়ে যেন ভাবার সময় নেই। যে ডেঙ্গুতে ভুগছে সে-ই টের পাচ্ছে, তার কাছেই এটি খবর। স্বাস্থ্য অধিদফতরের কাছে কতোজন মরেছে, আক্রান্তের সংখ্যা জানানো রুটিন দায়িত্ব।

আসল যাতনা-বেদনা কেবল আক্রান্ত ব্যক্তির আর তার স্বজনদের। রাজনৈতিক ব্যতিব্যস্ততা ও নানান দফারফার তোড়ে মাঠ এখন করোনা-কলেরা-ডেঙ্গুর করদ রাজ্য। জন্মাতে, বেড়ে উঠতে, মানুষকে কামড়িয়ে রোগী বানাতে তেমন বাধা নেই। মানবদেহে ডেঙ্গুর সংক্রমণ পদ্ধতি অত্যন্ত জটিল। মশাকে প্রতিষেধক দিয়ে প্রি-প্রোগ্রামও করা যায় না বা ওষুধ দিয়ে রি-ফিক্সও করা যায় না। দেশে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হলেও এর বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করা এখনো বড় চ্যালেঞ্জ। আর করোনা রুখতে প্রধানত দরকার সতর্কতা-সচেতনতা। চিকিৎসকরা নিত্য মাথা পানি করে ফেলছেন-এ বার্তা দিতে দিতে।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ বাংলাভিশন।

এইচআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।