কৃষিই ভরসা কৃষিতেই আশা

আব্দুল বায়েস
আব্দুল বায়েস আব্দুল বায়েস , সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশিত: ০৯:৫৩ এএম, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

দারিদ্র্য হ্রাসে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উপর কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধির প্রভাব মূল্যায়ন করতে গেলে দারিদ্র্য হ্রাসে প্রবৃদ্ধির স্থিতিস্থাপকতা- ইলাস্টিসিটি অব গ্রোথ অন পভার্টি রিডাকশন- পর্যালোচনা করার প্রয়োজন হয় । অর্থাৎ গড় জাতীয় আয় যদি এক শতাংশ বাড়ে তাহলে দারিদ্র্যের হার কী পরিমাণ কমে সেই সম্পর্কটা দেখার প্রয়াস নেয়া দরকার বলে গবেষকগণ মনে করেন । এক গবেষণায় দেখা যায়, সাধারণত, উন্নয়নশীল দেশে সহগটির মান গড়পড়তা মাইনাস ২ অর্থাৎ , গড়পড়তা প্রকৃত মাথাপিছু আয় ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেলে দারিদ্র্যের হার কমবে ২০ শতাংশ । তাহলে পাঠক বুঝে নিন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দারিদ্র্য হ্রাসে কেন এবং কতোটা গুরুত্বপূর্ণ ।

একটু ঘুরিয়ে বলতে হয়, তোরা যে যা বলিস ভাই, প্রবৃদ্ধি আমার চাই – বিশেষত বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল একটা দেশে। তবে বাংলাদেশে সহনীয় দারিদ্র্যের প্রবৃদ্ধি স্থিতিস্থাপকতা সত্যি খুব কম এবং তাও ২০০৫ সাল থেকে নিম্নগামী । হিসাব কষে দেখানো হচ্ছে যে, ২০১৬-২০২২ সময়কালে সহগটির মান ছিল মাত্র শূন্য দশমিক আট শূন্য । এর অর্থ দাঁড়ায় , বাংলাদেশে মাথাপিছু প্রকৃত আয় ১০ শতাংশ বাড়লে সহনীয় দারিদ্র্যে কমে মাত্র ৮ শতাংশ (উন্নয়নশীল দেশের গড় ২০ শতাংশ ) । এর বিপরীতে ২০১০-২০১৬ সময়ে সহগটি ছিল শূন্য দশমিক আট চার এবং ২০০৫-২০১০ সময়ে শূন্য দশমিক নয় ছয় । মোট কথা, এটা প্রমাণ করে যে বাংলাদেশে সহনীয় দারিদ্র্য হ্রাসে প্রবৃদ্ধির প্রাঙ্গমতা বেশ কম এবং সেটা গেল ১৭ বছর ধরে ক্রমাগত নিম্নমুখী হচ্ছে ।

বিবিএস এর তথ্য ব্যবহার করে দেখানো যেতে পারে যে, দারিদ্র্য হ্রাসে কৃষির প্রবৃদ্ধি – স্থিতিস্থাপকতার মান ২ দশমিক ২৬ অর্থাৎ ২০১৬ -২০২২ সময়কালে মাথাপিছু প্রকৃত কৃষি জিডিপি ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ২৩ শতাংশ দারিদ্র্য হ্রাস ঘটায় অথচ এর বিপরীতে অ -কৃষি প্রবৃদ্ধি স্থিতিস্থাপকতা হচ্ছে শূন্য দশমিক ৭২ যার অর্থ অ– কৃষি কর্মকাণ্ডে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলে দারিদ্র্য হ্রাস পায় মাত্র ৭ শতাংশের কোঠায়। মনে হয় এমনতর পরিসংখ্যান এটা প্রমাণ করতে চায় যে , অন্তত দারিদ্র্য হ্রাসে, কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি অ -কৃষি খাতের তুলনায় তিনগুণের চেয়ে বেশি শক্তিশালী । অর্থাৎ , বাংলাদেশের দারিদ্র্য হ্রাসে একই হারে প্রবৃদ্ধি অ- কৃষির চেয়ে কৃষিতে বেশি কার্যকর ।

দুই.
এখন মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন হল দারিদ্র্য হ্রাসে কৃষি খাতের ভূমিকা কী। ঐতিহাসিকভাবে উন্নয়নশীল দেশে দারিদ্র্য কমাতে কৃষি খাত একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। কৃষি থেকে জিডিপির যে হিস্যাটা আসে, তা সমাজের সবচেয়ে শুধু দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে তাৎপর্যপূর্ণ আয়ের সূত্রপাত ঘটায় । তাছাড়া , শুধু সরাসরি দারিদ্র্য হ্রাস নয়, পুরো অর্থনীতিতে শক্তিশালী লিংকেজ প্রভাব নিয়ে হাজির হয় কৃষি খাত। কৃষির পরোক্ষ অবদান আসে খামার বহির্ভূত কর্মকাণ্ডে – যেমন সার, সেচযন্ত্র , কীটনাশক এবং অন্যান্য উপকরণের চাহিদা সমেত ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ এবং প্যাকেজিং, পরিবহন, শিল্পজাত প্রক্রিয়াকরণ , সংরক্ষণ এবং কৃষি পণ্যের বাজার সমেত ফরওয়ার্ড লিংকেজ গড়ার মাধ্যমে। এই কর্মকাণ্ডগুলো ব্যাপক প্রবৃদ্ধি ঘটায় খামার -বহির্ভূত খাতে যার মধ্য দিয়ে সংঘটিত হয় বর্ধিত কর্মসংস্থান ও আয়। যাই হোক , দেশ যতই সম্পদশালী হবে দারিদ্র্য হ্রাসে কৃষির প্রবৃদ্ধির ধার , খামার – বহির্ভূত খাতের তুলনায় – ততই কমবে বলে ধারণা করা হয়ে থাকে।

কৃষি খামারি এমন পরিবারের সংখ্যা প্রায় দুই কোটি– ক্ষুদ্র খামার আগের চেয়ে ২৪ শতাংশ বেশি আর মধ্যম ও বড় খামারের সংখ্যা যথাক্রমে ২৯ এবং ৪১ শতাংশ কম। খামারের গড় আয়তন শূন্য দশমিক ৮ একর। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি যাদের নিজের এবং বর্গায় নেয়া জমি মিলে আবাদি জমি আড়াই একরের নিচে তারা মোট কৃষকের ৯২ ভাগ এবং মোট চাষের জমির ৬০ ভাগ তাদের নিয়ন্ত্রণে। বাকি জমি মধ্যম ও বড় কৃষক চাষ করে যারা মোট কৃষকের ১০ ভাগ। মোট কথা, বাংলাদেশের কৃষির মধ্যমণি এখন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষী এবং তাদের প্রাধান্য দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

তিন.
সময়ের বিবর্তনে বাংলাদেশের কৃষি খাতের অর্জনগুলো মোটা দাগে সন্তোষজনক বলে সমাজবিজ্ঞানীগণ মনে করেন। সম্প্রতি বিশিষ্ট কৃষি অর্থনীতিবিদ এম এ সাত্তার মণ্ডলের গবেষণায়ও তা ফুটে উঠেছে । যেমন , মোট জিডিপিতে কৃষির আনুপাতিক হিস্যা আশির দশকের প্রায় ৩৫ শতাংশ থেকে অধুনা ১২ শতাংশ হলেও গত প্রায় এক দশক ধরে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ঘটছে গড়ে ৩ শতাংশ হারে । তবে লক্ষণীয় পরিবর্তন আসে বিভিন্ন উপখাতের হিস্যায় - যেমন ১৯৯০ সালে কৃষি জিডিপিতে ফসল উপখাতের অবদান ৬৫ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে অধুনা ৪৮ শতাংশ ; প্রাণিসম্পদের অবদান ১২ থেকে বেড়ে ১৫ এবং মৎস্য উপখাতের অবদান ১৫ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২২ শতাংশে উপনীত। আপাতদৃষ্টে , এই কাঠামোগত পরিবর্তনের তাৎপর্য সহজেই অনুমেয় এবং তা হল বাজারে প্রোটিন সমৃদ্ধ কৃষির উৎপাদন ঊর্ধ্বমুখী ।

তবে বিস্ময়কর ব্যাপার হল পড়ন্ত আবাদি জমির মুখে বাড়ন্ত উৎপাদন । একটা উদাহরণ ধার করে বলা চলে যে ১৯৭২-৭৩ সালে মাথাপিছু আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ছিলও ২৮ ডেসিম্যাল , আর আজকে ৫০ বছর পর মাথাপিছু আবাদযোগ্য জমি ঠেকেছে ১০ ডেসিম্যালে । অথচ তখন চাল এবং আটা সমেত মাথাপিছু খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিলও ১৪০ কেজি যা অতিসম্প্রতি দ্বিগুণেরও বেশি ২৮৫ কেজি। এককালের চাল আর গমের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ভুট্টার উৎপাদন । মোট কথা রাখে আল্লাহ মারে কে – আবাদি জমির পরিমাণ বছরে প্রায় অর্ধ – শতাংশ হ্রাস পেলেও মাথাপিছু খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধি ঘটেছে ১৪৫ কেজির মতো ; মাত্র ৪ কেজি মাংস উৎপাদনের বিপরীতে এখন ৫৫ কেজি মাংস উৎপাদিত হয় ; ডিম ১৫ থেকে ১৩৮ টি ; দুধ ৬ কেজি থেকে ৭৭ কেজি; মাছ ১১ কেজি থেকে ২৮ কেজি মাথাপিছু উৎপাদন। বলাবাহুল্য, এই পরিবর্তনের পরিণতিতে আমরা এখন খাদ্যে প্রায় স্বয়ম্ভর ,শাকসবজি , মাছ, মাংস , ডিম দুধ অভ্যন্তরীণ উৎস জোগানদার , এর ফলে গ্রামে আয় বৃদ্ধি পেয়েছে , কমেছে অনাহার ও অপুষ্টি – দুর্ভিক্ষের ছায়ার বাইরে বাংলাদেশের অবস্থান।

কারা এই পরিবর্তনের পথিকৃৎ?
কৃষি খামারি এমন পরিবারের সংখ্যা প্রায় দুই কোটি– ক্ষুদ্র খামার আগের চেয়ে ২৪ শতাংশ বেশি আর মধ্যম ও বড় খামারের সংখ্যা যথাক্রমে ২৯ এবং ৪১ শতাংশ কম। খামারের গড় আয়তন শূন্য দশমিক ৮ একর। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি যাদের নিজের এবং বর্গায় নেয়া জমি মিলে আবাদি জমি আড়াই একরের নিচে তারা মোট কৃষকের ৯২ ভাগ এবং মোট চাষের জমির ৬০ ভাগ তাদের নিয়ন্ত্রণে। বাকি জমি মধ্যম ও বড় কৃষক চাষ করে যারা মোট কৃষকের ১০ ভাগ। মোট কথা, বাংলাদেশের কৃষির মধ্যমণি এখন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষী এবং তাদের প্রাধান্য দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

মধ্যম ও বড় চাষীদের দিন দিন হারিয়ে যাওয়া এবং ছোট কৃষকদের প্রবল প্রভাবের একটা ব্যাখ্যাও দিলেন সাত্তার মন্ডল : বড় ও মধ্যম কৃষক পরিবারে কাজ করার মতো লোকবলের অভাব বিধায় কেনা শ্রমিক – নির্ভর চাষাবাদ অত্যন্ত ব্যয়বহুল । অগত্যা তারা জমি বর্গা , বন্ধক কিংবা লিজ দিচ্ছেন তাদের কাছে যারা এককালে তাদেরই জমি আবাদ করতেন। এর বিপরীতে ছোট কৃষকদের রয়েছে অপেক্ষাকৃত বেশি পারিবারিক শ্রম । তবে ছোট অথবা বড় সকল কৃষক পরিবারের তরুণ সদস্যদের মাঝে কায়িক শ্রম সাধ্য কৃষিকাজের প্রতি অনাগ্রহ অপ্রকাশিত নয়।

চার.
কৃষি ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যিক হয়ে উঠছে যেমন পারিবারিক উপকরণের চেয়ে বাজার- নির্ভর উপকরণ ব্যবহারের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে বাজারে কৃষি সেবা প্রদানকারী নতুন নতুন খেলোয়াড় আসছেন। গবেষক এম এ সাত্তার মন্ডলের মতে এদের মধ্যে আছে নব্য কৃষক, মজুরি শ্রমিক , পরিবহন সেবা, প্রাণী খাদ্য ও ভ্যাকসিন উৎপাদক ও বিক্রেতা ফসল কর্তন, মাড়াই , ঝাড়াই ইত্যাদি যন্ত্রের মেকানিক ও চালক। সেই সঙ্গে আছে হাজার হাজার কৃষিযন্ত্র আমদানিকারক, বিক্রেতা, যন্ত্রাংশ মেরামতের ওয়ার্কশপ ।

এমন একটা পরিবেশে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের, বিশেষত কর্পোরেট কৃষিতে, অস্তিত্ব কেমনে টিকে থাকবে তা অবশ্য গবেষণা করেছেন গবেষক এমএ সাত্তার মন্ডল তবে এ বিষয়ে পরবর্তীতে আলোচনা করা যেতে পারে।

লেখক : অর্থনীতিবিদ, কলামিস্ট। সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।