রাখাইন থেকে কক্সবাজার: মাদক সন্ত্রাসের বিস্তার ও ঝুঁকি
মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে চলমান সংঘাত শুধু একটি প্রতিবেশী দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়; এটি ক্রমশ বাংলাদেশের জন্য একটি বহুমাত্রিক নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রূপ নিচ্ছে। বিশেষ করে আরাকান আর্মির উত্থান এবং তাদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে গড়ে ওঠা মাদক অর্থনীতি বাংলাদেশের সমাজ, যুবসমাজ, অর্থনীতি ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য এক গভীর ঝুঁকির ইঙ্গিত দিচ্ছে।
গত এক দশকে আরাকান আর্মি রাখাইনের একটি শক্তিশালী নন-স্টেট আর্মড ফোর্সে পরিণত হয়েছে। সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ এবং স্থানীয় শাসনব্যবস্থায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি তাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি হিসেবে গড়ে উঠেছে একটি সুসংগঠিত মাদক নেটওয়ার্ক। ইয়াবা ও ক্রিস্টাল মেথের মতো সিন্থেটিক ড্রাগ উৎপাদন ও পাচার এই সংগঠনের প্রধান অর্থের উৎসে পরিণত হয়েছে, যার সবচেয়ে বড় বাজার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বাংলাদেশ।
ভৌগোলিক অবস্থান বাংলাদেশের জন্য এই সংকট আরও জটিল করে তুলেছে। নাফ নদী, উপকূলীয় জলসীমা, পাহাড়ি দুর্গম এলাকা এবং দীর্ঘ সীমান্ত—সব মিলিয়ে মাদক পাচারের জন্য এটি একটি আদর্শ রুট। সীমান্তের অপর পাশে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকাগুলো কার্যত নিরাপদ করিডোরে পরিণত হয়েছে, যেখান থেকে নিয়মিতভাবে মাদক বাংলাদেশে প্রবেশ করছে।
এই মাদক সন্ত্রাসের সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো এর সামাজিক প্রভাব। ইয়াবা ও আইসের সহজলভ্যতা দেশের যুবসমাজকে দ্রুত মাদকাসক্ত করে তুলছে। কর্মক্ষমতা হ্রাস, অপরাধে জড়িয়ে পড়া, পারিবারিক ভাঙন এবং সামাজিক অস্থিরতা—সবকিছু মিলিয়ে এটি একটি নীরব জাতীয় বিপর্যয়ের রূপ নিচ্ছে। মাদক অর্থনীতি শুধু ব্যক্তিকে নয়, ধীরে ধীরে রাষ্ট্রের সামাজিক কাঠামোকেও দুর্বল করে দিচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গা সংকট একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল মাত্রা যোগ করেছে। বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের একটি ক্ষুদ্র অংশ—দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সুযোগে—মাদক পাচারকারী সিন্ডিকেটগুলোর দ্বারা ব্যবহৃত হচ্ছে। শরণার্থী শিবিরগুলোর ভৌগোলিক অবস্থান, সীমান্তের নিকটতা এবং আইন-শৃঙ্খলা সীমাবদ্ধতার কারণে কিছু ক্যাম্প মাদক পরিবহনের লজিস্টিক নোডে পরিণত হয়েছে। এটি মনে রাখা জরুরি, পুরো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নয়, বরং একটি অপরাধপ্রবণ অংশই এই কর্মকাণ্ডে যুক্ত—তবুও এর নিরাপত্তাগত প্রভাব উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।
মাদক ব্যবসা থেকে অর্জিত বিপুল অর্থ আরাকান আর্মিকে আরও শক্তিশালী করছে। এই অর্থ অস্ত্র কেনা, যোদ্ধা নিয়োগ এবং সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ব্যবহৃত হচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলছে। সীমান্তে গোলাগুলি, জেলেদের অপহরণ, অনুপ্রবেশ ও চোরাচালান—সবকিছুই এই মাদক অর্থনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত।
অর্থনৈতিক দিক থেকেও এর প্রভাব গভীর। মাদক পাচারের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশ থেকে পাচার হচ্ছে, যা কালো টাকার অর্থনীতিকে শক্তিশালী করছে। উৎপাদনশীল শ্রমশক্তির ক্ষয় এবং স্বাস্থ্যখাতে অতিরিক্ত চাপ দীর্ঘমেয়াদে জাতীয় প্রবৃদ্ধিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশ ‘মাদক ট্রানজিট রুট’ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ছে, যা কূটনৈতিক চাপ ও ভাবমূর্তি সংকট তৈরি করতে পারে।
এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় একক কোনো পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। সীমান্তে নজরদারি জোরদার করা, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার, মাদকবিরোধী অভিযানে কঠোরতা এবং অভ্যন্তরীণ সিন্ডিকেট ভাঙা—এসবের পাশাপাশি প্রয়োজন সমন্বিত কূটনৈতিক উদ্যোগ। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া আরাকান আর্মির মাদক নেটওয়ার্ক ভেঙে ফেলা সম্ভব নয়।
একই সঙ্গে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোর নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনা আরও শক্তিশালী করতে হবে। কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও পুনর্বাসনমূলক উদ্যোগ বাড়িয়ে অপরাধমূলক নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়ার ঝুঁকি কমানো জরুরি। যুবসমাজকে মাদক থেকে রক্ষায় সচেতনতা ও পুনর্বাসন কার্যক্রমও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
সবশেষে বলা যায়, আরাকান আর্মির মাদক অর্থনীতি বাংলাদেশের জন্য শুধু একটি সীমান্ত সমস্যা নয়; এটি একটি ধীরে ধীরে বিস্তারমান জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকি। এখনই যদি সমন্বিত ও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, ভবিষ্যতে এই মাদক সন্ত্রাস বাংলাদেশের সামাজিক স্থিতি ও নিরাপত্তা কাঠামোকে গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এখনই সতর্ক হওয়াই ভবিষ্যৎ বিপর্যয় ঠেকানোর একমাত্র পথ।
লেখকঃ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
এইচআর/এমএস