আহত পুঁজিবাজার ৯ বছরে নিহত!

সম্পাদকীয় ডেস্ক
সম্পাদকীয় ডেস্ক সম্পাদকীয় ডেস্ক
প্রকাশিত: ০২:৫০ পিএম, ১৮ এপ্রিল ২০১৯

তানভীর আহমেদ

দেশের পুঁজিবাজারে ২০১০ সালে বড় ধরনের ধসের পর সরকার বাজারের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কে ঢেলে সাজানো। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য বর্তমান কমিশনের নিয়ন্ত্রণে ২০১০ সালের আহত পুঁজিবাজার ৯ বছরে হয়েছে নিহত।

পৃথিবীর যে কোন বাজারের প্রথম শর্ত হচ্ছে লেনদেন। যে বাজারে লেনদেন নেই সেই বাজারকে বাজার বলার কোন অবকাশ নেই। বাংলাদেশের পুঁজিবাজার তেমনি লেনদেন বিহীন একটি বাজার। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে ৬০% কোম্পানি দিনে ৫০ লক্ষ টাকার লেনদেন হয় না। ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি এবং মিউচুয়ালফান্ডের সংখ্যা ছিল প্রায় ২৫০টি। এই ২৫০টি কোম্পানি এবং মিউচুয়ালফান্ড নিয়ে ২০১০ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের গড় লেনদেন ছিল ১৬৪৩ কোটি টাকা।

২০১১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ১১৩টি নুতন কোম্পানি এবং মিউচুয়ালফান্ড বাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পরও ২০১৮ সালে বাজারের গড় লেনদেন ছিল মাত্র ৫৫১ কোটি টাকা। যা কিনা ২০১০ সালের লেনদেনের ৩ ভাগের মাত্র ১ ভাগ। প্রায় ৪৫% অর্থাৎ ১১৩ টি নুতন কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পরও গত ৯ বছরে পুঁজিবাজারে লেনদেন বাড়েনি একটি টাকাও। এদেশের পুঁজিবাজার যে প্রচণ্ড ভাবে ব্যর্থ এটি তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।

গত ৯ বছরে গড়ে প্রতি মাসে ১টি নুতন কোম্পানি বা মিউচুয়ালফান্ড বাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। প্রায় ৪৫% নুতন কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পরও লেনদেন বৃদ্ধি না পাওয়ায় একটি বিষয় পরিষ্কার, আর তা হচ্ছে নতুন কোম্পানি গুলো বাজারে নতুন বিনিয়োগকারী আনতে পারেনি বরং পুরাতন বিনিয়োগকারীদের পথে বসিয়ে দিয়েছে। বাজারে গণহারে কোম্পানি তালিকাভুক্ত করলেই যে বাজার ভাল হয় না এটা তার বড় প্রমাণ।

গত ৯ বছরে পুঁজিবাজার ঘুরে না দাঁড়ানোর অন্যতম কারণ হচ্ছে অখ্যাত এবং দুর্বল মৌল ভিত্তিক কোম্পানি গুলো একের পর এক বাজারে তালিকাভুক্ত করা। গত ৯ বছরে পুঁজিবাজারে একটি অপসংস্কৃতি চালু হয়েছে। দুর্বল কোম্পানির মালিকগণ যখন বুঝতে পারেন তাদের ডুবতে বসা কোম্পানির আর কোন ভবিষ্যৎ নেই এমন কি কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করার অবস্থাও নেই তখন কোম্পানি বিক্রি করে দেয়ার শেষ ঠিকানা হিসেবে পুঁজিবাজার বেছে নিচ্ছেন। আর এই অপসংস্কৃতিকে সহযোগিতা করে যাচ্ছে (বিএসইসি)।

বর্তমান (বিএসইসি) কমিশনের সময়কালে ৯১টি কোম্পানি আর ২২টি মিউচুয়ালফান্ড বাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। ২২টি মিউচুয়ালফান্ডের মধ্যে ইস্যু মূল্যের নিচে আছে ১৮টি মিউচুয়ালফান্ড। আর ৮৯ কোম্পানির মধ্যে ইস্যু মূল্যের নিচে আছে ৩৫টি। দুর্বল কোম্পানিকে সবল দেখিয়ে উচ্চ প্রিমিয়ামে পুঁজিবাজারে শেয়ার ছাড়ার অনুমোদন দেয়ায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আরও ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে ২০১১ সাল থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে আসা কোম্পানির সংখ্যা হচ্ছে ৭০টি।

আর এরই মধ্যে ২২টি কোম্পানি Z এবং B ক্যাটাগরিতে চলে গেছে। এই ২২টি Z এবং B ক্যাটাগরিতে যাওয়া কোম্পানির মধ্যে ৮টি কোম্পানি উচ্চ প্রিমিয়ামে বাজরে তালিকাভুক্ত হয়েছিল। ৮টি কোম্পানির মধ্যে রয়েছে জাহিন টেক্সটাইল, রংপুর ডেইরি, জিবিবি পাওয়া, বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল, অ্যাপোলো ইস্পাত, বেঙ্গল উইন্ডসর,রিজেন্ট টেক্সটাইল এবং পেনিনসুলা। ২০১৭ সালের পর যে কোম্পানি গুলো তালিকাভুক্ত হয়েছে এগুলো কতদিন পর Z এবং B ক্যাটাগরিতে চলে যাবে তা আরও কয়েক বছর গেলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে।

দুর্বল কোম্পানিগুলো আইপিওর মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে অর্থ উত্তোলনের পর বিনিয়োগকারীদের মুনাফার টাকা দেয়ার কথা বেমালুম ভুলে যায়। ডিভিডেন্ডের নাম করে একের পর এক কাগজ অর্থাৎ বোনাস শেয়ার ধরিয়ে দেয়। ক্যাশ না দিয়ে বোনাস দিয়ে সেই ক্যাশ দিয়ে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেন ভাল কথা কিন্তু সন্দেহ তখনি দেখা দেয় যখন দেখি কোম্পানি গুলোর ইনকাম দিন দিন শুধু কমছে আর কমছে। এই বোনাস শেয়ার গুলো বাজারকে এক সময় অস্থিতিশীল করে তোলে।

কিছুদিন না যেতেই ডিরেক্টরদের বোনাস শেয়ার বিক্রির হিড়িক পড়ে। প্রায় কয়েক ডজন কোম্পানির নাম বলা যাবে যারা বাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর থেকে আজও পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিতে পারেনি। যেমন জেনারেশন নেক্সট, ফ্যামিলিটেক্স,জাহিন স্পিনিং, তুং-হাই নিটিং, ইয়াকিন পলিমার,ফরচুন সু, সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজ, সেন্ট্রাল ফার্মা, পদ্মা লাইফ ইন্সুরেন্স, ন্যাশনাল ফিড মিল লিমিটেড।

এবার প্লেসমেন্ট শেয়ারের দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। গত কয়েক বছর থেকে লক্ষ করা যাচ্ছে কোম্পানি গুলো আইপিও তে যে পরিমাণ শেয়ার বিক্রি করছে তার থেকেও কয়েকগুণ শেয়ার প্লেসমেন্টে বিক্রি করছে। আজব বিষয়!! শোনা যায় মালিক পক্ষ নামে বেনামে প্লেসমেন্ট শেয়ার নিজেদের মধ্যেই রাখে। লক্ষ করলে দেখবেন সম্প্রতি বাজারে যে কোম্পানি গুলো তালিকাভুক্ত হয়েছে সেই কোম্পানি গুলোতে ডিরেক্টরদের হাতে যে পরিমাণ শেয়ার রয়েছে তার কয়েকগুণ বেশি শেয়ার রয়েছে প্লেসমেন্টে। কারণও আছে, বাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার ১ বছর পার হলেই প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি করা যায়। আবার কোন ধরনের নোটিশও লাগে না, যেখানে ডিরেক্টর শেয়ার বিক্রি করতে পারে ৩ বছর পর।

আবার বিক্রি করতে গেলে নোটিশও দিতে হয়। গত কয়েক মাস আগে তালিকাভুক্ত ২টি কোম্পানির নাম না বলেই পারছি না, এর একটি হল এস এস স্টিল অন্যটি হল এম এল ডাইং। এস এস স্টিল আইপিও তে শেয়ার ছেড়েছে মাত্র ২.৫ কোটি আর প্লেসমেন্টের মাধ্যমে শেয়ার বিক্রি করেছে ১৪ কোটির উপর। এটা কি বিশ্বাস করার যায়!! অন্যদিকে এম এল ডাইংও আইপিও তে শেয়ার ছেড়েছে মাত্র ২ কোটি আর প্লেসমেন্টের মাধ্যমে শেয়ার বিক্রি করেছে ৯ কোটির। এই বিপুল পরিমাণ শেয়ার প্লেসমেন্টের মাধ্যমে বিক্রির উদ্দেশ্য যে ভাল না এটা নিশ্চিত। যেখানে আইপিও তে ১৮ থেকে ২০ গুণ আবেদন পড়ে যেখানে প্লেসমেন্টে শেয়ার বিক্রি কতটুকু যৌক্তিক তা ভেবে দেখার সময় চলে এসেছে।

গত ৯ বছরে পুঁজিবাজারে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) স্বচ্ছতা নিয়েও ছিল অনেক ধরনের প্রশ্ন। গত ৯ বছরে বাজারে যেমন দুর্বল মৌলভিত্তিক কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে ঠিক তেমনি গত কয়েক বছরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে শেয়ারের মূল্য বৃদ্ধির তালিকায় শীর্ষে ছিল সকল অখ্যাত কোম্পানি। যেগুলোর বেশির ভাগই স্বল্প মূলধনী। যা দেখলে যে কেউ আঁতকে উঠবেন। মন্নু জুট স্টাফলার লিমিটেড গত বছরের বোনাস শেয়ার হিসেব করলে গত ২ বছরে শেয়ারটি দাম ১০০ টাকা থেকে ২২৪০ টাকা পর্যন্ত উঠে।

লিগ্যাসি ফুটওয়্যার গত ২ বছরে শেয়ারটি দাম ২০ টাকা থেকে ২৭৫ টাকা পর্যন্ত উঠে। মুন্নু সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড গত ২ বছরে শেয়ারটি দাম ২৬ টাকা থেকে ৪৫০ টাকা পর্যন্ত উঠে। কে এন্ড কিউ বাংলাদেশ লিমিটেড গত ২ বছরে শেয়ারটি দাম ৩৫ টাকা থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত উঠে। বিডি অটোকারস গত ২ বছরে শেয়ারটি দাম ৫০ টাকা থেকে ৪৫০ টাকা পর্যন্ত উঠে। স্টাইল ক্রাফট লিমিটেড গত বছরের বোনাস শেয়ার হিসেব করলে গত ২ বছরে শেয়ারটি দাম ১৫০ টাকা থেকে ১৪৫০ টাকা পর্যন্ত উঠে। যার সবগুলোই দুর্বল মৌলভিত্তিক স্বল্প মূলধনী কোম্পানি।

গত কয়েক বছরে দুর্বল মৌলভিত্তিক স্বল্প মূলধনী কোম্পানি গুলো নিয়ে যে কারসাজি হয়েছে তা (বিএসইসি) এর অনুসন্ধানেও বের হয়ে এসেছে। কারসাজির পেছনের ব্যক্তিদের (বিএসইসি) আর্থিক জরিমানা করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে আর্থিক জরিমানাকে "শাস্তি" বলা যায় কি? কারসাজি করে ১০০ কোটি টাকা লুটে নিল আর তাকে আপনি ৫০ লক্ষ টাকা জরিমানা করলেন। এটি শাস্তি হতে পারে ? এসইসি সুশাসন থাকলে এই শেয়ার গুলো নিয়ে কারসাজি করাটা সম্ভব হতো না। বাজারের এতো দুর্দিন দেখতে হতো না। বাজারে যতদিন ভাল এবং প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি গুলো চালকের আসনে আসতে ব্যর্থ হবে ততদিন বাজার কখনই ভাল হবে না।

বর্তমান বাজারে প্রতিটি বিনিয়োগকারী হতাশ। প্রচণ্ড ভাবে হতাশ। যত দিন যাচ্ছে বিনিয়োগকারীদের লোকসানের খাতা তত ভারি হচ্ছে। যে বাজার বছরে ১০ মাস খারাপ থাকে ঐ বাজারে নতুন বিনিয়োগকারী আসার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই। বর্তমানে যে সকল বিনিয়োগকারী বাজারে রয়েছেন তারাও তদের অর্থ বিনিয়োগের জন্য বিকল্প পথ খুঁজছেন। এই ভাবে চলতে থাকলে সামনে আমাদের আরও খারাপ দিন অপেক্ষা করছে।

বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা শূন্যের কোঠায়। কারণ এই কমিশন গত ৯ বছরে বাজারে আস্থার জায়গাটি শক্ত করতে পারেনি। তাই অতি সত্তর বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কে ঢেলে সাজানোর বিকল্প পথ দেখছি না। বিনিয়োগকারীসহ সকল মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য সৎ ব্যক্তিদের নিয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কে নুতন করে গঠন করা হলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা আস্তে আস্তে ফিরে আসবে বলে আশা করা যায়।

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।