বিহারের নির্বাচনে নীতীশের মাস্টারস্ট্রোক নাকি বুমেরাং?

প্রশান্ত কুমার শীল
প্রশান্ত কুমার শীল প্রশান্ত কুমার শীল , গণমাধ্যম শিক্ষক ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক
প্রকাশিত: ০৯:৫৩ এএম, ২৩ অক্টোবর ২০২৫

বিহার হলো ভারতের অন্যতম দরিদ্র রাজ্যগুলোর মধ্যে একটি। কিন্তু রাজনৈতিক চালচিত্রের দিক থেকে বরাবরই এই রাজ্যটা অনেকটা দাবার বোর্ডের মতো। যেখানে প্রতিটি চালের পেছনে থাকে দূরদর্শী হিসাব। ২০২৫ সালের ভারতের বিধানসভা নির্বাচনের আগে মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার আবারও সেই বোর্ডে নিজের ঘুঁটি সাজিয়ে ফেলেছেন। অক্টোবরের শুরুতে তিনি ঘোষণা করেন, ২৫ লাখ অবিবাহিত নারীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সরাসরি ২৫০০ কোটি টাকা অনুদান দেওয়া হবে ‘মুখ্যমন্ত্রী মহিলা রোজগার যোজনা’র আওতায়। নির্বাচনের মাত্র এক মাস আগে প্রত্যেক নারীকে ১০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা অনেকের কাছেই ‘নীতীশের মাস্টারস্ট্রোক’ বলে মনে হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, এটা কি সত্যিই নারী স্বাধীনতার পদক্ষেপ, নাকি নিখাদ নির্বাচনি কৌশল?

ভারতের নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করেছে, বিহারের ভোট ৬ ও ১১ নভেম্বর, গণনা হবে ১৪ নভেম্বর। ভোটের সময় ঘনিয়ে আসতেই নারীদের নিয়ে এমন ‘সোনার টোপ’ যেন হঠাৎ করেই আলোচনায় উঠে এসেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও বলেছেন, এ প্রকল্প নারীদের স্বনির্ভর করবে এবং কেন্দ্রের ‘লক্ষপতি দিদি’ মিশনকে শক্তিশালী করবে। বর্তমান শাসকজোট এনডিএর বক্তব্য হলো এটাই উন্নয়নের রাজনীতি। কিন্তু মাঠের ছবিটা তেমন উজ্জ্বল নয়।

বিহারের গ্রামীণ জীবনের কেন্দ্রবিন্দু হলো নারীরা। ২০০৫ সালে নীতীশ কুমার ক্ষমতায় এসেই পঞ্চায়েতে নারীদের জন্য ৫০ শতাংশ সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যা তার রাজনৈতিক জনপ্রিয়তার ভিত্তি তৈরি করে। ২০২০ সালের নির্বাচনে পুরুষদের তুলনায় বেশি ভোট দিয়েছিলেন নারীরা। পুরুষদের ভোটহার ছিল ৫৪.৬ শতাংশ, আর নারীদের ৫৯.৭। সেই নারীরাই আজ নীতীশের বড় ভরসা। তাই ১০ হাজার টাকার অনুদান যেন এক ঢিলে দুই পাখি—উন্নয়ন দেখানোও হলো, আবার ভোটার ধরে রাখাও হলো। কিন্তু যারা প্রকৃত উপকৃত হওয়ার কথা, তারা বলছেন অন্য গল্প।

নীতীশ কুমারের রাজনীতি বরাবরই বাস্তববাদী। তিনি জানেন, বিহারের নারী ভোটাররাই তার সবচেয়ে বড় শক্তি। কিন্তু শক্তিকে টিকিয়ে রাখতে হলে কৌশল নয়, প্রয়োজন আস্থা। আর সেই আস্থা গড়ে ওঠে কাজ দিয়ে, অনুদান দিয়ে নয়। বিহারের নির্বাচনি হাওয়া তাই এখন এক অদ্ভুত দোলাচলে। নীতীশের অনুদানের গল্প কি সত্যিই উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি, নাকি ভোটের আগের নাটকীয় মাস্টারস্ট্রোক? উত্তরটা মিলবে ১৪ নভেম্বরের ভোটগণনার দিন।

বিহারের বেতিয়া জেলার সতবিধুয়া গ্রামের জীবিকা দিদি সবিতার মতে, ‘সরকারের দেওয়া টাকাটা হাতে পাব কি না জানি না, পেলেও ক্ষুদ্রঋণ কোম্পানির লোকেরা কেড়ে নেবে ‘ আসলে বিহারের লাখ লাখ নারী বহু বছর ধরে ক্ষুদ্রঋণের ফাঁদে আটকে আছেন। প্রথমে ২০-৩০ হাজার টাকার ছোট ঋণ নিয়ে সংসার চালানোর চেষ্টা করেছিলেন, পরে সেই ঋণ শোধ করতে আরও ঋণ নিতে হয়েছে। সুদের হার এতটাই বেশি যে অনেকে শেষমেশ ঘরছাড়া হয়েছেন। ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলোর নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়ার পর তাদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে বহুগুণে। সংবাদমাধ্যমে বারবার এসেছে, ঋণের চাপে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে। এখন সরকারের দেওয়া অনুদানই তাদের কাছে আরেকটি সুযোগ নয়, বরং আরেকটি দায়।

২০২০ সালে বিহারে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলো প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছিল। ২০২৩ সালে সেই অঙ্ক বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকায়। অর্থাৎ, সরকার যত উন্নয়নের স্বপ্ন দেখাক না কেন, গ্রামীণ বাস্তবতায় ঋণের জাল আরও ঘন হচ্ছে। এই অবস্থায় নীতীশের ঘোষণায় নারীদের চোখে আশার চেয়ে বেশি আতঙ্ক। কারণ সরকারি অনুদান মানেই ঋণ আদায়কারীদের নতুন হুমকি।

নীতীশ কুমারের ঘোষণায় বলা হয়েছে, এক পরিবার থেকে একজনই পাবেন এই অর্থ, যদি তার স্বামী সরকারি চাকরিজীবী না হন বা পরিবার আয়করের আওতায় না পড়ে। শর্ত শুনতে স্বচ্ছ মনে হলেও, গ্রামীণ বাস্তবতা তা নয়। কারণ, বেশিরভাগ অবিবাহিত নারীর নামই ভোটার তালিকা সংশোধনের সময় বাদ পড়ছে—বিশেষ করে যারা ঘর ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে গেছেন ক্ষুদ্রঋণের চাপে। এই ভোটার বাদ পড়ার ঘটনাও এখন নির্বাচনের আলোচনায় উঠে এসেছে।

নীতীশের ১০ হাজার টাকার অনুদান তাই অনেকের চোখে ‘অর্থনৈতিক চাল’ নয়, ‘রাজনৈতিক ফাঁদ’। কারণ, বিহারের ভোটারদের প্রায় অর্ধেকই নারী, আর তাদের মধ্যে ৪০ শতাংশ ‘জীবিকা দিদি’ প্রকল্পের সদস্য। এত বড় সংখ্যক ভোটারকে প্রভাবিত করতে পারলে নির্বাচনের ফলও অনেকটাই নিজেদের অনুকূলে রাখা যাবে—এই বিশ্বাস থেকেই এই পদক্ষেপ। নরেন্দ্র মোদীও প্রশংসা করে বলেন ‘বিহার হবে লক্ষপতি দিদিদের রাজ্য’। কিন্তু যেখানে লাখ লাখ নারী আজও সুদের বোঝায় জর্জরিত, সেখানে ‘লক্ষপতি দিদি’ হওয়ার স্বপ্নটা শুনতে যতই ভালো লাগুক, বাস্তবে তা যেন মরুভূমির মরীচিকা।

অন্যদিকে বিরোধী মহাগঠবন্ধন হলো আরজেডি, কংগ্রেস ও বাম দলগুলোর জোট—এই ইস্যুটিকে নির্বাচনী হাতিয়ার হিসেবে নিতে চাইছে। বামেরা তো বহুদিন ধরেই ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। তাদের গণভিত্তি মূলত গরিব পরিবার। বিশেষত সেই নারীরা, যারা এই ঋণের জালে আটকে আছেন। তাদের মতে, বিহারের নির্বাচন এবার চাকরি, শিক্ষা বা পরিযায়ী শ্রমিকদের ইস্যুর পাশাপাশি ক্ষুদ্রঋণই বড় আলোচ্য হবে। কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়ঙ্কা গান্ধীও সম্প্রতি এক গণজমায়েতে বলেন, ‘নারীদের empowerment বললেই হবে না, তাদের জীবনের বাস্তব সমস্যাগুলোর সমাধান আনতে হবে।’

কিন্তু প্রশ্ন হলো, মহাগঠবন্ধন কি এই ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠে প্রচার চালাতে পারবে? ইন্ডিয়া জোট হিসেবে যে ঐক্য কিছুদিন আগেও চোখে পড়েছিল, তা এখন অনেকটাই ঝাপসা। বামেরা যত বেশি আসনে লড়বে, তত বেশি এ সমস্যাটা সামনে আসবে। কিন্তু ইতোমধ্যে সিপিআই (এমএল) লিবারেশন দলের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে পুরোনো মামলায় গ্রেফতারের ঘটনাও ঘটছে, যা দেখাচ্ছে তা হলো এই ইস্যু নিয়ে মাঠ গরম হওয়ার আগেই শাসকদল নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করছে।

নীতীশের এই ‘মহিলা রোজগার যোজনা’ তাই এখন এক দ্বিমুখী তরবারি। একদিকে উন্নয়ন ও নারী-স্বনির্ভরতার সুন্দর গল্প, অন্যদিকে দারিদ্র্য, ঋণ ও অনিশ্চয়তার কাঁচা বাস্তব। বিহারের গ্রামীণ জনপদে সেই বাস্তবই বেশি জ্বলজ্বল করছে। ১০ হাজার টাকার অনুদান সত্যিই যদি নারীদের হাতে থাকে, তবে তা হয়তো ক্ষুদ্র ব্যবসার পুঁজি হতে পারত। কিন্তু যখন সেই টাকা ঋণ শোধে চলে যায়। তখন তা আর ক্ষমতায়ন নয় বরং রাজনীতির গোপন চাবি হয়ে ওঠে।

নীতীশ কুমার একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিক। তিনি জানেন কোন সময়ে কীভাবে চাল দিতে হয়। ২০০৫ সালে তিনি সংরক্ষণের মাধ্যমে নারীদের মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন, আজ তিনি সেই পুরোনো সমর্থনকে আবার নতুন করে জাগাতে চাইছেন। কিন্তু বিহারের বর্তমান পরিস্থিতি অনেক জটিল। মানুষের পেটে ভাত নেই, ছেলেরা শহরে কাজ খুঁজতে চলে যাচ্ছে, মেয়েরা ঋণের দায়ে জর্জরিত। এই অবস্থায় ১০ হাজার টাকার প্রতিশ্রুতি হয়তো এক মুহূর্তের স্বস্তি দেবে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে মুক্তি নয়।

এবারের বিহার নির্বাচন তাই এক অর্থে ‘নারীদের নির্বাচন’। তাদের চোখে এখন দুটো ছবি—একটা সরকার-প্রদত্ত অনুদানের, আরেকটা বাস্তব জীবনের সংগ্রামের। কোন ছবিটা তারা ভোটবাক্সে প্রকাশ করবে, তা জানাবে বিহারের ভবিষ্যৎ। নীতীশ কুমারের এই পদক্ষেপ যদি সত্যিই মানুষের জীবনে আলো আনে, তবে সেটাই হবে তার মাস্টারস্ট্রোক। কিন্তু যদি এই টাকা কেবল ঋণ শোধে হারিয়ে যায়, তবে তা হবে বুমেরাং—যার অভিঘাত শুধু নির্বাচনে নয়, বিহারের নারীজীবনের গভীরতর সংকটে প্রতিধ্বনিত হবে।

নীতীশ কুমারের রাজনীতি বরাবরই বাস্তববাদী। তিনি জানেন, বিহারের নারী ভোটাররাই তার সবচেয়ে বড় শক্তি। কিন্তু শক্তিকে টিকিয়ে রাখতে হলে কৌশল নয়, প্রয়োজন আস্থা। আর সেই আস্থা গড়ে ওঠে কাজ দিয়ে, অনুদান দিয়ে নয়। বিহারের নির্বাচনি হাওয়া তাই এখন এক অদ্ভুত দোলাচলে। নীতীশের অনুদানের গল্প কি সত্যিই উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি, নাকি ভোটের আগের নাটকীয় মাস্টারস্ট্রোক? উত্তরটা মিলবে ১৪ নভেম্বরের ভোটগণনার দিন। কিন্তু তার আগেই বিহারের নারীরা বুঝে গেছেন তাদের জীবনের গল্প শুধু নির্বাচনী প্রচারের বিষয় নয়, বরং সেই গল্পই আসল রাজনীতি।

লেখক : গণমাধ্যম শিক্ষক ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]

এইচআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।